তিনি যা ভাবছেন এই দুটো জার্নাল মিলে যদি তাই হয়ে থাকে তাহলে তো এই আবিষ্কার শুধুমাত্র হাজার বছরের পুরাতন কোনো অর্থহীন ডকুমেন্টস নয়।
ঝুঁকির মাঝে পড়তে যাচ্ছে পুরো পৃথিবীর ভবিষ্যৎ!!
একেবারে শেষ কপিটা উগরে দিল ফটোকপি মেশিন। তাড়াহুড়া করে কাগজগুলোকে একত্র করে স্টেপল করে রাখলেন অ্যাশফোর্ড। দুই সেট কপি একসাথে খামে পুরে কাঁপা কাঁপা হাতে লিখলেন প্রাপকের ঠিকানা। কিছুক্ষণ এমনভাবে তাকিয়ে রইলেন, যেন খতিয়ে দেখছেন নিজের কাজ।
তারপর আর্কিটেকচার ডিপার্টমেন্টের কলিগকে ডেকে ডাউন টাউনে ফেডেক্সের অফিসে পাঠিয়ে দিতে বললেন প্যাকেজটা। মিনিট পাঁচেকের মধ্যেই নিরাপদে গন্তব্যে পৌঁছে গেল প্যাকেজ।
কলিগ প্যাকেটটাকে নিয়ে বেরিয়ে যেতেই ধপ করে নিজের চেয়ারে বসে পড়লেন অ্যাশফোর্ড। জার্নালের বিষয়বস্তু সম্পর্কে জ্ঞাত শেষতম ব্যক্তিটি যেন তিনিই না হন সেজন্য সাধ্যমত চেষ্টা করেছেন। সাদাসিধে মানুষ হলেও তার দায়িত্ববোধ অত্যন্ত প্রখর। এরকম একটা অবস্থাতেও জার্নালগুলোকে বন্ধুর কাছে পাঠিয়ে দেবার কথা মাথাতেই আসেনি। এগুলো কলেজের সম্পত্তি আর তাই এখানেই থাকবে। ফলে একমাত্র সমাধান হিসেবে ফটোকপি করে পাঠিয়ে দিয়েছেন দূরে।
নিজের ভবিতব্য ভালোভাবেই জানেন অ্যাশফোর্ড। রহস্যময় সেই কলারের গলার স্বর শুনেই বুঝতে পেরেছেন যে, সে বাকবিতন্ডা পছন্দ করে না। নিজেকে বাঁচাবার কোনো ধারণা নেই। পালিয়ে যাবার কথা মাথায় এলেও কোথায় যাবেন? গত পঁয়ত্রিশ বছর ধরে এই কলেজই তার জীবন। ১৯৮৩ সালে ওয়াশিংটন ডিসিতে একটা কনফারেন্সে যোগদান ব্যতীত এই পুরো সময়ে একবারও ক্যাম্পাসের বাইরে যাননি। সে সময়েই তার একমাত্র বন্ধু, ভারত থেকে আগত সেই ইতিহাসবিদ প্রাচীন দলিল সংরক্ষণের বিষয়ে কনফারেন্সে বক্তব্য দিয়েছিলেন। তবে অবাক ব্যাপার হল দুজনে ঠিকই যোগাযোগ রেখেছেন। এই বন্ধুর কাছেই এইমাত্র ফটোকপিগুলো পাঠিয়েছেন অ্যাশফোর্ড।
যা ঘটবে ঘটুক ভেবে চোখ বন্ধ করে প্রার্থনা শুরু করলেন। ক্যাথলিক হিসেবে সমস্যা থেকে উত্তরণের জন্য এই একটি মাত্র পথই জানা আছে।
তবে একটু পরেই অফিসের দিকে এগিয়ে আসা পদশব্দ শুনে চোখ মেলে তাকালেন। রুমের ভেতরে ঢুকে দেয়ালের কাছে দাঁড়িয়ে গেল পাঁচজন লোক। জ্যাকেটের ফুলে উঠা কাঁধ দেখে বুঝতে পারলেন সবাই সশস্ত্র। কেবল মাঝখানের সেই লম্বা লোকটা ছাড়া। কয়লাকালে চোখ জোড়া আর চেহারার গভীর ভাব দেখে মনে হচ্ছে যেন কোনো দার্শনিক চিন্তায় মত্ত। তবে সে-ই যে এই দলের নেতা সে ব্যাপারে কোনো সন্দেহই নেই। অ্যাশফোর্ডের ডেস্কে প্যাপিরাসের ডকুমেন্টসগুলো দেখে ধক ধক করে জ্বলে উঠল লোকটার চোখ। “আহ, আমার জন্য তো দেখি একেবারে তৈরি করেই রেখে দিয়েছেন।” মনে হল প্রশংসা করছে কিন্তু চেহারার ব্যঙ্গ ভাবটা কাটলনা। ইশারা করতেই একজন এগিয়ে এসে খুব সাবধানে প্যাপিরাসগুলো তুলে নিয়ে চামড়ার ব্রিফকেসে ঢুকিয়ে ফেলল।
