তাছাড়া অ্যান্টিগোনাসের সাথে যুদ্ধের আগেই ধ্বংস করে ফেলেছেন সমস্ত কাগজপত্র আর দলিল-দস্তাবেজ। “একপাল বন্য পশু” নামে নিন্দা করেছেন নিজ শাসনকর্তাদের দলকে। সিক্রেট জার্নালটাও এক বিশ্বস্ত দূতের মাধ্যমে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে ক্যাসান্ডারের হাত থেকে মেসিডোনিয়ান সিংহাসন বাঁচাতে ব্যস্ত আলেকজান্ডারের মাতা অলিম্পিয়াসের কাছে।
অ্যান্টিগোনাস তাই কিছুই পায়নি।
তৃপ্তির শ্বাস ফেললেন ইউমিনেস। যথাসাধ্য পালন করেছেন দিগ্বিজয়ী আলেকজান্ডারের প্রতি নিজ দায়িত্ব। অ্যান্টিগোনাস, টলেমি, ক্যাসাভার- আলেকজান্ডারের সাম্রাজ্য নিয়ে বিবাদে রত কেউই ইন্দাস ভূমির সেই মহারহস্য কখনোই জানতে পারবে না।
তেমনি জানতে পারবেনা বাকি দুনিয়া।
.
৩৯১ খ্রিস্টাব্দ
এক রহস্যের সমাধি
নির্জন গ্রামের রাস্তায় হেলেদুলে চলছে একটা খালি ওয়াগন। আধ ভাঙ্গা চাঁদের অস্পষ্ট আলোয় ফুটে উঠেছে ভ্রমণক্লান্তি। ঘোড়াটাও এমন দুলকি চালে এগোচ্ছে, যেন জেনেই গেছে যে শেষ হয়েছে মিশন। তাড়াহুড়া করার আর কোনো প্রয়োজন নেই। অথচ মাত্র তিনদিন আগেও বহু মূল্যবান এক সম্পদ বহন করেছে এই ওয়াগন। অত্যন্ত দামি সেই জিনিসটাকেই গত ৫০০ বছর ধরে হন্যে হয়ে খুঁজছে পৃথিবী।
নিরাপত্তার অভাব দেখা দিয়েছিল। মধ্যপ্রাচ্যে উদয় হওয়া এক নব ধর্ম খুব দ্রুত চারপাশে ছড়িয়ে পড়ছে। খ্রিস্ট নামে একজন মানুষের জীবন এবং মৃত্যুর উপর ভিত্তি করে মিশন অব্দি পৌঁছে গেছে, যেখানে ৫০০ বছরেরও বেশি সময় ধরে লুকিয়ে আছে সেই পুরাতাত্ত্বিক নিদর্শন। নব ধর্মমতাবলম্বীরা, যারা নেতাকে মনে করে ঈশ্বরের পুত্র আর তারই নামানুসারে নিজেদেরকে খ্রিস্টান নামে ডাকে তারা এবার পুরাতন দেবতাদের সম্পর্কে প্রশ্ন শুরু করেছে। ভেঙে ফেলছে মূর্তি, নষ্ট করছে প্রতিচিত্র আর ধ্বংস করে ফেলছে সব মন্দির।
আলেকজান্দ্রিয়ার সেই পবিত্র স্থানেও যেকোনো মুহূর্তে পৌঁছে যাবে এই ঢেউ, যেখানে গত পাঁচ শতক ধরে লুকিয়ে রাখা হয়েছে উপাসনার বস্তু।
তবে যেকোনো মূল্যেই একে রক্ষা করতে হবে। অর্ডার’ (গুপ্তসভা) নিজে থেকেই কাঁধে তুলে নিয়েছে এই দায়িত্ব। আলেকজান্দ্রিয়ার আদি বাসস্থান ছেড়ে, বর্তমানে খালি ওয়াগনের সমস্ত কিছুই অর্ডারের চিহ্ন সম্বলিত নৌকা, জাহাজ, গরুর গাড়ি আর ওয়াগনে ভরে বিভিন্ন নদী আর সমুদ্র পার করে রেখে আসা হয়েছে।
অর্ডারের সেই চিহ্নটা হলো, ঠিক যেন ছোবল মারার জন্য ফণা তুলেছে পাঁচ মাথাঅলা একটা সাপ।
যাত্রাপথে সম্পদের উপর থেকে কৌতূহলী চোখগুলোকে দূরে সরিয়ে রেখেছে এই চিহ্ন। সবাই আসলে একে ভয় পায়। অত্যন্ত গোপনীয় এই অর্ডার সম্পর্কে কেউই কিছু জানে না, এর উৎপত্তি কিংবা সদস্য সম্পর্কেও কারো কোনো ধারণা নেই-তবে এর কাজকর্ম কারো অজানা নয়।
