ব্লাডি ইডিয়ট। নিজে যদি ক্ষমা চাইতে না পারে অন্তত এলিসের ফোন তো ধরতে পারে যেন সবকিছু আবার জোড়া লাগাবার সুযোগ সৃষ্টি করা যায়। তবে যদি না…মাথা ঝাঁকিয়ে চিন্তাটাকে দূর করে দিল।
উত্তেজিত এক ছাত্রের চিৎকার শুনে গভীর চিন্তা থেকে বাস্তবে ফিরে এল এলিস; উধশ্বাসে টানেল দিয়ে ছুটে আসছে ছেলেটা। ২০০০ বছরেরও বেশি সময় ধরে আড়ালে থাকা একটা সমাধি, যেটি কি-না হতে পারে শতকের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কার। এমন এক সমাধি যেটিকে নিয়ে গত ১৫০ বছর ধরে চলছে বিস্তর জল্পনা-কল্পনা। E-75 টোল রোড থেকে ৫০ কি. মি. ভেতরে থেসালোনিকিতে স্থাপিত এই টিমে গ্রিক আর আমেরিকান দুজন কো ডিরেক্টরের অধীনে প্রজেক্টের খনন কাজে সাহায্য করছে ৫০ জনেরও বেশি ছাত্র-ছাত্রীর কন্টিন্টে আর স্থানীয় শ্রমিকদের এক সেনাবাহিনি।
“এলিস, আমরা সমাধির প্রবেশ মুখ ভেঙে ফেলেছি!” ছেলেটার উত্তেজনা এলিসের মাঝেও সঞ্চারিত হল, “কাম অন, জলদি চলুন!” কোনোমতে শব্দগুলো উচ্চারণ করেই দুদ্দাড় সিঁড়ি বেয়ে আবার খোলা শ্যাফট দিয়ে নেমে গেল মাটির গহীনে।
উধাও হয়ে গেল বয়ফ্রেন্ডের চিন্তা। ব্যাকপ্যাক ঠিক করে ছাত্রের পিছু নিল এলিস। মনে পড়ে গেল আঠারো মাস আগে এই দলটাতে যোগ দেবার সময়কার একটা মুহূর্তের কথা।
ভাগ্যটাও এমনি যে, যখন নিমন্ত্রণটা পেল তখনই দেখা হয়েছে তার বয়ফ্রেন্ডের সাথে। সে সময় এমন একটা পরিস্থিতিতে পড়েছিল যা নিয়ে আর কথা বলতে চায় না ও। অবশেষে বহুকষ্টে শতবর্ষের পুরনো কোনো সিক্রেটের মতই নিজের অন্তরে মাটি চাপা দিয়েছে সেই বেদনা। এরকম এক মুহূর্তে বয়ফ্রেন্ডের কাছ থেকে সত্যিকারের সাপোর্ট পেয়ে যারপরনাই কৃতজ্ঞ এলিস। তারপর কয়েক মাস ডেট করার পরেই পেল এই খনন কাজের আমন্ত্রণ। অথচ আজ যখন প্রাচীন গ্রিসের সর্বশেষ মহারহস্যগুলোর একটির দ্বার উন্মোচন হতে যাচ্ছে তখন আর এলিসের পাশে সে নেই।
সমাধির দিকে যেতে যেতে স্মরণ করল বিলিওনিয়ার মানবদরদী কার্ট ওয়ালেসের কথা। প্রাচীন সভ্যতা আর প্রত্নতত্ত্ব নিয়ে গবেষণাকার্যে উৎসর্গকত সংস্থা ওয়ালেস অ্যার্কিওলজিক্যাল ট্রাস্টের মাধ্যমে তিনি এই খনন কাজের ফান্ডিং করেছেন। “ফরগটেন রুটস” নামক আন্দোলনের পেছনেও আছেন এই ভদ্রলোক। এক্ষেত্রে তার লেখা পাঁচটা বইয়ের উপর ভিত্তি করেই ট্রাস্ট বিবর্তন-মতবাদের বিরুদ্ধে এই অবস্থান নিয়েছে। বইগুলোর কমন থিম হল, মানবতা তার শেকড় ভুলে গিয়ে ক্রমশ বিবর্তনবাদের ভিত্তিতে নির্মিত এক ভয়ংকর থিওরির দিকে ঝুঁকে পড়ছে। অথচ মানবজাতির প্রকৃত উৎসবিন্দু লুকিয়ে আছে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে থাকা সংস্কৃতিগুলোর প্রাচীন লোকগাঁথার মাঝে।
