মধুচন্দ্রিমার জন্যে মার্কাস দ্বীপ আদর্শ জায়গা। পাম গাছের ছায়ায় বাংলোগুলোর সদ্য বিবাহিত দম্পতিরা হেসে-খেলে অলস সময় কাটায়।
ব্রিসবেনের বাসিন্দা, ব্রয়ান ফস্টার পানি থেকে সৈকতে উঠে এলো। শেষ বিকেলেও গরম হয়ে আছে সাদা বালি, ভেজা গা নিয়ে সে তার নতুন বউয়ের দিকে হাঁটছে। একটা লাউঞ্জ চেয়ারে গা এলিয়ে দিয়ে ঢুলছে শেলি। স্ত্রীর দিকে এগোবার সময় ঘাড় ফিরিয়ে পানির দিকে একবার তাকালো ফস্টার।
ওরা কোরিয়ান দম্পতি, কিম ও লি সাং, ওদের পাশের বাংলোতেই থাকে। রিসর্টের একজন উৎসাহী ইনস্ট্রকটরের কাছে উইন্ডসার্ফিং-এর কলা কৌশল শিখছে দুজনে। ওদেরও খানিক সামনে, নিউজিল্যান্ডার এডওয়ার্ড কেইন স্নরকেল-এ চড়ে ছুটছে, পেছনে একটা ম্যাট-এর ওপর ভেসে রয়েছে তার স্ত্রী ময়রা। ওরাও সদ্য বিবাহিত।
স্ত্রীকে হালকা চুমো খেয়ে উদোম পিঠে একবার হাত বুলার ফস্টার। শেলির পাশে বালির ওপর শুয়ে পড়ল সে, চোখে সানগ্লাস তুলে অলস দৃষ্টিতে আবার তাকাল পানির দিকে।
কিম ও লি সাং উইন্ডসার্ফিং শিখতে হিমশিম খাচ্ছে। পাল তোলার আগেই ভারসাম্য হারিয়ে বারবার পড়ে যাচ্ছে পানিতে।
এডওয়ার্ড কেইন ও ময়রার দিকে তাকাল ফস্টার। পানিতে না পড়ে ম্যাটের ওপর পাশ ফিরল ময়রা, তারপর চিৎ হলো। এক প্রস্থে তৈরি সোনালি বেদিং স্যুট পরেছে সে, শরীরের বিশেষ কিছু ঢাকা পড়ে নি। তাকিয়ে থাকার মতো একটা ফিগার, মনে মনে প্রশংসা করল ফস্টার। তার স্বামীরকেল নিয়ে পানির নিচে রয়েছে।
হঠাৎ কি যেন একটা ধরা পড়ল ফস্টারের চোখে। প্রবাল রীফ কেটে চ্যানেলের ঠিক মুখে, পানির তলায়, কি যেন একটা ঘটছে। ফস্টারের মনে হলো, সম্ভবত কোনো সামুদ্রিক প্রাণি পানির তলায় আলোড়ন তুলছে। জিনিসটা কি দেখতে না পেলেও, বোঝা গেল রীফের ভেতর দিয়ে খাড়ির দিকে এগিয়ে আসছে ওটা।
সাবধান! চিৎকার করল ফস্টার, লাফ দিয়ে দাঁড়ালো। স্ত্রীকে বলল, ওখানে ওটা কী বলল তো? উত্তরের অপেক্ষায় না থেকে সৈকত ধরে ছুটলো সে, হাত তুলে আলোড়িত পানির দিকটা দেখাচ্ছে আর চিৎকার করছে, সাবধান! বিপদ! সাবধান!