উদ্ধতভাবে তাকিয়ে রইলেন অ্যাশফোর্ড। তুরুপের তাস এখনো তার হাতে। যে জার্নাল দুটো ফটোকপি করেছেন সেগুলো নিরাপদেই ডেস্কের ড্রয়ারে শুয়ে আছে।
“আমার জন্য বোধহয় আপনার কাছে আরো কিছু আছে, তাই না?” জানতে চাইল লিডার।
“মানে? প্যাপিরাস ডকুমেন্টসগুলো তো দিয়েছি।” মনে মনে আশা করছেন নিজের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করা ছাড়াই সব শেষ করতে পারবেন। মিথ্যে বলাতে তিনি একেবারেই অভ্যস্ত নন।
“এই ডকুমেন্টসগুলোর সাথে আরো যে দুটো ইংরেজি জার্নাল পেয়েছেন?” তীক্ষ্ণ হয়ে উঠল লোকটার গলা। “আমাকে তো জানাতেও চান নি, তাই না? ভেবেছেন আমরাও জানি না।”
ঝুলে পড়ল অ্যাশফোর্ডের চোয়াল। ওরা কিভাবে জানে? উনি নিজে তো কাউকে বলেননি।
লিডার মাথা নাড়তেই হাত মুঠো পাকিয়ে এগিয়ে এলে এক সাগরেদ। গুভাটার আঘাতে নাক ভেঙে যাওয়ায়, ব্যথায় চিৎকার করে উঠলেন অ্যাশফোর্ড। মুখ বেয়ে গড়িয়ে পড়ল রক্ত।
“ডেস্ক খুঁজে দেখো।” আদেশ দিল লিডার। দ্রুত হাতে সব ড্রয়ার ঘেটে দেখল তিনজন। একজন জার্নালগুলো পেতেই ব্রিফকেসে ঢোকাবার আগে নেড়ে দেখাল।
সামনে ঝুঁকে একদৃষ্টে অ্যাশফোর্ডের দিকে তাকাল লিডার, “ডকু্যমন্টসগুলো নেয়ার পর আপনাকে খুন করার কথা ছিল; কিন্তু না, আমি সিদ্ধান্ত বদলেছি। আপনি আমাদের সাথে যাবেন। সাথে সাথেই হাওয়া হয়ে যাবেন। ঠিক ফুলার বুড়োটার মত। এখন আর মরণ কামনা করলেও কোনো লাভ হবে না।”
১. বর্তমান সময়
প্রথম দিন। গ্রিস, কারিনসের উত্তরে আর মারকিজিয়ালসের দক্ষিণে
কানে সেলফোন ধরে আছে এলিস। ওপ্রান্তের অন্তহীন রিং যেন আর শেষই হচ্ছে না। অনিচ্ছা সত্ত্বেও চেহারায় ফুটে উঠল হতাশা। এতগুলো কল করার পরেও ফোন না ধরাতে এখন অসম্ভব রাগ হচ্ছে।
নো আনস্যার!!
আরো একবার ফোন কেটে যেতেই বিরক্তিতে চুকচুক শব্দ করল এলিস। বুঝতে পারছে আর কোনো আশা নেই।
আমিই বা কেন এত কষ্ট করে ফোন করছি? কিসের এত ঠেকা আমার?
বিষণ্ণ ভঙ্গিতে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে ফোনটাকে পকেটে চালান করে দিল এলিস। লং ডিসট্যান্স সম্পর্ক টিকিয়ে রাখা আসলে অত সোজা না। গত বারো মাসের বেশিরভাগ সময় জুড়েই গ্রিক-আমেরিকান অ্যার্কিওলজিক্যাল মিশন অব- পিডনার হয়ে একটা আন্তর্জাতিক দলের সাথে এখানে ক্যাম্পিং করছে এলিস। মিশনের উদ্দেশ্য হল প্রাচীন গ্রিসের সবচেয়ে গুঢ় রহস্যগুলোর একটিকে পৃথিবীর সামনে তুলে ধরা। এর মূল্য হিসেবে ভাঙতে বসেছে ওর সম্পর্ক। সপ্তাহ দুই আগে অবস্থা বেশ খারাপ পর্যায়ে পৌঁছে গেছে। তখন থেকে ওর বয়ফ্রেন্ড আর একবারও কল করেনি এবং ওর ফোনও ধরেনি।