অবশেষে দায়িত্ব সম্পন্ন করে খালি ওয়াগন নিয়ে মরুভূমির দিকে ফিরে যাচ্ছে এর ড্রাইভার কারমাল। তবে শেষ আরেকবারের জন্য থামতে হবে।
নিস্তব্ধ একটা গ্রামের মধ্য দিয়ে এগোচ্ছে ওয়াগন। ঘুমে অচেতন পুরো গ্রাম। আবার ওয়াগনের পাশে আঁকা সর্প চিহ্নের জন্যও এমনটা হওয়া অসম্ভব কিছু না।
এবার বিশাল একটা বাড়ির সীমানা প্রাচীরের কাছে এসে খোলা গেইট দিয়ে ভেতরে ঢুকে পড়ল ওয়াগন; যেন কারমালের আগমনের জন্যই অপেক্ষা করছিল। ড্রাইভওয়ের একেবারে শেষ মাথায় দাঁড়িয়ে আছে ইট আর পাথরের তৈরি বহুতল একটা কাঠামো।
সদর দরজার সামনে ওয়াগন থামিয়ে লাফ দিয়ে নামল কারমাল। খুব বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হল না। খুলে গেল দরজা। দেখা দিল ক্লোক (আলখেল্লা) পরিহিত, মাথা ঢাকা, লম্বা এক লোক।
“কাজ সমাধা হয়েছে?” ভারী স্বরে জানতে চাইলেন মাথা ঢাকা আগন্তুক।
মাথা নাড়ল কারমাল। দীর্ঘ এই ভ্রমণে অত্যন্ত ক্লান্ত হয়ে পড়েছে।
“গুড। এখন কী করতে হবে তাও নিশ্চয় জানো।” চলে যাবার জন্য ঘুরে দাঁড়ালেন আগন্তুক।
“একটু দাঁড়ান” হাত বাড়িয়ে দিল কারমাল।
অবাক হয়ে তাকালেন ঘোমটা টানা লোকটা, “কী হয়েছে?”
“এটা রাখুন।” লোকটার হাতে কিছু একটা দিয়েই ওয়াগনে ফিরে গেল কারমাল। আরেকটা কাজ বাকি আছে এখনো।
গেইট দিয়ে ওয়াগন অদৃশ্য না হওয়া পর্যন্ত কারমালের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে রইলেন লম্বা আগন্তুক। শক্ত হাতে ধরে রেখেছেন কামালের দেয়া ধাতব জিনিসটা। ত্রস্তপায়ে বাসায় ঢুকে ফেলে দিলেন মাথার কাপড়। দেখা গেল কোটরে বসা চোখ আর পাতলা ঠোঁটের এক কৃশকায় মুখাবয়ব।
মুঠো খুলে হাতের তালুয় ধরা ছোট্ট তামার ক্যাপসুলটার দিকে তাকালেন। তারপর আবার হাত মুঠো করে একের পর এক সিঁড়ি বেয়ে চলে এলেন দোতলার গবেষণা কক্ষে।
দরজা আটকে ধপ করে ডেস্কে বসতেই মুখখানা ফ্যাকাসে হয়ে কাঁপতে লাগল আঙুল।
বোকা কারমালটা করেছে কী?
জানেন যে কারমাল অর্ডারের বাইরে কিছু করবে না। আরো কয়েক মাইল বিশ্বস্তভাবে ওয়াগন চালিয়ে গিয়ে মরুভূমির মাঝে ঘোড়াকে ছেড়ে দিয়ে কেটে ফেলবে নিজের গলা। কারণ রেলিকের (পুরাতাত্ত্বিক নিদর্শন) অবস্থান কাউকেই জানানো যাবে না। অর্ডারের আদেশ হল চিরতরে লোকচক্ষুর অন্তরালে লুকিয়ে ফেলতে হবে এই রেলিক।
ছুরি দিয়ে খুব সাবধানে ক্যাপসুলের একপ্রান্তের ক্যাপটা আলগা করতেই ডেস্কের উপর গড়িয়ে পড়ল পাতলা একটা ভেড়ার চামড়ার টুকরো। গুঙ্গিয়ে উঠলেন কৃশকায় লোকটা। না দেখেই বলে দিতে পারবেন এটা একটা ম্যাপ।