কথাগুলো কলিনও মেনে নিল। জানে বিজয় সত্যি কথাই বলছে; কিন্তু তারপরেও স্বীকার করতে মন চাইছে না। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বলল, চলো ঘরে যাই” এখনো ঘোঘোৎ করছে, “শুধু রাতের বেলা প্যাটারসন ব্যাটাকে নিয়ে দুঃস্বপ্ন না দেখলেই হয়।”
.
৬. সাহায্যের জন্য আকুতি
হেলিকপ্টারের পাইলট মাঝ রাস্তায় চলে আসতেই ডানদিকে গাড়ি নিয়ে জোরে এক্সিলারেটর চেপে ধরল এলিস। মনোযোগ কেবল হেলিকপ্টারের নাক আর হাইওয়ের সীমানার মাঝখানের ছোট্ট গ্যাপটার দিকে। রাস্তার কিনারে পৌঁছাতেই গাড়ির গতি বেড়ে গেল।
স্তম্ভিত পাইলটের পাশ দিয়ে হুশ করে পার হয়ে আসতেই এসইউভি-র পেছনে দৌড় লাগালো লোকটা। অন্যদিকে এলিস প্রাণপণে প্রার্থনা করছে যেন তার ফন্দিটা কাজে লাগে। গ্যাপটা সত্যিই এতটা চওড়া তো?
পর মুহূর্তেই ল্যান্ড ক্রুজারের দুপাশে ধাতব কিছুর ঘষা খাওয়ার শব্দে ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে গেল রাতের নীরবতা। গাড়ির একপাশে হেলিকপ্টার অন্যপাশে হাইওয়ের রেলিং।
দীর্ঘ একটা মুহূর্তের জন্য যেন থেমে গেল সময়। হেলিকপ্টার আর রেলিং এস ইউ ভি’কে চেপে ধরে গোলাগুলি থেকে বেঁচে যাওয়া অক্ষত জানালাগুলোকেও চুরমার করে দিল।
দু’চোখ বন্ধ করে ইচ্ছেশক্তির জোরে গাড়ি ছোটাল এলিস। তীক্ষ্ণ আর কর্কশ শব্দের চোটে মাথা ছিঁড়ে যাবার জোগাড়।
হঠাৎ করেই লাফ দিয়ে আগে বাড়ল ল্যান্ডক্রুজার। মুক্ত হয়েছে দুপাশের ধাতব বাঁধন থেকে। চমকে গিয়ে তাকাতেই দেখল যে সামনে বিছিয়ে আছে দিগন্ত বিস্তৃত হাইওয়ে।
নতুন উদ্যমে ফিরে এলো আশা। এক্সিলারেটরকে মেঝের সাথেই গেঁথে ফেলল। যেন হেলিকপ্টার থেকে যত দূরে সম্ভব সরে যাওয়া যায়।
পেছনে, এস ইউ ভি-র কাঁচবিহীন জানালা দিয়ে ভেসে আসছে পাইলটের শাপ-শাপান্ত; তাড়াতাড়ি তাই গুলির আশঙ্কায় সিটের উপর কুঁজো হয়ে বসে গেল। আর ঠিক সাথে সাথেই মাথার আশপাশ দিয়ে শিস কেটে বেরিয়ে গেল বুলেট। সামনের উইন্ডস্ক্রিনে দেখা গেল মাকড়সার জালের মতন রূপালি ফাটল।
কোনো মতে ড্রাইভ করলেও জানে যে এরকম অস্পষ্ট উইন্ডস্ক্রিন নিয়ে বেশি জোরে গাড়ি চালাতে পারবে না। আবারো ফিরে এলো হতাশা। গতি কিছুটা কমিয়ে মনোযোগ দিল রাস্তার দিকে।
প্রতি মুহূর্তেই মনে হচ্ছে এই বুঝি হেলিকপ্টারের শব্দ শোনা যাবে। কিন্তু নাহ, একের পর এক মিনিট কেটে যাচ্ছে। ভাঙ্গা জানালা দিয়ে এস ইউ ভি-র কেবিনে বয়ে যাওয়া বাতাস আর ইঞ্জিনের গর্জন ছাড়া আর কিছু কানে আসছে না। গাড়ির সাথে সংঘর্ষে হেলিকপ্টারটার কোনো ক্ষতি হল, নাকি পাইলটই হাল ছেড়ে দিল কে জানে।
মাথার মধ্যে আবার ঘুরপাক খেতে লাগল গতরাতের রহস্যময় ঘটনাগুলো। প্রথমে তো ভেবেছিল হয়ত কোনো অ্যান্টিক চোরাচালানকারী মাফিয়া দল হামলা করেছে। ছবি তোলার কথা শুনে ক্ষিপ্ত হয়ে উঠার কারণও বোধহয় তাই। কেননা এতে করে কালো বাজারে দাম কমে যাবার সম্ভাবনা আছে। বিশেষ করে সমাধিটা যখন এতটাই বিখ্যাত।
কিন্তু তাতে করে তো পুরো সমাধিটাকে উড়িয়ে দেবার রহস্যের কিনারা হচ্ছে না। কোনো যুক্তিই মাথায় আসছে না। দুই হাজার বছরের পুরনো একটা সমাধি ধ্বংস করে কার কী লাভ হল?
