.
কোরোরি ইয়োশিশু, ইচিরো সুবোই ও তাদের লোকজন এখনো ডিফেন্স কন্ট্রোল রূমে রয়েছে, পঙ্গু সি-ফাইবের পলায়ন দেখছে রাডারে।
দু-দুটো মিসাইল লাগল অথচ এখনো ওটা উড়ছে, সবিস্ময়ে নিস্তব্ধতা ভাঙল ইচিরো সুবোই।
এখনো ওটা পড়ে যেতে পারে, হঠাৎ থামলেন কোরোরি ইয়োশিশু। বিস্ফোরণের শব্দ ঠিক কতটা শুনতে পেরেছেন বলা কঠিন, তবে তার চেয়ে বেশি অনুভব করতে পেরেছেন। শুনলে?
হ্যাঁ, অনেক দূরে বোধহয় কোথাও বাজ পড়ল, রাডার ডিসপ্লে থেকে চোখ না সরিয়েই বলল মাসুজি কোয়োমা।
তুমি অনুভব করোনি? জানতে চাইলেন কোরোরি ইয়োশিশু।
পায়ের তলাটা সামান্য যেন কাপল, বলল ইচিরো সুবোই।
কোয়োমা নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে কাঁধ ঝাঁকাল। মাটির কম্পন জাপানিদের জন্যে নতুন কিছু নয়। প্রতি বছর মেইন আইল্যান্ডে এক হাজার বার ভুমিকম্প হয়, প্রতি সপ্তায় কয়েক বার জাপানিদের পায়ের নিচে মাটি কেঁপে ওঠে। সিসমিক কম্পন, বলল সে। আমরা একটা সিসমিক ফল্টের কাছে রয়েছি। ভয় পাবার কিছু নেই, এ ধরনের কাঁপুনি প্রায়ই অনুভব করি আমরা। দ্বীপটা নিরেট পাথর, ড্রাগন সেন্টারও এমনভাবে তৈরি করা হয়েছে যে ভুমিকম্পে কোনো ক্ষতি হবে না।
কামরার আলগা জিনিসপত্র সামান্য নড়ে উঠল, রোমাটার মন্থর হয়ে আসা এনার্জি ড্রাগন সেন্টারের ভেতর দিয়ে সামনে এগিয়ে গেল। তারপরই সাবওশন ফল্টের ধস থেকে তৈরি শক ওয়েভ দ্বীপের ওপর আছড়ে পড়ল প্রচণ্ড শক্তিতে। মনে হলো যেন গোটা ড্রাগন সেন্টার প্রতি মুহূর্তে চারদিকে টলছে আর ঝাঁকি খাচ্ছে। সবার চেহারায় বিস্ময়, তারপর বিস্ময়ের জায়গায় ফুটে উঠল উদ্বেগ, সবশেষে ভয়।
খুব জোরাল মনে হচ্ছে, বলল ইচিরো সুবোই, নার্ভাস।
হ্যাঁ, এ ধরনের ভুমিকম্প আগে কখনো অনুভব করি নি আমরা, তাল সামলাবার জন্যে একটা দেয়ালে হাত রাখল কোয়োমা।
কোরোরি ইয়োশিশু স্থিরভাবে দাঁড়িয়ে আছেন, চেহারা দেখে বোঝা গেল খুব রাগ হয়েছে তাঁর। এখান থেকে আমাকে তোমরা বের করো, নির্দেশ দিলেন তিনি।
টানেলের চেয়ে এখানেই বরং আমরা বেশি নিরাপদ, চিৎকার করল মাসুজি কোয়োমা। ড্রাগন সেন্টার এখনও প্রবল ভাবে ঝাঁকি খাচ্ছে, কর্কশ ও বিচিত্র সব শব্দে কান পাতা দায়।
দ্বীপের নিচে রয়েছে লাভা রক, সেটাকে ভেদ করে ছুটে গেল শক ওয়েভ। ড্রাগন সেন্টারে যারা কিছু না ধরে দাঁড়িয়ে ছিল, ছিটকে পড়ে গেল মেঝেতে। লাভা রক-এর নিচে রয়েছে নরম পলিমাটির স্তর, ছিন্ন ভিন্ন হয়ে গেল সেটা। কন্ট্রোল সেন্টার এবার আরো তীব্রগতিতে টলতে শুরু করল, প্রতি মুহূর্তে এদিক ওদিক কাত হচ্ছে গোটা দ্বীপ। ড্রাগন সেন্টারের প্রতিটি জিনিস, যেগুলো আটকানো নয়, উল্টে পড়ল।
