চীফ পাইলটের চেহারা লাল হয়ে উঠেছে, কপালে বিন্দু ঘাম। ঠিক আছে, অ্যাডমিরাল। তবে তীরে পৌঁছুনোর জন্যে লম্বা একটা সাঁতার দেওয়ার প্রস্তুতি নিন আপনি।
অ্যাডমিরাল হাসতে যাবেন, তাঁর কাঁধে একট হাত পড়ল। আমি দুঃখিত, অ্যাডমিরাল, বলল কমিউনিকেশন অপারেটর। রেডিও গুঁড়িয়ে গেছে। কিছু ট্রান্সমিট বা রিসিভ করা সম্ভব নয়।
বোবা রেডিও নিয়ে এলাকায় থেকে লাভ কী? জিজ্ঞেস করল চীফ পাইলট।
সিধে হয়ে দাঁড়ালেন অ্যাডমিরাল, তাকালেন অ্যালের দিকে, দৃষ্টিতে হতাশা। পিট কিছু জানবে না। ও ভাববে, ওকে একা ফেলে চলে গেছি আমরা।
উইন্ডস্ক্রীন দিয়ে কালো আকাশ ও কালো সাগরে মাঝখানে তাকাল অ্যাল। অসুস্থবোধ করল সে। চোখের পানি আটকে রাখার প্রাণপণ চেষ্টা করে বলল, আমাদেরকে পিটের দরকার নেই। কেউ যদি বোমাটা ফাটাতে পারে তো সে পিট। কেউ যদি এ ধরনের বিপদ থেকে নিজেকে বাঁচাতে পারে তো সে আমার ওই হিরো।
ওর ওপর আমারও বিশ্বাস আছে, দৃঢ়কণ্ঠে বললেন অ্যাডমিরাল।
ওকিনাওয়া? ঘাড় ফিরিয়ে জানতে চাইল চীফ পাইলট।
ধীরে ধীরে, অনিচ্ছা সত্ত্বেও, তার দিকে তাকালেন স্যানডেকার, বিড়বিড় করে বললেন, ওকিনাওয়া।
প্রকাণ্ড প্লেনটা অন্ধকারে ঘুরে গেল। কয়েক মুহূর্ত পর অস্পষ্ট হয়ে এলো এঞ্জিনের আওয়াজ। পেছনে পড়ে থাকল নিশুপ সাগর, একজন মানুষ বাদে সম্পূর্ণ। নির্জন।
.
৭১.
ম্যানিপুলেটরে ঝুলছে বোমাটা। বিশাল সাবমেরিন ট্রেঞ্চের কিনারায় দাঁড়িয়ে রয়েছে বিগ বেন্। ট্রেঞ্চটা দশ কিলোমিটার চওড়া, দুই কিলোমিটার গভীর।
জিওফিজিসিষ্টরা ট্রেঞ্চের কিনারা থেকে বারোশো মিটার নিচের একটা ঢালকে বোমা ফাটাবার পজিশন হিসেবে নির্বাচন করেছে। বিস্ফোরণের ফলে সুনামি সৃষ্টি হবে, তারপর সিসমিক সী ওয়েভ। তবে স্যাটেলাইট ফটো দেখে যা ধারণা করা হয়েছে তার চেয়ে অনেক বেশি খাড়া ঢালটা। আরো খারাপ লক্ষণ হলো, ট্রেঞ্চের পাশের পলিমাটি তেলতেলা কাদার মতো হয়ে আছে। কী ধরনের বিপদে পড়তে যাচ্ছে, বুঝতে পেরে ভয়ই পেল পিট। পিচ্ছিল কাদায় একবার যদি হড়কাতে শুরু করে ভারী বাহনটা ট্রেঞ্চের একেবারে তলায় গিয়ে থামতে হবে। এমনকি কাদায় না পিছলালেও বিপদের মাত্রা কমছে না, কারণ, আঠার মতো কাদা বেয়ে কোনভাবেই আবার ওপরে উঠে আসা সম্ভব নয়। পিট সিদ্ধান্ত নিল, বোমাটা বিস্ফোরণের জন্যে তৈরি করার পর ওপরে ওঠার কোনো চেষ্টাই ও করবে না। ঢালের একটা পাশ ধরে আরো নিচে নামবে। নামতে হবে দ্রুত, যাতে ভুমিধসে চাপা না পড়ে। একবার চাপা পড়লে আগামি এক কোটি বছরে বেরুতে হবে না।
