গুড গড! অবিশ্বাস ও বিস্ময়ের ধাক্কার সঙ্গে ভয়ের একটা শিহরণও অনুভব করলেন প্রেসিডেন্ট।
এখনো আমি ডার্ক পিটের ওপর আস্থা হারাই নি, রেইমন্ড জর্ডান শান্তকণ্ঠে বললেন। বোমার ফায়ারিং সিস্টেম প্রাইম করতে ব্যর্থ হয়েছেন তিনি, এর কোনো প্রমাণ এখনো আমি পাই নি।
প্রেসিডেন্টের চোখে ক্ষীণ আশার আলো জ্বলে উঠল। কখন জানতে পারব আমরা?
ডার্ক যদি সময়সূচি রক্ষা করতে পারেন, বাবো মিনিটের মধ্যে বিস্ফোরণ ঘটার কথা।
চেহারায় কোনো ভাব নেই, ডেস্কের ওপর তাকালেন প্রেসিডেন্ট। তারপর যখন কথা বললেন, কোনো রকমে শুনতে পেলেন রেইমন্ড জর্ডান।
ডার্ক পিটের জন্যে প্রার্থনা করো, রেই। ঈশ্বরের কাছে ওর সাফল্যের জন্যে কান্নাকাটি করো।
.
৭২.
টাইমিং প্লেটটা ধীরে ধীরে খেয়ে ফেলল অ্যাসিড কম্পাউন্ড, তারপর হামলা চালার ব্যারোমেট্রিক প্রেশার সুইচে। একটু পরই একটা ইলেকট্রিকাল চার্জ তৈরি হলো, বন্ধ হয়ে গেল ফায়ারিং সার্কিট।
প্রায় পাঁচ দশক অপেক্ষা করার পর, মূল বোমার চারধারে বত্রিশটা ডিটোনেটর জ্যান্ত হয়ে উঠল, আগুন জ্বালিয়ে দিল অবিশ্বাস্য জটিল ডিটোনেশন সিস্টেমে, যার ফলে চেইন রিঅ্যাকশন শুরু করার জন্যে চারপাশের প্রটোনিয়ামে ঢুকে পড়ল নিউট্রন। এরপর শুরু হলো ফিশন বিস্ফোরণ, পরমাণু বিভাজন সৃষ্টি হলো শত সহস্র মিলিয়ন ডিগ্রি ও কিলোগ্রাম চাপ আর শক্তি। পানির তলায় গ্যাস ভরা অগ্নিগোলক মাথাচাড়া দিল, ছুটল ওপর দিকে, ছিন্ন করল সাগরের পিঠ। আকাশের দিকে উঁচু হলো বিশাল এলাকা জুড়ে বিপুল পানি, শক ওয়েভের ধাক্কা খেয়ে ছড়িয়ে পড়ল রাতের বাতাসে।
যেহেতু চাপ দিয়ে সংকুচিত করা যায় না, তুই শক ওয়েভ পাঠানোর জন্যে পানি হয়ে উঠল প্রায় নিখুঁত একটা মাধ্যম। প্রতি সেকেন্ড কম-বেশি দুই কিলোমিটার গতি, শক ওয়েভের সামনের অংশ মাত্র আট কিলোমিটার দুরে ট্রেঞ্চের ভেতর নাগাল পেয়ে গেল বিগ বেন-এর। ট্রেঞ্চের চাল বেয়ে মন্তরবেগে নেমে যাচ্ছে বিগ বেন, বারো মাইল অর্থাৎ নিরাপদ দূরত্বে সরে যেতে পারে নি। প্রকাণ্ড একটা হাতুড়ির মতো আঘাত করল শক ওয়েভ।
প্রচণ্ড ঝাঁকি খেল বিগ বেন, নরম পলিমাটির সচল পাঁচিল গ্রাস করল ওটাকে, কোনো দিকে দৃষ্টি চলে পিট, তবু পিট শুধু উল্লাসই বোধ করল। বিস্ফোরণের সঙ্গে সঙ্গে ব্যর্থতার সমস্ত ভয় উবে গেছে মন থেকে। সোনার প্রোব-এর ওপর অন্ধবিশ্বাস। রেখে ঘোলা পানি ও কাদার ভেতর দিয়ে বিগ বেনকে নিয়ে এগোচ্ছে অজানা পথে। লম্বা একটা কার্নিসে রয়েছে, দীর্ঘ ঢালের মাঝখান দিয়ে নেমে গেছে সেটা। ঢালের চেয়ে কার্নিসটা কম ঢালু, ফলে গতি আগের চেয়ে সামান্য হলেও বেড়েছে, কারণ রির্ভাস এনগেজ করার দরকার হচ্ছে না। কার্নিসেও কাদা আছে, তবে কাদার নিচে রয়েছে পাথর, ফলে ট্র্যাক্টর রেস্ট অল্প হলেও কাজে লাগছে। যদিও যান্ত্রিক দানবটাকে সোজা পথে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া অসম্ভব একটা ব্যাপার, কাদার ওপর বারবার হড়কে যাচ্ছে বিগ বেন।