হামাগুড়ি দিয়ে কামরার এক কোণে সরে গেল ইচিরো সুবোই। হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে আছে কোয়োমার দিকে। মনে হচ্ছে আমরা যেন নিচের দিকে ডেবে যাচ্ছি।
কোয়োমা গুঙিয়ে উঠল, দ্বীপ ডুবে যাচ্ছে।
ড্রাগন সেন্টারের আতঙ্কিত লোকেরা জানে না অতিকায় সুনামি শক ওয়েভের ঠিক দুমিনিট পেছনে রয়েছে।
কাদার ভেতর দিয়ে পথ করে নিয়ে হেলে-দুলে এগোচ্ছে বিগ বেন, হডকে নেমে যাচ্ছে ট্রেঞ্চের তলার দিকে। প্রতি মুহূর্তে নিয়ন্ত্রণ হারাচ্ছে ট্রাক্টর বেল্ট, আড়াআড়ি হয়ে যাচ্ছে বিগ বেন। তারপর আবার বেল্টটা ঢুকে পড়ছে শক্ত মাটিতে, ফিরে পাচ্ছে নিয়ন্ত্রণ।
একটা কালার স্ক্রীন কয়েকটা ডায়াল ও গজ গাইড করছে পিটকে। সোনার লেয়ার স্ক্যানার বাইরের দৃশ্য তুলে ধরছে ওর চোখের সামনে, সেগুলো পরীক্ষা করে নিজের নিয়তি বোঝার চেষ্টা করছে ও।
এখনো যে বেঁচে আছে, এটা একটা বিস্ময় বলে মনে হলো ওর। কারণটাও বোঝা গেল। এদিকে শুধুই নরম মাটির আর কাদা, শক্ত পাথরের কোনো অস্তিত্ব নেই। তবে, জিওফিজিসিন্টদের হিসাব অনুসারে যথেষ্ট দূরে সরে আসতে ব্যর্থ হওয়ায় ভূমিধস ওর নাগাল পেয়ে যাবে।
ভূমিধসে চাপা পড়বে, কিছুই করার থাকবে না ওর। তবে তার আগে ওকে চেষ্টা করতে হবে প্রথম ধাক্কাটা লাগার সময় ট্রেঞ্চের পাচিল থেকে বিগ বেন যেন ছিটকে না পড়ে। এ ধরনের দুর্ঘটনা এড়াতে হলে শক্ত মাটির পাঁচিল বা নিরেট পাথরের আড়াল পেতে হবে ওকে।
ভূমিধস নাগাল পেয়ে গেল অন্য কথা, ওর সবচেয়ে বড় বাধা এখনো ট্রেঞ্চটাই। উল্টোদিকে রয়েছে ও। জাপানি উপকূলে পৌঁছুতে হলে প্রথমে ট্রেঞ্চের তলায় নামতে হবে ওকে, তারপর অপর দিকে ঢাল বেয়ে উঠতে হবে।
পিট জানে না, স্ক্যানার ওকে জানাতে পারেনি, উল্টোদিকের ঢাল বেয়ে ওটা ওর পক্ষে সম্ভব হবে না। একটা কারণ, ঢালটা অসম্ভব খাড়া। আরেকটা কারণ, চালটা শক্ত মাটি দিয়ে তৈরি নয়। তাছাড়া, সাগরের তলায় ঠাটলটা আরো চওড়া ও গম্ভীর হচ্ছে, ঘুরে যাচ্ছে দক্ষিণ-পুবে, অর্থাৎ আটশো কিলোমিটারের মধ্যে পালানোর কোনো সুযোগ দেবে না। স্ক্যানার অবশ্য ওকে জানালো, মহাশক্তিধর সিসমিক ভূমিধস ট্রেঞ্চের পুব পাড় ধরে ছুটে আসছে অবিশ্বাস্য দ্রুতবেগে, কিন্তু জানালো অনেক দেরিতে।
নরম কাদার সঙ্গে সংগ্রাম করছে বিগ বেন, এ সময় ধসটা আঘাত করল। পিট অনুভব করল ওর বাহনের নিচ থেকে সরে গেল মাটি। সে মুহূর্তে নিজের নিয়তি সম্পর্কে নিশ্চিত হলো ও। বুঝল, হেরে গেছে। এ ধরনের বিকট গর্জন কেউ কোনোদিন শুনেছে বলে মনে হয় না, অন্তরাত্মা কেঁপে উঠল পিটের। দেখতে পেল মৃত্যুর থাবা ওকে ছুঁয়ে দেওয়ার জন্যে লম্বা হয়েছে। পিট শুধু শরীরটাকে শক্ত করে নেওয়ার সময় পেল, চোখের পলকে সুনামির কাদার পাঁচিল গ্রাস করল বিগ বেনকে, সঙ্গে করে ছুটিয়ে নিয়ে চলল কালো গভীর পাতালে।