জীবন ও মৃত্যুর মাঝখানে রেখাটা কি সাংঘাতিক সরু, ভাবতে গিয়ে রোমাঞ্চিত হলো পিট। পাশে অ্যাল নেই বলে মনটা খারাপ। সি-ফাইভ গ্যালাক্সি যোগাযোগ রাখছে না, কারণটা বুঝতে পারল না ও। নিশ্চয় সঙ্গত কোন কারণ আছে। কারণ ছাড়া অ্যাল বা অ্যাডমিরাল ওকে ত্যাগ করবেন না।
উৎসাহ যোগানোর জন্যে কেউ ওর সঙ্গে কথা বলছে না, নিঃসঙ্গ পরিবেশটা ভৌতিক লাগছে। অবসাদ ও ক্লান্তি দুর্বল করে তুলছে ওকে। সীটের ওপর বেনিয়ে রয়েছে, যেন কোন আশা নেই মনে। হাতঘড়ি দেখল একবার।– খানিক পর বিগ বেন-এর ম্যানুয়াল কন্ট্রোল হাতে নিল পিট। সি-বাইভ থেকে ওরা যোগাযোগ করছে না, কাজেই পরামর্শ পাবার আশা নেই। ডিটোনেশন সেন্টারে পৌঁছুতেই হবে ওকে, আর দেরি করার কোনো মানে হয় না।
ফরওয়ার্ড ডাইভ এনগেজ করল পিট, প্রকাণ্ড ট্রাক্টর ভেহিকেল ডাল বেয়ে নামতে শুরু করল।
প্রথম একশো মিটারের পর অধোগতি বাড়তে শুরু করল। পিটের ভয় হলো, ডার্লিংকে বোধহয় আর থামাতেই পারবে না, সরাসরি ট্রেঞ্চের তলায় পৌঁছে যাবে। ব্রেক করল, কিন্তু বিগ বেন-এর গতি তাতে কমল না। পিচ্ছিল কাদার ওপর দিয়ে হড়কে নেমে যাচ্ছে প্রকাণ্ড যান্ত্রিক দানবটা।
ম্যানিপুলেটরের গ্রিপ-এর গোল বোমাটা মারাত্মক ভঙ্গিতে দুলছে। সরাসরি ওর সামনে রয়েছে ওটা, না তাকিয়ে পারছে না পিট। আর তাকালেই যেন নিজের ভবিষ্যৎ মৃত্যু প্রত্যক্ষ করছে ও।
হঠাৎ করে আরেকটা ভয়ঙ্কর চিন্তা খেলে গেল মাথায়। বোমাটা যদি গ্রিপ থেকে ছিটকে পড়ে, নেমে যায় ঢাল বেয়ে, ওটাকে উদ্ধার করা সম্ভব হবে না। ভয়ে আড়ষ্ট হয়ে গেল শরীর। মৃত্যু ভয় নয়, ব্যর্থতার ভয়। জীবন দিয়ে হলেও এই অপারেশনে সফল হতে হবে ওকে।
সীটের ওপর সিধে হলো পিট, দ্রুত নড়ে উঠল হাত দুটো। এমন একটা ঝুঁকি নিচ্ছে, কোনো সুস্থ লোক ভাবতেই পারবে না। রিভার্স ড্রাইভ দিয়ে অতিরিক্ত পাওয়ার অ্যাপ্লাই করল। ক্লিট বা গোঁজগুলো পেছন দিকে গতি পেল, ধীরে ধীরে মন্থর হলো বিগ বেন-এর গতি।
দাঁড়িয়ে পড়ল বিগ বেন। ঘোলা পানি ঢেকে ফেলল ওটাকে। ধীরে ধীরে পঞ্চাশ মিটার এগোল পিট, পানি খানিকটা পরিষ্কার হতে আবার রিভার্স এনগেজ করল, দাঁড় করাল বিগ বেনকে। এভাবেই এগোল পিট, খানিক দূর এগিয়ে থামে, তারপর আবার এগোয়। নিয়ন্ত্রণ ফিরে পেয়েছে ও, ফিরে পেয়েছে আত্মবিশ্বাস।
আধ ঘণ্টা পর নেভিগেশনাল কমপিউটার সঙ্কেত দিল, গন্তব্যে পৌঁছে গেছে ও। ঢালের মেঝে থেকে বেরিয়ে রয়েছে ছোট ও সমতল একটা শেলফ, পাওয়ার সিস্টেম ডিজএনগেজ করে পার্ক করল ও। ডিটোনেশন সাইটে পৌঁছেছি আমি, কমিউনিকেশন ফোনে বলল পিট, ওপরে কোথাও থেকে এখনো হয়তো শুনছেন জেমস স্যানডেকার, এ আশায়।