তার মানে ছেলেটা জেগে আছে। ইচ্ছে করে ফোন ধরছে না বুঝতে পেরে দ্বিগুণ হয়ে গেল কষ্ট। জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে দুলছে এরকম একটা মুহূর্তে যে কিনা ওর পাশে থাকার কথা ছিল সে-ই হঠাৎ করে নাই হয়ে গেল! বুকের মাঝে উথলে উঠল কান্না। বহুকষ্টে নিজেকে সামলাল এলিস।
জয়ী হতে হলে ওকে শক্ত হতেই হবে।
আরেকটা নাম স্মরণ হতেই তাড়াতাড়ি নাম্বার ডায়াল করল। এবার কোন মোবাইল নয়, ল্যান্ডলাইন নাম্বার। কার্ট ওয়ালেসের পার্সোনাল সেল ফোনের নাম্বার পাবার মত ঘনিষ্ঠতা এখনো হয় নি।
দুটো রিংয়ের পরেই উত্তর দিল এক মহিলা কণ্ঠ।
“মিঃ ওয়ালেসের অফিস। আমি আপনাকে কিভাবে সাহায্য করতে পারি?” ক্লারা, ওয়ালেসের অ্যাসিস্ট্যান্ট।
এত ধরনের অভিজ্ঞতা হওয়ায় কেঁপে উঠল এলিসের গলা, “আমি মিঃ ওয়ালেসের সাথে কথা বলতে চাই প্লিজ, ব্যাপারটা খুব আর্জেন্ট।”
“মিঃ ওয়ালেস একটা মিটিং করছেন আর তাই এখন উনাকে বিরক্ত করা। যাবে না।”
‘ব্যাপারটা সত্যিই জীবন আর মৃত্যুর সাথে জড়িত। প্লিজ, আমাকে ব্যবস্থা করে দিন।” আকুতি জানালেও ভয়ে ঠাণ্ডা হয়ে গেল এলিসের অন্তর। শেষ খড়কুটোটাও হারিয়ে গেল।
“আপনার নাম আর ফোন নাম্বার বলুন, মিঃ ওয়ালেস ফ্রি হবার সাথে সাথে কল ব্যাক করবেন।”
মনে হল হাতুড়ির বাড়ি খেয়েছে। এখন থেকে সে একেবারেই একা। আর কারো কাছ থেকে সাহায্যের আশা নেই।
.
৭. থেসালোনিকির কাছে E-75, গ্রিস
ক্লারার কথাগুলো শুনে যেন পাথরের মূর্তি হয়ে গেল এলিস। তারপর মনে হল আচ্ছা যদি সবকিছু খুলে বলে…”।
“আমার নাম এলিস টার্নার। মিঃ ওয়ালেস গ্রিসে যে মিশন ফান্ড করেছেন সেখানে আমিও আছি। প্লিজ… প্লিজ উনাকে জানান যে সমাধিটা ধ্বংস হয়ে গেছে। দলের সদস্যদের দুজন খুন হয়েছে আর আমার পেছনেও লোক লেগেছে। আমি…আমি অনেক ভয় পাচ্ছি।” ফোঁপাতে ফোঁপাতে কোনোরকমে শেষ করল এলিস।
নরম হল ক্লারার কণ্ঠস্বর। “মিস টার্নার আপনার অবস্থার কথা শুনে আমি সত্যিই দুঃখিত। আমি এক্ষুনি মিঃ ওয়ালেসকে মেসেজ পাঠিয়ে দিচ্ছি। তবে দুর্ভাগ্যের বিষয় হল যে তিনি পার্সোনাল মোবাইল ফোন ব্যবহার করেননা। তাই আমার খানিকটা সময় লাগবে। আর আপনাকে অনুরোধ করছি ইনকামিং কলের জন্য ফোনটাকে বার বার চেক করবেন।”
মাথা নেড়ে ক্লারাকে থ্যাংকস জানাল এলিস। তারপর চোখ মুছে আবার ড্রাইভারের সিটে চড়ে বসল। ও এখন সম্পূর্ণ একা। শুধু যদি ওয়ালেস ফোন করে কোনো সাহায্যের আশা দেয়!
