আকাশে আর মাত্র এক ঘণ্টা আছে পিট, উচিত ছিল অ্যালের পাশে দাঁড়িয়ে বিগ বেন-এর সঙ্গে পরিচয়টা ভার করে ঝালাই করে নেয়া। তা না করে ও যা করছে, অদ্ভুতই বলতে হবে। ক্রুদের কাছ থেকে যতগুলো পারে লাঞ্চ বক্স সংগ্রহ করছেও, কিছু চেয়ে নিল, কিছু কিনে। খাবার পানি সংগ্রহ করল ৩০ লিটার। এমনকি কফিও সংগ্রহ করল। সবই যত্ন করে তুলে রাখল বিগ বেন-এ। এয়ার ফোর্স ফ্লাইট এঞ্জিনিয়ারের কাছ থেকে খানিকটা কেবল ধার করল ও, ধার করল একটা ছোট ইলেকট্রিক উইঞ্চ। সবশেষে বিগ বেন-এর অপারেটরস চেয়ারে বসল, ভাবছে মিশনটা সফল হবে কিনা। বি-টোয়েনটিনাইন থেকে বোমা বের করা অত্যন্ত জটিল একটা কাজ, তারপর অচেনা সাগরের মেঝের ওপর দিয়ে বারো কিলোমিটার সরে আসতে হবে প্রাণ নিয়ে, তা না হলে বিস্ফোরিত আটক বোমা ভস্ম করে দেবে ওকে।
ফিফটিন মিনিটস টু ড্রপ, জেন্টেলমেন, কার্গো বে-র স্পীকার থেকে ভেসে এলো পাইরটের যান্ত্রিক কণ্ঠস্বর।
তোমাদের তৈরি হবার সময় হয়েছে, স্যানডেকার বললেন, মুখের চামড়া টান টান হয়ে আছে।
অ্যালের কাঁধে একটা হাত রাখল পিট। রওনা হবার আগে চলো বাথরুম ব্যবহার করি।
অবাক হয়ে তাকাল অ্যাল। কেন? বিগ বেন-এ তো ওয়েস্ট সিস্টেম আছেই।
সাবধানের মার নেই। কেউ জানি না পানিতে কত জোরে পড়ব আমরা। অ্যাক্সিডেন্টের সময় শরীরের ভেতরটা যাতে নষ্ট না হয় সেজন্যে রেস কারের ড্রাইভাররা প্রতিযোগিতা শুরুর এগ সব সময় ব্লাডার খালি করে নেয়।
কাঁধ ঝাঁকাল অ্যাল। বেশ। টয়লেটের দিকে এগিয়ে গেল সে।
টয়লেটে ঢুকছে অ্যাল, বাইরে থেকে দরজাটা বন্ধ করে দিল পিট। ফ্লাইট এঞ্জিনিয়ারের দিকে ফিরে ইঙ্গিত করল, উত্তরে ছোট করে মাথা ঝাঁকাল ফ্লাইট এঞ্জিনিয়ার, কয়েকটা মোটা তার দিয়ে ছোট্ট করে মাথা ঝাঁকাল ফ্লাইট এঞ্জিনিয়ার, কয়েকটা মোটা তার দিয়ে ছোট্ট টয়লেট বেঁধে ফেলল সে।
কী ঘটছে বুঝতে পেরে ভেতর থেকে চিৎকার জুড়ে দিল অ্যাল। পিট, না! গড, নো! পিট, প্লীজ।
কী ঘটছে স্যানডেকারও তা বুঝতে পারলেন। তুমি একা পারবে না। পিটের একটা বাহু আঁকড়ে ধরলেন তিনি। তোমরা দুজন, এর-কথা মনে রেখে প্ল্যানটা তৈরি করা হয়েছে।
বিগ বেকে চালাবার জন্যে একজনই যথেষ্ট। দুজনকে মৃত্যুর পথে ঠেলে দেয়া বোকামি, টয়লেটের দরজায় ঘন ঘন লাথি পড়ছে, ইস্পাতের কেবল জড়ানো থাকায় খুলছে না ওটা। অ্যালকে বলবেন, সত্যি আমি দুঃখিত। যদি বেঁচে ফিরে আসি, ওর সমস্ত গালমন্দ আমি হাসিমুখে হজম করব।
আমি নির্দেশ দিলেই ক্রুরা ওকে বের করে আনবে।
রাবারের মতো প্রসারিত হলো পিটের ঠোঁট। তা পারেন, কিন্তু কাজটা করতে হলে আমার সাথে লড়তে হবে ওদের।
তুমি কিন্তু অপারেশনটা নষ্ট করছ। পানিতে নামার সময় যদি আহত হও, তখন কী হবে?
