কামরা থেকে বেরিয়ে গেলেন তারা। নিজের ইন্টারপ্রেটারের দিকে তাকালেন প্রেসিডেন্ট, বললেন, আমি যা বলব ঠিক তাই অনুবাদ করবে, কড়া ভাষার ওপর মধুর প্রলেপ লাগাবার দরকার নেই।
বুঝেছি, সার।
প্রধানমন্ত্রীর দিকে কঠিন দৃষ্টিতে তাকালেন প্রেসিডেন্ট। আমাদের কাছে ইন্টেলিজেন্স রিপোর্ট আছে, কাজেই এসব তথ্য আপনি অস্বীকার করতে পারবেন।, মি. প্রাইম মিনিস্টার। সুমা ও তার সাঙ্গপাঙ্গরা কী করতে যাচ্ছে, প্রথম থেকেই সব আপনি ও আপনার মন্ত্রিসভার অনেক সদস্য জানতেন। অ্যাটম বোমা তৈরির ওদের চেষ্টাকে আপনি নীরবে সমর্থন করেছেন। গোল্ডেন ড্রাগন নামে একটা আন্ডারওয়ার্ল্ড সংগঠন ভয়ঙ্কর একটা প্রজেক্টে অর্থ যোগান দিচ্ছে, তা-ও আপনি ও আপনার সহকারীরা জানতেন। কেইটেন প্রজেক্টের আসল উদ্দেশ্য, জাপানকে ব্ল্যাকমেলারের ভূমিকায় দাঁড় করানো। সমস্ত কিছু গোপনে করা হয়, এখন আবার এড়িয়ে যাবার যাবার চেষ্টা করছেন কিছুই না জানার ভান করে। সব জেনেশুনেও চুপ করে থেকে ওদেরকে আপনি সমর্থন যুগিয়েছেন।
অনুবাদ শোনার পর টেবিলে ঘুষি মারলেন প্রধানমন্ত্রী। এ সব অভিযোগ ভিত্তিহীন।
আমাদের ইন্টেলিজেন্স রিপোর্ট মিথ্যে হতে পারে না। আন্ডারওয়ার্ল্ডের পরিচিত অপরাধীরা নতুন সাম্রাজ্য গড়ে তোলার জন্যে কাজ করছিল, এ খবর একজন প্রধানমন্ত্রী হয়ে আপনি রাখেন নি, এটা কি বিশ্বাস করা যায়? আপনি সব জেনেও চুপ করে ছিলেন, সেটাই ওদেরকে উৎসাহ যুগিয়েছে। আপনারও ইচ্ছে ছিল, জাপান অ্যাটম বোমার মালিক হোক, সারা দুনিয়ায় অর্থনৈতিক সাম্রাজ্য গড়ে তুলুক।
চেহারা রক্তশূন্য হয়ে গেল, কথা বলতে পারলেন না প্রধানমন্ত্রী। দেয়ালের লিখন তিনি পড়তে পারছেন। মুখে চুনকালি মাখানো হবে, এ ভয়ে অস্থির হয়ে উঠলেন তিনি।
তাঁর দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে আছেন প্রেসিডেন্ট। এখানে আমরা কারো ব্যক্তিগত আত্মমর্যাদা নিয়ে আলোচনা করতে বসি নি। কিছু কিছু ব্যাপার নিয়ে আমেরিকা ও জাপানের মধ্যে চিরকালই মন কষাকষি হবে। তবে পরস্পরকে ছাড়া আমাদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখা অসম্ভব।
প্রধানমন্ত্রী উপলব্ধি করলেন, বাঁচার জন্যে তাঁর দিকে একটা রশি ছুঁড়ে দিয়েছেন প্রেসিডেন্ট। খপ করে সেটা ধরে ফেললেন তিনি।
আপনার প্রস্তাবটা বলুন।
জাতি ও রাষ্ট্রকে কেলেঙ্কারি থেকে বাঁচানোর জন্যে পদত্যাগ করবেন আপনি। আপনার ও আমার সরকারের মধ্যে যে পারস্পরিক বিশ্বাস ছিল তা নষ্ট হয়ে গেছে। এ ক্ষতি পুরণ করা সম্ভব হবে না। শুধু নুতন একজন প্রাইম মিনিস্টার এবং সৎ ও রুচিশীল সদস্যদের নিয়ে গঠিত একটা নতুন মন্ত্রিসভার পক্ষে দুদেশের মধ্যে সুসম্পর্ক ফিরিয়ে আনা সম্ভব। আশা করা যায়, তখন আমরা আমাদের অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক সমস্যাগুলো নিয়ে ফলপ্রসু আলোচনা বসতে পারব।
ঘটনাটা তাহলে গোপনই থাকবে?
