আশা ফিরে পেতেই, ধৈর্য সহকারে, দু’হাত ছড়িয়ে চোখ বন্ধ করে সামনে এগোল বিজয়। গাঢ় অন্ধকার সত্ত্বেও কিছুতেই চোখ বন্ধ করে থাকতে মন চাইছে না। কেমন অদ্ভুত একটা অনুভূতি।
হঠাৎ করেই কিছুর সাথে ধাক্কা খেল হাতের বেলচা। তাড়াতাড়ি সামনে এগোতেই পাথরে হাত আটকে গেল। অন্ধকারেই হাতড়ে বুঝতে পারল একটা সিঁড়ি। তারপর আরেকটা। আনন্দে মনে হচ্ছে কেঁদে ফেলবে। পেরেছে, ও পেরেছে। কিন্তু এখন আনন্দ উদযাপনের সময় নয়। এখান থেকে আগে বেরোতে হবে। সাপেদের তীব্র ভয়ের উৎস যাই হোক না কেন সেটার জন্য বসে থাকলে চলবে না।
বেলচা নামিয়ে নিচের সিঁড়িতে লাফ দিয়ে উঠে একের পর এক সিঁড়ি টপকাতে শুরু করল বিজয়। মনে হচ্ছে বেলচাটাকে ফেলে যেতে হবে। পথ ক্রমেই বিপজ্জনক হয়ে উঠছে। সিঁড়িগুলো পাথর কেটে তৈরি হওয়ায়, চওড়াতে তিন ফুটের বেশি হবে না। বামদিকে গুহাকক্ষের দেয়াল। ডানদিক একেবারে খালি। নিচে গুহাকক্ষের মেঝে। একবার পা হড়কালেই সব শেষ। ভাবতেই গায়ে কাটা দিয়ে উঠল। তাড়াতাড়ি তাই বাম দিকের দেয়াল ধরে উঠতে শুরু করল।
কিন্তু সিঁড়ি যেন কিছুতেই শেষ হচ্ছে না। মনে হচ্ছে অনন্তকাল ধরেই কেবল উপরে উঠে যাচ্ছে। ঘামে ভিজে গেজে গায়ের জামা। অন্ধের মত পাথুরে দেয়াল ধরে উঠতে ঘষা খাচ্ছে হাতের চামড়া। ধীরে ধীরে এত উপরে আসায় ব্যথা করছে উরুদ্বয়। কিন্তু সে এত সহজে হাল ছাড়বে না।
বুঝতে পারল সে কোথায় আছে। তিন ভ্রাতার একটার ভেতরে। পাথুরে বিন্যাসের ঢালু জমি থেকে ঊর্ধ্বে উঠে যাওয়া সুউচ্চ চূড়াগুলোর একটার মধ্যে পাথর কেটে তৈরি হয়েছে এ সিঁড়ি। কোনটা সেটা অনুমান করতে পারছে না–তবে ছোটটা নিশ্চয় নয়। কারণ সেটার প্রবেশ মুখ তো নিচে রয়ে গেছে। তবে অতশত ভেবে কোনো লাভ নেই। উপরে পৌঁছে কী করবে সেটা নিয়েও ভাবছে না। এখন কেবল একটাই চিন্তা। এই অন্ধকারময় গুহা থেকে বেরিয়ে বাইরে যেতে হবে।
আস্তে আস্তে বড় হয়ে উঠছে খোলা মুখ। উজ্জ্বল আলোও দেখা যাচ্ছে। গতি বাড়াবার চেষ্টা করল বিজয়। ও কাছে চলে এসেছে। একদম কাছে।
খোলা মুখ দিয়ে ভেতরে আসা আলোতে উজ্জ্বল হয়ে উঠল সিঁড়ি। ঝাপসা হলেও প্রতিটা সিঁড়ির আকার দেখা যাচ্ছে।
নব আশায় উজ্জীবিত হয়ে উঠল শরীর আর মন। আর বেশি হলে চল্লিশ থেকে পঞ্চাশ ফুট যেতে হবে। পেরেছে, ও পেরেছে।
পরবর্তী কয়েকটা ধাপ স্তপায়ে পেরিয়ে এলো বিজয়।
আর ঠিক তখনি চারপাশে যেন নরক ভেঙে পড়ল। বজ্রকঠিন আওয়াজ করে বিস্ফোরিত হল উপরের শীর্ষচূড়া। উজ্জ্বল আলোয় ভেসে গেল পুরো সিঁড়ি। বৃষ্টির মত ঝড়ে পড়ল পাথরের টুকরো।