গাড়ি এখন লুডিয়াস নদীর উপরে। কিছুক্ষণের মধ্যেই থেসালোনিকি পৌঁছে যাবে। তাই যা ঘটে গেছে তার চিন্তা বাদ দিয়ে সামনে কী আছে সেটা নিয়েই ভাবার মনস্থির করল।
পাইলট যদি স্ট্যাভরস আর পিটারের সাথে জড়িত হয় তাহলে নিশ্চয় থেসালোনিকিতেও তাদের আরো সাগরেদ আছে। একারণেই এলিসের পিছু ধাওয়া বন্ধ করে ওদেরকেই ফোন করে তৈরি করে রাখাটা বেশি সহজ মনে করেছে। তার মানে ওর বিপদ এখনো খাড়া হয়ে ঝুলছে।
এসইউভি থামিয়ে বাইরে বের হয়ে এলে এলিস। কিছুতেই কান্না আটকাতে পারছে না। কিন্তু নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতেই হবে। মারকো মারা গেছে। ড্যামনও। ওকে অন্তত জীবিত থাকতে হবে। রেইলের ধারে দাঁড়িয়ে সমানে ঘুষি মারতে লাগল। যেন ব্যথার সাথে ঝরে পড়বে হতাশা। মারকো আর তার অপ্রয়োজনীয় মৃত্যুর কথা মনে পড়ল। এত তাড়াতাড়ি কেন ছেলেটার ভাগ্যটা এমন হল?
অশ্রুমাখা মুখ তুলে আকাশের দিকে তাকাতেই চোখে পড়ল অসংখ্য তারা। নাহ, কেউ তাকে সান্ত্বনা দিতে পারবে না এখন।
শক্ত করে ব্রিজের রেইল আঁকড়ে ধরে ঠাণ্ডা মাথায় সবকিছু ভাবতে চাইল। থেসালোনিকিতে একটা ইউ এস কনস্যুলেট আছে। ওখানে যেতে হবে। একমাত্র ওই জায়গাতেই হয়ত সত্যিকারের নিরাপত্তা পাবে। হোটেলে পাসপোর্টটা ফেলে এলেও ড্রাইভিং লাইসেন্স সাথে আছে। ফলে আইডেনটিটি প্রমাণ করে আশ্রয় চাইতে কোনো কষ্টই হবেনা।
মোবাইল ফোন বের করে কনস্যুলেটের ঠিকানা দেখে নিল। ৪৩ তিমিস্কি স্ট্রিট। যাক, খানিকটা সাহস পাওয়া গেল।
এবার মনে হল কাউকে ফোন করে সাহায্য চাওয়া যায়।
ওর বয়ফ্রেন্ড। কিন্তু কেন যেন দ্বিধা হচ্ছে। ছেলেটা কি আদৌ তার বয়ফ্রেন্ড আছে? জানার কোনো উপায় নেই। তারপরও ও-ই ভরসা। আরো কয়েকজন বন্ধু থাকলেও বিশ্বাস করার মত কেউ নেই।
নাম্বার ডায়াল করল। বরাবরের মতই কয়েকবার রিং বেজেই ডিসকানেক্ট হয়ে গেল। সময়ের দিকে খেয়াল করতেই মনে হল এখন তো স্টেটসে ভোর। দ্বিতীয়বারের চেষ্টাতেও ফলাফল একই। কয়েকটা রিং বাজার পরেই বিজি টোন শোনা যাচ্ছে। ব্যাকুল হৃদয়ে ফোনের স্ক্রিনে তাকাতেই চোখ পড়ল মেসেজ। ওকে জানাল যে নাম্বারে চেষ্টা করছে তা এখন ব্যস্ত আছে।