অবশেষে হোঁচট খেতে খেতে সিকার্গো ডেকের দোরগোড়ায় পৌঁছালেন তিনি। বহুরঙা অটোমোবাইলের একটা সাগর যেন সামনে ও পিছন দিকে একশো মিটার পর্যন্ত বিস্তৃত। বিস্ময়করই বলতে হবে, এত বড় একটা ঝড়ের মধ্যে পড়েও গাড়িগুলো স্থানচ্যুত হয়নি।
মিডগার্ড-এর নাম ধরে চিৎকার করলেন স্টিন, ইস্পাতের বাল্কহেডে ধাক্কা খেয়ে ফিরে এল তার কণ্ঠস্বর। কোন জবাব পেলেন না। তারপর ব্যাপারটা দেখতে পেলেন তিনি।
একটা গাড়ির হুড তোলা।
দীর্ঘ সারির মঝখান দিয়ে টলতে টলতে এগোলেন অসকার। দুপাশের গাড়ির দরজায় ও ফেন্ডারে ধাক্কা খাচ্ছেন, বেরিয়ে থাকা বাম্পারে লেগে ছিঁড়ে য চামড়া,। হুড খোলা গাড়িটার কাছাকাছি এসে চিৎকার করলেন আবার, এখানে কেউ আছ?
এবার তিনি অস্পষ্ট গোঙানির আওয়াজ শুনতে পেলেন। তাড়াতাড়ি এগোলেন তিনি, পৌঁছে গেলেন গাড়িটার কাছে। একটা টায়ারের পাশে মিডগার্ডকে পড়ে থাকতে দেখে দাঁড়িয়ে পড়লেন থমকে।
ভেজা ঘামে ভরে গেছে মিডগার্ডের মুখ। রক্ত মেশানো ফেরা বেরুচ্ছে মুখের ভেতর থেকে। চোখ দুটো ভোলা, কিন্তু দৃষ্টি নেই। চামড়ার নিচে রক্তক্ষরন হচ্ছে, ফলে হাত দুটো হয়ে উঠেছে লাল। দেশে মনে হলো চীফ অফিসারের চোখের সামনে গলে যাচ্ছে সে।
গাড়ির গায়ে হেলান দিয়ে স্থির হবার চেষ্টা করলেন অসকার, আতঙ্কে থরথর করে কাঁপছেন তিনি। অসহায় বোধ করছেন, হতাশায় মাথাটা দুহাতে চেপে ধরলেন। হাত দুটো যখন শরীরের দুপাশে নামিয়ে আনছেন, দেখলেন আঙুলে উঠে জানতে চাইলেন। ফিসফিস করে। মিডগার্ডের চেহারায় নিজের মৃত্যু দেখতে পেলেন তিনি। কিসে মারা যাচ্ছি আমরা?
.
০৩.
ইনভিনসিবল ব্রিটিশদের একটা ওশেনোগ্রাফিক জলযান। ওটার বিরাট ক্রেন থেকে ঝুলছে ডীপ-সী সাবমারসিবল ওল্ড গার্ট। সাগর এখন অনেকটাই শান্ত হয়ে এসেছে, কাজেই পাঁচ হাজার দুশো মিটার পানির নিচে, সাগরের তলায় বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধান চালাবার জন্যে সাবমারসিবলকে এবার নামানো যেতে পারে।
সাবমারসিবলটা নতুন। অত্যাধুনিক ডিজাইন, তৈরি করেছে একটা ব্রিটিশ অ্যারোস্পেস কোম্পানি। মেনডোসিনো ফ্র্যাকচার জোন সার্ভে করার জন্যে এই প্রথম ওটাকে সাগরের তলায় পাঠানো হচ্ছে। প্রশান্ত মহাসাগরের মেঝেতে বিশাল একটা ফাটল আছে, নর্থ ক্যারোলিন উপকূল থেকে জাপানের দিকে অর্ধেক পথ পর্যন্ত বিস্তৃত, এই ফাটলটারই নাম মেনডোসিনো।
অন্যান্য অ্যারোডাইনামিক সাবমারসিবলের ভেতরে চুরুট আকৃতির খোল থাকে, নিচে জোড়া লাগানো থাকে পেট ফোলা পড়, কিন্তু ওল্ড গার্টে রয়েছে ট্রান্সপারেন্ট টাইটেনিয়াম ও পলিমার দিয়ে তৈরি চারটে গম্বুজ, পরস্পরের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করছে গোলাকৃতি টানেল। একটা গম্বুজ জটিল ক্যামেরা ইকুইপমেন্টে ঠাসা, আরেকটায় রয়েছে এয়ার ব্যালাস্ট ট্রাঙ্ক ও ব্যাটারি। তৃতীয় গম্বুজে ভরা হয়েছে অক্সিজেন ইকুইপমেন্ট ও ইলেকট্রিক মোটর। চার নম্বর গম্বুজটা সবচেয়ে বড়, বাকি তিনটের উপরে বসে আছে, ক্রুরা সবাই এটাতেই থাকে। এই চার নম্বর থেকেই পরিচালিত হয় ওল্ড গার্ট।