এলিস ভদ্রলোকের কথা শুনেছে এবং তাঁর লেখাও পড়েছে। কিন্তু থিওরিগুলো নিয়ে কখনোই তেমন একটা মাথা ঘামায়নি। অথচ লোকটার সাথে দেখা হবার পর মুগ্ধ হয়ে গেছে তার বুদ্ধিমত্তা আর কেতাদুরস্ত পরিশীলিত আচরণ দেখে। তাছাড়া যেখানে মিটিং করেছে, সুদৃশ্য সেই রাজপ্রাসাদ তো যেন এলিসকে বশ করে ফেলেছে।
দশমিনিটের সেই মিটিংটাতে শুরুতেই কাজের কথা তুলেছিলেন ওয়ালেস। “দ্য গ্রেট আলেকজান্ডারের রাজত্বকাল আর তার মৃত্যু পূর্ব ও পরবর্তী সময়কাল নিয়ে তোমার দক্ষতার জন্যই এ দলে যোগদানের অনুরোধ করছি” শুরু করলেন বিলিওনিয়ার, এর আগেই অবশ্য সম্ভাষণের আনুষ্ঠানিকতা সেরে নাশতার প্রস্তাবও দিয়েছেন।
শুরুতেই এমন মন্তব্য শুনে কৌতূহলী হয়ে ওঠে এলিস। একদৃষ্টে তাকিয়ে দেখে গবেষণা কক্ষের জানালার কাছে দাঁড়িয়ে থাকা ওয়ালেসের লম্বা দেহাবয়ব, সুদর্শন স্যুট পরিহিত অভিজাত ভাব, কুঞ্চিত চেহারা আর মরচে রঙা চুল।
এলিস টোপ গিলেছে বুঝতে পেরে হাসলেন ওয়ালেস, “দেখো, ট্রাস্টে আমার রিসার্চ টিম প্রাচীন গ্রিসের সবচেয়ে মূল্যবান এক রহস্যের সূত্র পেয়েছে। আর এর সবকিছুই দ্য গ্রেট আলেকজান্ডারকে ঘিরে।”
তারপর ব্যাখ্যা করে শোনালেন মিশনের উদ্দেশ্য, প্রকৃতি ও দলের গঠন। শেষ করার আগেই প্রজেক্টে যোগদানের ব্যাপারে মনস্থির করে ফেলল এলিস।
“সাবধানে পা ফেলুন” আরো একবার তাকে গভীর চিন্তা থেকে ফিরিয়ে আনল সেই ছাত্র। এখান থেকে টানেলের ছাদ নিচু হয়ে গেছে।” শ্যাফটে নেমে টানেল ধরে পোর্টেবল ল্যাম্পের আলোর দিকে এগিয়ে চলল দুজন।
ছেলেটার হাতে ধরা টর্চ লাইটের আলোতে যত দ্রুত সম্ভব দৌড়ে অবশেষে পৌঁছে গেল মসৃণ পাথুরে দেয়াল-অলা একটা কিউব আকৃতির চেম্বারে। চেম্বারের দু-প্রান্তে জ্বলতে থাকা দুটো পোর্টেবল এলইডি পোল লাইটসের আলোয় আলোকিত হয়ে উঠেছে ছোট্ট জায়গাটা।
“থ্যাংক ইউ, মারকো।” ছেলেটা ফ্লাশলাইট অফ করতেই ওর দিকে তাকিয়ে হাসল এলিস।
চোখ পড়ল ড্যামনের দিকে। দলের আরেকজন অ্যার্কিওলজিস্ট; মাথায় কালো চুল আর বয়স মধ্য চল্লিশের কোঠায়। গত বারো মাস ধরে বিভিন্ন ঝড় ঝাঁপটা সহ্য করে খনন করা সমাধিমুখটার দিকে ইশারা করলেন।
চেম্বারে বিভিন্ন কন্টেইনারের স্তূপ দেখতে পেল এলিস। এগুলোতে ভরে বিভিন্ন আর্টিফ্যাক্ট খনি থেকে তুলে নিরাপদে পাঠিয়ে দেয়া হবে ল্যাবের উদ্দেশ্যে; যেখানে বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে বসানো হবে নির্দিষ্ট তারিখ। “এখান থেকে সবকিছু বাক্সে ভরে ফেলতে হবে?” খানিকটা অবাক হয়ে গেল এলিস। কারণ স্ট্যান্ডার্ড অ্যার্কিওলজিক্যাল প্রসিডিউর অনুযায়ী সাইট থেকে সরানোর আগেই প্রতিটা আর্টিফ্যাক্টের ছবি তুলে ট্যাগ লাগিয়ে, ম্যাপ আর মেজারমেন্টের কাজ করে সম্পূর্ণ বিবরণ লিখে রাখতে হয়।