মুখ বাঁচানোর জন্য মাথার উপর হাত তুলতে গিয়ে ভুলে গেল দেয়াল ধরে নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখার কথা। একেকটা ছুটন্ত পাথরের টুকরার আকার একেবারে ফুটবলের মত। হাতে, বুকে, পায়ে সর্বত্র আঘাত করছে পাথর। সিঁড়ি দিয়ে গড়িয়ে নেমে যাচ্ছে নিচের গহ্বরে।
এর প্রায় সাথে সাথে আরেকটা বিস্ফোরণের আওয়াজ হল। মনে হল কোনো এক্সপ্লোসিভ ডিভাইস সক্রিয় হয়ে গেছে। সিঁড়ির কাছে থাকা পাথরের চূড়া যেন থর থর করে কেঁপে উঠল। ছুটন্ত পাথরের হাত থেকে বাঁচতে হিমশিম খাচ্ছে বিজয়। বড় বড় কয়েকটা পাথর বুকে আর উরুতে লাগতেই দরদর করে রক্ত ঝড়তে লাগল। পায়ে আরেকটা পাথরের আঘাত লাগতেই যেন আগুন ধরে গেল পুরো শরীরে। তীব্র ব্যথার চোটে দিশেহারা অবস্থা।
মাথার উপরে শোনা যাচ্ছে জেট বিমানের গর্জন আর হেলিকপ্টারের রোটরের আওয়াজ। হঠাৎ করেই সিঁড়ি থেকে পিছলে গেল ডান পা। হাত বাড়িয়ে ভারসাম্য রক্ষার চেষ্টা করলেও মুহূর্তখানেকের জন্য সফল হল। সিঁড়িতে আটকে গেল। মরিয়া হয়ে দেয়াল ধরে টিকে থাকতে চাইছে।
কিন্তু মাধ্যাকর্ষণ শক্তি টেনে নিয়ে ভাসিয়ে দিল বাতাসে আর অতঃপর নিচের খাদে।
.
৭৫. ব্যর্থতা আর হতাশা
মনিটরে সম্পূর্ণ দৃশ্য দেখলেন প্যাটারসন আর ইমরান। আতঙ্কিত হলেও প্রথম হেলিকপ্টারের পতন দৃশ্য দেখে কিছুই করার রইল না। দ্বিতীয় হেলিকপ্টার পিছু হঠতেই হারিয়ে গেল অগাস্তা। কিন্তু সেকেন্ডের মাঝেই আকাশ চিরে উদয় হল মিসাইল। পূর্বদিকে ছুটে ইনফ্রারেড হোমিং ডিভাইস অগাস্তাকে খুঁজছে।
অগাস্তার রকেট লঞ্চার দেখার সাথে সাথে নিজেদের হেলিকপ্টারকে সাহায্যের জন্য কয়েকটা মিগ-২৯ পাঠিয়ে দিয়েছে কাজাক বিমান বাহিনি।
কাজাক জেটের আগমনে সাহস পেয়ে বাকি কাজাক চপারটা আবার আকাশে উঠতেই দেখা গেল লেজ গুটিয়ে পালাচ্ছে অগাস্তা। পূর্বদিকে ছুটলেও পেছনে ফ্লেয়ারের চিহ্ন রেখা রেখে গেছে।
একের পর এক গালির তুবড়ি ছোটালেন প্যাটারসন। “বেজন্মা বেকুবের দল! আমি তখনই বলেছিলাম যে বিমান বাহিনি সহযোগে সৈন্যদের পাঠাতে। আমার কথা শুনল না। শয়তানের দলটা তো একেবারে সব প্রস্তুতি নিয়ে এসেছে। তাদের কাছে ইসিএম আছে। মিসাইলকে প্রতিহত করার ব্যবস্থা আছে।”
এরপরেই একটা মিসাইল একেবারে মাঝখানের চূড়ার উপর আঘাত করতেই ঢালু বেয়ে গড়িয়ে নামল ভাঙ্গা পাথরের টুকরা। থামতেই দেখা গেল আগের চেয়ে চূড়াটা পঞ্চাশ ফুট খাটো হয়ে গেছে।
শীর্ষচূড়ার নিচের পাথুরে বিন্যাসের উপর পড়ে চুরমার হয়ে গেল দ্বিতীয় মিসাইল। মালভূমির উপরিতল থেকে একশ ফুট উপরে আঁছড়ে পড়ল মিসাইল।