দুনিয়ার গভীরতম সাগরতলে পানির চাপ অত্যন্ত বেশি, সে চাপ সহ্য করার মত করেই তৈরি করা হয়েছে ওল্ড গার্টকে। ওটার সাপোর্ট সিস্টেমের সাহায্য নিয়ে একজন ক্রু আটচল্লিশ ঘণ্টা বেঁচে থাকতে পারবে। অন্ধকার ও ভেজা অতল পাতালে আট নট গতিতে ছুটতে পারে ওটা।
ক্রেইগ প্লাঙ্কেট ওল্ড গার্ট-এর চীফ এঞ্জিনিয়ার ও পাইলট। সব কিছু চেক করে দেখার পর ফর্মে সই করলেন তিনি। পঞ্চাশ বছর বয়েস, টাক ঢাকার জন্যে কাঁচা পাকা চুলগুলো আড়াআড়িভাবে আচড়ানো। লালচে মুখ, প্রায় খয়েরি চোখ। ওল্ড গার্ট-এর ডিজাইন তৈরিতে সাহায্য করেছেন, ওটাকে এখন ব্যক্তিগত ইয়ট হিসেবে দেখেন তিনি। সাগরের তলায় খুব ঠাণ্ডা লাগবে, ভারী একটা উলেন সোয়েটার পরে নিলেন, পায়ে গলালেন একজোড়া নরম ফার দিয়ে কিনারা মোড়া মোকাসিন। বোর্ডিং টানেল থেকে নিচে নেমে বন্ধ করে দিলেন হ্যাঁচটা। এরপর চলে এলেন কন্ট্রোল গম্বুজে, বোতাম টিপে চালু করলেন। কমপিউটরাইজড লাইফ-সাপোর্ট সিস্টেম।
জিওলজিস্ট ড. রাউল স্যালাজার এরই মধ্যে নিজের সীটে বসে একটা বটম সোনার পেনিট্রেটিং ইউনিট অ্যাডজাস্ট করছেন। রেডি হোয়েন ইউ আর, প্লাঙ্কেটকে বললেন তিনি।
গম্বুজের ডানে খালি সীটের দিকে তাকালেন প্লাঙ্কেট। আমি ভেবেছিলাম স্টেসি চলে এসেছে।
এসেছে, বললেন রাউল স্যালাজার। ক্যামেরা রুমে, ভিডিও সিস্টেম চেক করে দেখছে।
ঝুঁকে টানেলের ভেতর তাকালেন প্লাঙ্কেট, ভেতরের গম্বুজে মোজা পরা একজোড়া মেয়েলি পা দেখতে পেলেন শুধু। বললেন, স্টেসি, আমরা তৈরি।
মিষ্টি একটা নারীকণ্ঠ ভেসে এল, আর এক সেকেন্ড, আমার হয়ে এসেছে।
নিজের কন্ট্রোল প্যানেলের নিচে পা দুটো লম্বা করে দিলেন প্লাঙ্কেট, এই সময় কন্ট্রোল গম্বুজে ফিরে এল স্টেসি ফক্স। মেঝের দিকে মাথা ঝুলিয়ে অনেকক্ষণ কাজ করেছে সে, ফর্সা মুখটা লালচে হয়ে আছে। তার রূপকে আগুন বলা যাবে না, তবে সুন্দরী বটে। সরল একরাশ সোনালি চুল মুখের চারপাশে ফুলে আছে, বারবার মাথা ঝাঁকিয়ে সরাতে হয়। রোগা-পাতলা গড়ন, মেয়ে অনুপাতে কাঁধ দুটো একটু বেশি চওড়া। ক্রুরা তার নিতম্ব ও স্তন সম্পর্কে শুধু কল্পনা করতে পারে, কারণ ওগুলোর আকার-আকৃতি সম্পর্কে তাদের কোন ধারণা নেই ভোলা সোয়েটার ও ঢোলা স্কার্ট পরে স্টেসি, নিজের শারীরিক সম্পদ আড়াল করে রাখার ব্যাপারে অত্যন্ত সতর্ক সে। তবে, মাঝে মধ্যে যখন সে হাই তোলে বা আড়মোড়া ভাঙে, বুকটা নিরেট ও ভরাট কিছু একটার আভাস দেয়।