তার চিৎকার শুনে সুইজিং পুল ও রেস্তোরাঁ থেকে ছুটে এলো অনেক লোক, পানির কিনারায় ভিড় করল সবাই।
কিম ও লি সাঙের ইন্সট্রাকটর ফস্টারের চিৎকার শুনতে পেল। তার হাত অনুসরণ করে তাকাতেই পানির নিচে আলোড়ন দেখতে পেল সে, এদিকেই এগিয়ে আসছে। কিম ও লি সাঙকে তীরে ফেলার জন্যে তাগাদা দিল সে। লাফ দিয়ে সেইলবোর্ডে চড়ে এডওয়ার্ড কেইন আর তার স্ত্রীকে সাবধান করার জন্যে ছুটলো। পানির তলায় অলস ভঙ্গিতে ভেসে যাচ্ছে এডওয়ার্ড কেইন, জানে না রহস্যময় একটা প্রাণি বা অন্য কিছু সরাসরি এগিয়ে আসছে ওদের দিকেই।
একটা গুঞ্জন ঢুকল কেইনের কানে। আন্দাজ করল, কেউ বোধহয় পানিতে স্কি করছে। তারপর হঠাৎ সে দেখল, আশপাশের সমস্ত মাছ একযোগে ছুটে পালালো। ভয়ে শরীরটা শিরশির করে উঠল তার। ধারণা করল, খাঁড়িতে নিশ্চয়ই হাঙর ঢুকে পড়েছে।
পানির ওপর মাথা তুলল কেইন, চারদিকে তাকিয়ে হাঙরের ফিন খুঁজলো। নেই দেখে খানিকটা স্বস্তিবোধ করল সে। দেখল একটা সেনইলবোর্ড এগিয়ে আসছে, আর তার স্ত্রী ফ্লোটিং প্যাডে ঝিমাচ্ছে, এ সময় চিৎকার শুনে সৈকতের দিকে তাকালো সে। রিসর্টের প্রায় সব লোকই ভিড় করেছে ওখানে, উন্মেত্তের মতো হাত নেড়ে চ্যানেলের প্রবেশপথটা দেখাচ্ছে তারা। সেদিকে তাকিয়ে তুমুল আলোড়নটা সেও এবার দেখতে পেল।
পানি থেকে একটা কাঁপুনি উঠছে, অনুভব করে আবার ডুব দিল কেইন। ভাবছে, কী হতে পারে জিনিসটা? স্বচ্ছ পানি, মাত্র পঞ্চাশ মিটার দুরে, কি ওটা? সবুজ ও খয়েরি মাটিতে ঢাকা বিশাল একটা আকৃতিবিহীন কাঠামো ধীরে ধীরে স্পষ্ট হলো তার চোখের সামনে।
স্ত্রীর ফ্লোটিং ম্যাট খপ করে ধরে দ্রুত সাঁতার কেটে এগোল কেইন। কাছেই প্রবালের একটা ঢাল পানির ওপর মাথা তুলেছে, নিরাপদ ভেবে সেদিকেই যাচ্ছে সে।
পাশ দিয়ে বেরিয়ে গেল কিমুতকিমাকার কাঠামোটা, ওদের কোনো ক্ষতি না করেই সরাসরি সৈকতের দিকে এগোচ্ছে।
অচেনা ও রহস্যময় একটা সামুদ্রিক দানবের মতো খাড়ির তলা থেকে মাথা তুলল ওটা। দেখে সভয়ে পিছিয়ে গেল রিসর্টের অতিথি ও কর্মীরা। কাঠামোটার চারদিকে থেকে হড়হড় করে পানি গড়াচ্ছে, ওটার নিচে থরথর করে কাঁপছে বালির জমিন, সৈকত ধরে উঠে এসে একজোড়া পাম গাছের মাঝখানে দাঁড়িয়ে পড়ল।
জমাট বাঁধা নিস্তব্ধতার ভেতর স্থির দাঁড়িয়ে আছে সবাই, পায়ে যেন শিকড় গজিয়েছে, কারো চোখে পলক নেই। এখন ওরা দেখতে পাচ্ছে, জিনিসটা আসলে প্রকাণ্ড একটা মেকানিকাল ভেহিকেল, ওপর দিকে চুরুট আকৃতির চূড়া। দুটো যান্ত্রিক বাহু শূন্যে উঠল। সামুদ্রিক আগাছা ও শ্যাওলা ঝুলে রয়েছে বাহনটার গায়ে। ধাতব একটা শব্দ হলো, সেই সঙ্গে খুলে গেল চূড়ান্ত হ্যাঁচ। এলোমেলো কালো চুলসহ একটা মুখ উঁকি দিল বাইরে, দৃষ্টিতে সরল কৌতুক। ভিড়টার ওপর চোখ বুলালো আগন্তুক, সবুজ চোখের দৃষ্টি স্থির হলো সাদা অ্যাপ্রাণ পরা এক যুবকের ওপর। তারপর হঠাৎ ঠোঁট ফাঁক করে হাসল সে, জানতে চাইল, ভুল হলে ক্ষমা চাই, তুমি আসলে একজন ওয়েটার?