.
৮. জোনগড় কেল্লা
নিজের রুমে বসে একদৃষ্টে মোবাইল ফোনের দিকে তাকিয়ে আছে কলিন। এগারো বছর ধরে মেয়েটার সাথে কোনো যোগাযোগ ছিল না। ব্রেকআপের পর ওর কোনো ইমেইলের উত্তরও দেয়নি মেয়েটা। যদিও এতে তেমন অবাক হবার মত কিছু ছিল না। কারণ প্রাক্তন বয়ফ্রেন্ডের সাথে সে কোনো সম্পর্কই রাখতে চায়নি। অথচ আজ কিনা নিজেই কলিনকে ফোন করেছে। কী এমন ঘটল যে এত বছর পরে ওর মাইন্ড চেঞ্জ হয়ে গেল?
নাম্বার দেখে প্রথমেই মনে হয়েছে যে ফোনটা রিসিভ করবে। কিন্তু পুরনো কথা মনে পড়ে যাওয়ায় দ্বিধায় পড়ে গেল। ভয়ও পেল। যদি মেয়েটা সত্যিই ভাঙ্গা সম্পর্ক জোড়া লাগাতে চায়, অবস্থা তাহলে আরো জটিল হয়ে যাবে।
যাইহোক। যা আছে কপালে ভেবে লম্বা একটা দম নিয়ে কলটা রিসিভ করল কলিন।
.
টানেলের শেষ মাথায় আশার আলো
“এলিস?” কলিনের কণ্ঠস্বর আর কখনো এতটা মধুর লাগেনি।
‘কলিন! আমি…আসলে আর কাকে ফোন করব বুঝতে পারছিলাম না।” হঠাৎ করেই কেঁপে উঠল গলা। সাথে খানিকটা স্বস্তিও পেল। কারণ জানে যে হাজার মাইল দূরে ইউএসে বসে থাকা কলিন এ মুহূর্তে তার কোনো কাজেই আসবে না।
“হেই, কী হয়েছে? কোনো সমস্যা? মনে হচ্ছে কলিনও বেশ চিন্তায় পড়ে গেছে। এলিসের উদ্বেগ ধরতে পেরে জানতে চাইল, “তুমি ঠিক আছে তো?”
আতঙ্ক আর অপরাধবোধে জর্জরিত এলিস খুলে বলল গত রাতের ঘটনা। একেবারে সমাধিতে ঢোকা থেকে শুরু করে এখন হাইওয়েতে ছুটে বেড়ানো। পর্যন্ত সবকিছু।
শোনার পর কিছুক্ষণ নীবর থেকে অবশেষে কলিন বলল, “থেসালোনিকিতে মিশনের আর কেউ নেই যার কাছ থেকে সাহায্য পেতে পারো?”
“কাকে যে বিশ্বাস করব আমি জানি না কলিন। যদি সত্যিই স্ট্যাভরস আর পিটারই এসবের কারণ হয় তাহলে অন্যেরা যে সাধু তা তো নিশ্চিত নই। আর আমার মনে হচ্ছে ড্যামনও এটার অংশ ছিল। “নির্দেশ পালন না করাতেই খুন হয়েছে। পিটার তো তাই বললছে।”
“ওকে। তাহলে বলব বিকল্প রাস্তা ধরে থেসালোনিকিতে ঢোকার তোমার আইডিয়াটাই ভালো। ওরা নিশ্চয় এটা আশা করছে না। সোজা কনস্যুলেটে চলে যাও। আমি এখন ভারতে আছি। তবে ইউএসএতে কয়েকটা ফোন করে দিচ্ছি। আশা করছি তোমার জন্য কিছু একটা সাহায্যের ব্যবস্থা হয়ে যাবে।”
“তুমি ভারতে কী করছ?”
খুব বেশি ব্যাখ্যায় না গিয়ে শুধু আঙ্কেলের কাছ থেকে বিজয়ের কেল্লা পাবার কথা জানাল কলিন। “ওহ, আচ্ছা। থ্যাংকস, কলিন, এতসব কিছু হয়ে যাবার পরে তুমি সাহায্য…”
“আরে ধুর বাদ দাও। এ কারণেই তো বন্ধুরা। সম্পর্ক থাকা না থাকা কোনো ব্যাপার না।” তারপর একটু দ্বিধাজড়িত স্বরে জানতে চাইল, “বিজয়কে কিছু জানাবো?”