দীর্ঘ একটা মুহূর্ত অ্যাডমিরালের দিকে তাকিয়ে থাকল পিট। তারপর বলল, একজন বন্ধুকে হারাতে হবে, এই ভয় নিয়ে কোনো কাজ করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়।
স্যানডেকার জানেন, তাঁর স্পেশাল প্রজেক্ট ডিরেক্টরকে টলানো সম্ভব নয়। ধীরে ধীরে পিটের একটা হাত নিজের দুটো দিয়ে ধরলেন তিনি। ফিরে এসে কী দেখতে চাও তুমি, পিট, মাই সান?
উষ্ণ হাসি ফুটল পিটের মুখে। এক প্লেট গলদা চিংড়ি আর কড়া টেকুইলা!
ঘুরল পিট, বিগ বেন-এ চড়ল, ভেতর থেকে সীল করে দিল হ্যাঁচ।
সি-ফাইড গ্যালাক্সিতে কিছু পরিবর্তন আনা হয়েছে। ইট্রুমেন্ট প্যানেলের পাশের হাতলটা ধরে টান দিল কো-পাইলট, ইলেকট্রিক মটরের গুঞ্জন শোনা গেল, সেই সঙ্গে কার্গো ডেকের মেঝে এক পাশে সরে যাওয়ায় বিরাট একটা ফাঁক দেখা গেল। অ্যাডমিরাল স্যানডেকার ও দুজন ক্রুর শরীর সেফটি স্ট্যাপ দিয়ে বাধা, বিগ বেন এর সামনে দাঁড়িয়ে ওঁরা। বিরাট ফাঁকটা দিয়ে তীব্র বাতাস আসছে। বিগ বেন-এ বসে রয়েছে পিট।
ড্রপ জোনে পৌঁছুতে আর ষাট সেকেন্ড, পাইলটের কণ্ঠস্বর ভেসে এলো ওদের হেডসেটে। বাতাসের গতিপাঁচ নট। আকাশে মেঘ নেই। বাঁকা চাঁদ। সাগরে চার ফুট ঢেউ। রাডারে কোনো সারফেস শিপ দেখা যাচ্ছে না।
পরিবেশ গ্রহণযোগ্য, নিশ্চিত করলেন অ্যাডমিরাল।
বিগ বেন-এর সামনে দাঁড়িয়ে অ্যাডমিরাল শুধু দেখতে পাচ্ছেন কার্গো ডেকের বিরাট হা। এক হাজার মিটার নিচে সাগর চকচকে রূপো।
আর বিশ সেকেন্ড, বলে কাউন্ট ডাউন শুরু করল পাইলট।
বিশাল বাহনের স্বচ্ছ বো থেকে হাত নাড়ল পিট। মনে যদি কোনো ভয় বা উদ্বেগ থাকেও, চেহারা দেখে বোঝা যাচ্ছে না। টয়লেটের দরজায় এখনো পদাঘাত করছে অ্যাল, তবে বাতাসের গর্জনে আওয়াজটা চাপা পড়ে যাচ্ছে।
ফাইড, ফোর, থ্রী, টু, ওয়ান, ড্রপ!
হাইড্রলিক পাম্পের সাহায্যে অকস্মাৎ তুলে ফেলা হলো সামনের রেইল, পেছন দিকে পিছলে গেল বিগ বেন, ফাঁকের কিনারা দিয়ে খসে পড়ল প্লেন থেকে অন্ধকার শূন্যে। ত্রিশ টন ওজনের বিগ বেনকে চোখের পলকে ও সাবলীল ভঙ্গিতে অদৃশ্য হয়ে যেতে দেখলেন অ্যাডমিরাল, সতর্কভাবে ডেকের কিনারার দিকে এগোলেন তিনি, নিচের দিকে ঝুঁকে তাকালেন।
চাঁদের আলোয় ছুটন্ত একটা উল্কার মতো দেখা গেল প্রকাণ্ড ডীপ সী মাইনিং ভেসেল বিগ বেনকে।
.
৬৭.
প্রথমে তীরবেগে নামতে শুরু করল বিগ বেন, তারপর প্রকাণ্ড আকৃতির তিনটা ছাতা অর্থাৎ প্যারাসুট খুলে যেতেই নামার গতি মন্তর হয়ে পড়ল। ওপরদিকে তাকিয়ে স্বস্তিবোধ করল পিট, শ্বাস-প্রশ্বাস স্বাভাবিক হয়ে এলো। প্রথম বাধাটা পেছনে ফেলে এসেছেও। এবার নিরাপদে পানিতে পড়তে হবে, নেমে যেতে হবে তিনশো বিশ মিটার গভীর সাগরের তলায়, অখণ্ড ও অক্ষত অবস্থায়। অপারেশনের এ পর্যায়ে কিছুই ওর করার নেই, কাজেই যাত্রা উপভোগ করা যেতে পারে।