আমি কথা দিচ্ছি, ড্রাগন সেন্টার এবং কেইটেন প্রজেক্ট সম্পর্কে সমস্ত তথ্য এদিক থেকে গোপন থাকবে।
কিন্তু আমি যদি পদত্যাগ না করি?
চেয়ারে হেলান দিয়ে হাত দুটো মেলে ধরলেন প্রেসিডেন্ট। সেক্ষেত্রে আমাকে ভবিষ্যদ্বাণী করতে হবে যে জাপানি ব্যবসায়ী ও শিল্পপতিরা বিষম একটা ধাক্কা খেতে যাচ্ছে।
চেয়ার ছেড়ে দাঁড়িয়ে পড়লেন প্রধানমন্ত্রী। আমাকে তাহলে বুঝতে হবে, মি. প্রেসিডেন্ট, আমেরিকায় জাপানি পণ্য নিষিদ্ধ ঘোষণা করার হুমকি দিচ্ছেন আপনি?
হুমকি দেয়ার কোনো প্রয়োজন নেই, ঘোষণা করারও, বললেন প্রেসিডেন্ট। কারণ, আমেরিকানরা যদি জানে যে জাপানে তৈরি অনেকগুলো অ্যাটম বোমা তাদের দেশে পাঠানো হয়েছিল, তার মধ্যে একটা ফাটানোও হয়েছে, জীবনে কখনো তারা কেউ আপনাদের পণ্য কিনবে বলে মনে হয় না আমার।
.
২১ নভেম্বর, ১৯৯৩, মার্কাস দ্বীপ
.
৭৬.
জাপানের দক্ষিণ পূর্ব থেকে এক হাজার একশো পঁচিশ কিলোমিটার দূরে মার্কাস আইল্যান্ড। সেই আদিকাল থেকে নিঃসঙ্গ, আশপাশে আর কোনো দ্বীপ নেই। দ্বীপটা প্রবালপ্রাচীরে ঘেরা, তীরগুলো নিখুঁত একটা ত্রিভুজ তৈরি করেছে, ত্রিভুজের প্রতিটি বাহু দৈর্ঘ্যে প্রায় দেড় কিলোমিটার।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় আমেরিকানরা মার্কাস দ্বীপে শুধু শুধু কয়েকটা বোমা ফেলেছিল, তখনই দ্বীপটার নাম কিছু কিছু মানুষ শুনেছে। তারপর ওটার কথা আর কেউ মনে রাখে নি। বছর চার-পাঁচ আগে হঠাৎ এক জাপানি ব্যবসায়ী দ্বীপটার নির্জন সৈকতে হাজির হন, তার ধারনা হয় টুরিস্টদের জন্যে জায়গাটা স্বর্গ হিসেবে বিবেচিত হতে পারে। তার অক্লান্ত পরিশ্রম ও উৎসাহেই মার্কাস দ্বীপ একটা বিলাসবহুল রিসর্ট হিসেবে গড়ে উঠেছে।
ছবির মতো সুন্দর একটা গ্রাম তৈরি করেছেন ভদ্রলোক। একটা গলফ কোর্স আছে, আছে একটা ক্যাসিনো ও তিনটে রেস্তোরাঁ, ককটেল লাউঞ্জ, ড্যান্স ফ্লোর, একটা থিয়েটার, বিরাট পদ্ম আকৃতির সুইমিং পুল, ছটা টেনিস কোর্ট। ছোট একা এয়ারফিল্ডও আছে, ফলে দ্বীপে আর কোনো জায়গা খালি পড়ে নেই।
রিসর্টের কাজ শেষ হবার পর দেখাবার জন্যে সাংবাদিকদের আমন্ত্রণ জানানো হয়, ফিরে গিয়ে যার যার কাগজে প্রতিবেদন লেখেন তাঁরা। অ্যাডভেঞ্চার প্রিয় টুরিস্টদের কাছে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে মার্কাস দ্বীপ। তবে জাপানি ট্যুরিস্টদের চেয়ে বিদেশি টুরিস্টরাই বেশি আসে এখানে, বিশেষ করে অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, তাইওয়ান ও কোরিয়ান ট্যুরিস্টরা।