কিন্তু তার আগ পর্যন্ত নিজের বুদ্ধিতেই পথ চলতে হবে। আতঙ্কিত হয়ে কোনো লাভ নেই। পরিষ্কার মাথা নিয়ে ভাবতে হবে পরবর্তী কর্মপন্থা।
দ্য ইউ এস কনস্যুলেট। হ্যাঁ, এখন সেটাই ওর লক্ষ্য।
ল্যান্ড ক্রুজারের জিপিএস সিস্টেমে কনস্যুলেটের কো-অর্ডিনেট সেট করে মনোযোগ দিল সামনের দিকে।
“ইন্টারেস্টিং” জিপিএস রুট দেখে আপন মনেই বিড়বিড় করে উঠল এলিস। খানিক আগেই পার হয়ে এসেছে E-75 এর সাথে এসে মিশে যাওয়া A2 মোটরওয়ে। আবার কিছুক্ষণ গেলেই এক্সিওস ইন্টারচেঞ্জ যা থেসালোনিকি পর্যন্ত চলে গেছে। গালিকস ব্রিজ থেকে কয়েক মাইল সামনে A2 মিশে গেছে। নিয়া ডিটিকি ইসিদোসের সাথে যা নিয়ে যাবে নাভারচো কোনটুরিওটো’র দিকে; যেখানে থেকে আবার কিছুদূর এগিয়ে বামদিকে মোড় নিলেই তিমিস্কি। জিপিএস তো তাই বলছে।
কিন্তু যেটা বেশি মনোযোগ কেড়েছে তা হল, বিকল্প দুটো রাস্তা। প্রথম রাস্তাটা নিয়া ডিটিকি ইসিদোস থেকে ২৬ অক্টোভ্রিরু পর্যন্ত গিয়ে জংশনে মিশেছে যেখান থেকে নাভারচো যাওয়া যাবে।
কিন্তু এই রাস্তাগুলো ওর কাজে লাগবে না। যতটুকু মনে হচ্ছে জংশনে ওর আশায় ওঁৎ পেতে বসে আছে সশস্ত্র লোকগুলো।
দ্বিতীয় বিকল্প রাস্তাটাকে তাই মনে ধরল। ২৬ অক্টোভিরুতে না গিয়ে এলিস যদি নেক্সট এক্সিট দিয়ে মোটরওয়ের পাতাল হয়ে ২৮ অক্টোভিরু পর্যন্ত যায় তাহলে খানিক পরেই মোনাসট্রিরিউতে টার্ন নিয়ে ইগনাশিয়া আর তারপর ডানদিকে গেলেই তিমিস্কি পৌঁছে যাবে।
হুম, তাহলে এই রাস্তাতেই যাবে বলে মনস্থির করে ফেলল। পুরোটাই একটা বাজি বলা যায়। কোনো গ্যারান্টি নেই যে অন্যেরা এ রাস্তা দেখবে না। কিন্তু ওর হাতে তো তেমন আর অপশনও নেই।
গাড়িতে উঠতেই মাথায় এলো আরেকটা নাম। যার উপর ভরসা করা যায়। অন্তত তাই মনে হচ্ছে। ওর কলেজের বয়ফ্রেন্ড। বেস্ট রিলেশনশিপগুলোর একটা। কিন্তু বহুদিন কোনো যোগাযোগ নেই। যদিও ছেলেটা কয়েকবার ফোন করেছে, মাঝে মাঝে ইমেইলও পাঠিয়েছে; কিন্তু এলিস উত্তর দেবার প্রয়োজন মনে করে নি। আর কোনো আশা নেই ভেবে ক্ষান্ত দিয়েছে বেচারা।
এমনভাবে সম্পর্কটা শেষ হয়েছিল যে তাতেও খানিকটা বিরক্ত ছিল এলিস। সবসময় ভাবত সম্পর্কটা বুঝি টিকবে। বিয়ে করে দুজনে সারাজীবন একসাথে থাকবে। কিন্তু নাহ, সেরকম কিছু তো হয় নি।
আজ এরকম একটা সমস্যার মাঝে একাকী হয়ে মন চাইছে কারো সাথে কথা বলতে। প্রাক্তন বয়ফ্রেন্ড ছাড়া এক্ষেত্রে আর কেউ নেই। এত বছর পরে এমনটা করা উচিত হবে কিনা তাও জানে না। কেন ওর নামটাই মনে পড়ল সেটাও বুঝছে না। সমস্ত বন্ধন ছিন্ন করে দিয়েছে সেই ব্রেকআপ।
কিছুক্ষণ তাই কন্ট্রাক্ট লিস্টের আরো কয়েকটা নাম ভেবে দেখল। তারপর কী মনে হতেই দ্রুত হাতে ডায়াল করল নাম্বার। কাম অন, ফোনটা ধরো। এমন না যে এলিসের নাম্বার চিনবে না। যদি না অবশ্য ডিলিট করে দেয়। এত বছর পরে সেটার সম্ভাবনাও কম নয়।