“উমমম…না, থাক। এখন না। ওর কেমন প্রতিক্রিয়া হবে আমি জানি না।”
“টেক কেয়ার। পরে আবার কথা হবে।”
ফোন কেটে দিল।
ইঞ্জিন স্টার্ট করল এলিস। সামনে এগোল গাড়ি। কিন্তু এক কি. মি.ও যেতে পারল না। তার আগেই বেজে উঠল মোবাইল।
ছোঁ মেরে তুলেই স্ক্রিনের দিকে তাকাল। ওয়ালেস নয় তো?
“এলিস?”
“মিঃ ওয়ালেস!” কত যে স্বস্তি পেল যা বলে বোঝানো যাবে না।
“শুনলাম তোমার নাকি আর্জেন্ট সাহায্য দরকার।” ওয়ালেস সত্যিই উদ্বেগে আছেন।
বুক খালি করে সব কথা বলে দিল এলিস। এখনো বিশ্বাস হচ্ছে না গত এক ঘণ্টায় এতকিছু ঘটে গেছে।
সবকিছু শোনার পর নীরব হয়ে গেলেন ওয়ালেস। তারপর আবার যখন কথা বলা শুরু করলেন কণ্ঠে বেশ কর্তৃত্বের ভাব টের পাওয়া গেল, “তোমার কথানুযায়ী জিপিএস দেখাচ্ছে আর আধ ঘণ্টা গেলেই ইউএস কনস্যুলেট। তার মানে কাজ করার জন্য যথেষ্ট সময় আছে হাতে।” ভদ্রলোকের গলার স্বর বেশ বিনয়ী। অন্য সময় হলে হয়ত অতি উৎসাহী মনে হত; কিন্তু এখনকার পরিস্থিতিতে জীবিত উদ্ধারের জন্য ওয়ালেসই সবচেয়ে ভাল অপশন। “ডোন্ট ওরি, মাই ডিয়ার। কথা দিচ্ছি, তোমার আর কোনো ভয় নেই। গাড়ি চালাতে থাকো। দশ মিনিটের মাঝেই আরেকটা ফোন পাবে। কনস্যুলেটে পৌঁছেই। আমাকে ফোন দিও। এখন রাখছি।”
ওয়ালেস ফোন কেটে দিতেই বিড়বিড় করে থ্যাংকস জানাল এলিস। আজ রাতে প্রথমবারের মত খেয়াল করল যে হাইওয়েতে আর কেউ নেই। এতক্ষণ পর্যন্ত আর কোনো গাড়ি চোখে পড়েনি। কেমন যেন অদ্ভুত ঠেকল পুরো ব্যাপারটা।
ওয়ালেসের সাথে কথা বলার পর থেকে শান্ত হয়ে গেছে ভেতরটা। তাই শক্ত হাতে স্টিয়ারিং ধরল এলিস। এস্কিওস নদী পার হতেই বেজে উঠল ফোন।
“মিস টার্নার? আমি থেসালোনিকির জেনারেল পুলিশ ডিরেক্টরেট থেকে ফোন করছি।” কানের কাছে কথা বলে উঠল এক ভারী গ্রিক কণ্ঠ।
মনে হল হার্ট না ফেইল হয়ে যায়। সত্যিই শুনছে তো? ওয়ালেস এরই মাঝে লোকাল পুলিশকেও ফোন করে দিয়েছেন! “ইয়েস” বিস্ময় চাপতে গিয়ে তোতলাতে লাগল এলিস।
লাইনের ওপাশে থাকা পুলিশ অফিসার খুব দ্রুত হড়বড় করে বলে দিল পুরো প্ল্যান। নিয়া ডিটিকি ইসিদোসের ইন্টারসেকশনে মোটর সাইকেল আরোহী তিন পুলিশ ওর সাথে দেখা করে আমেরিকান কনস্যুলেট নয়, বরঞ্চ এমন এক হোটেলে নিয়ে যাবে যেখানে রুম আর লবিতে সশস্ত্র পাহারা থাকবে। থেসালোনিকি থেকে সরাসরি ইউএসে যাবার কাগজপত্র তৈরি করে কনস্যুলেট ওর সাথে হোটেলেই যোগাযোগ করবে।
কী বলবে বুঝতে পারছে না এলিস। এতক্ষণ আতঙ্কে প্রায় অবশ হয়েছিল হাত-পা-মাথা। মনে হচ্ছে খটখটে খরার মাঝে শুরু হল বর্ষা। ফোন কাটার আগে তাই পুলিশসদস্যকে বহুবার ধন্যবাদ জানাল। আবারো গাড়ি থামিয়ে নেমে এলো রাস্তায়। হাঁটু ভেঙে বসে চিৎকার করে কেঁদে উঠল। তবে এবার আর ভয়ে নয় বরঞ্চ স্বস্তির জল এসে ভাসিয়ে নিয়ে গেল সারা দেহ। জানে এখন আর কোনো চিন্তা নেই।