নিয়তি সম্পর্কে পিটের মনে কোনো ভুল ধারণা নেই। প্রাণ বাঁচানোর প্রতিযোগিতায় হেরে যাচ্ছে ও। ধেয়ে আসছে পাহাড়ের মত উঁচু ভুমিধস। ওটার পথ থেকে সরে যাওয়ার কোনো উপায় নেই। ঢালের কোথায় লুকাবে পিট? পুরো ট্রেঞ্চটাই তো ভূমিধসে ভরাট হয়ে যাবে।
তবু, গোঁয়ারের মতো একটা জেদ কাজ করছে ওর ভেতর। যেভাবে হোক, বেঁচে থাকতে হবে ওকে।
সাগরের ওপর, অন্ধকারে দেখা যাচ্ছে না, বিশাল এলাকার বিপুল পানি দুশো মিটার পর্যন্ত উঁচু হলো, তারপর ছড়িয়ে পড়ল চারদিকে। কিন্তু ফল্ট জোনের গভীরে কী ঘটছে? ট্রেঞ্চের মেঝের নিচে শক ওয়েভের অবিশ্বাস্য শক্তি পৃথিবীর শক্ত ছালে একটা খাড়া ফাটল তৈরি করল। একের পর এক ধাক্কা লাগায় ফাটলটা চওড়া হচ্ছে, সৃষ্টি করছে উঁচু মাত্রার ভূমিকম্প।
লক্ষ বছর স্থির হয়ে থাকা পলিমাটির অসংখ্যা স্তর আগে পিছে জায়গা বদল শুরু করল, টেনে নিচে নামাচ্ছে সোসেকি দ্বীপের ভারীলাভা, দ্বীপটা হয়ে উঠল চোরাবালিতে পড়া এক টুকরো পাথরের মত। মাটিতে গাঁথা বিশাল পাথরে দ্বীপ শক ওয়েভের প্রাথমিক ধাক্কা সহজেই হজম করতে পারল, ভুমিকম্পে কোনো ক্ষতিই হলো না কয়েক মিনিট। কিন্তু তারপরই সাগরে ভেবে যেতে শুরু করল, বাধের গা বেয়ে ওপরে উঠছে পানি।
নিচের স্তরে পলিমাটি জমাট না বাধা পর্যন্ত ডেবে যেতে থাকল দ্বীপটা, তারপর ভাসমান পাথরের বিস্তার ধীরে ধীরে নিচ হলো, এক সময় স্থির হলো নতুন একটা স্তরে। কিন্তু এখন সাগরের ঢেউগুলো পাহাড়-প্রাচীরের গোড়ায় আঘাত করছে না, বাঁধের মাথা টপকে উঠে আসছে দ্বীপের ওপর, লাফ দিয়ে ছুটে যাচ্ছে সামনের সারি সারি গাছপালার দিকে।
বিস্ফোরণের কয়েক সেকেন্ড পর ট্রেঞ্চের পুব পাঁচিলের বিশাল একটা অংশ কেঁপে উঠল, অবিশ্বাস্য দ্রুতবেগে ফুলে উঠল বাইরের দিকে। তারপর বজ্রপাতের মতো বিকট শব্দে কয়েক শো মিলিয়ন টন কাদা বিস্ফোরিত হয়ে লাফ দিল ট্রেঞ্চের তলা লক্ষ করে। কল্পনার অতীত আলোড়ন সৃষ্টি হলো পানিতে। শুরু হলো সুনামি।
সাগরের একটা অংশ যেন বিদ্রোহী হয়ে উঠল। সারফেসের নিচে মাত্র এক মিটার উঁচু, নিচে হিমালয়ের আকৃতি পাওয়া পানির পাহাড় ঘণ্টায় পাঁচশো কিলোমিটার গতিতে ছুটল পশ্চিম দিকে ধেয়ে আসা এ পানির সঙ্গে দুনিয়ার অন্য কোনো শক্তির তুলনা চলে না, অপর কোন শক্তির এখোটা ধ্বংসকারী ক্ষমতা নেই। ওটার পথে, মাত্র বিশ কিলোমিটার সরাসরি সামনে রয়েছে সোসেকি দ্বীপ।