এলিসের কথা শুনে যেন ঝাঁকুনি দিয়ে বাস্তবে ফিরে এল মারকো। কাঁপতে কাঁপতে উঠে দাঁড়িয়ে জানালার কাছে এগিয়ে এল। পিছলে ঘাসের লনে নামার সাথে সাথে ল্যাচ ভেঙে ঘরের ভেতরে ঢুকে পড়ল পিটার।
“লনের দিকে গেছে!” জানালার দিকে তাকিয়েই জানিয়ে দিল সঙ্গীকে।
পেছনে কী হয়েছে দেখার জন্য না থেমেই মারকোর হাত ধরে লাফাতে লাফাতে ভিলা থেকে দূরে সরে এলো এলিস। দুজন কো-ডিরেক্টরের সাথে আর কেউ আছে কিনা না জানলেও অনুমান করছে তারা একা আসেনি।
হালকা কাশির মত শব্দ করে কানের পাশ দিয়ে চলে গেলো দুটো বুলেট।
এলিসের বুঝতে একটুও অসুবিধা হল না যে কেউ সাইলেন্সার লাগানো অস্ত্র দিয়ে গুলি করছে।
মারকোকে পেছনে নিয়ে লনের উপর দিয়ে দৌড় লাগাল তাদের অফিসিয়াল ট্রান্সপোর্ট ল্যান্ড ক্রুজারের দিকে।
কিন্তু হঠাৎ করেই মনে হল মারকে অনেক ভারী হয়ে গেছে। আরো একবার সামনে এগোতে যেতেই পাথরের মত অনড় আর নিশ্চল হয়ে পড়ে গেল ছেলেটা।
পিছু ফিরে মাটিতে পড়ে থাকা দোমড়ানো দেহটার দিকে তাকাল এলিস। পুরো মুখ আর চুলগুলো রক্তে ভিজে গেছে, মনে হচ্ছে যেন লাল মুখোশ পরে আছে মারকো। জায়গা মত গেথে গেছে বুলেট।
কী ঘটেছে বুঝতে পেরে কেঁদে ফেলল এলিস। চলে গেল মূল্যবান কিছু মুহূর্ত। নিজের নিরাপত্তার কথা মাথায় এলেও পা দুটো যেন নড়তে চাইছে না। নির্দয়ভাবে কেড়ে নেয়া হয়েছে ছেলেটার জীবন। কিন্তু কেন?
আরো কয়েকটা কাশির আওয়াজ হতেই সম্বিৎ ফিরে পেল এলিস। মারকোর হাত ছেড়ে দিয়ে লাফ দিয়ে ড্রাইভিং সিটে উঠে বসল।
চাবিটা ইগনিশনেই ঝুলছে। নির্ঘাৎ কো-ডিরেক্টরদেরকে নিয়ে সমাধি সাইটে যেতে হবে ভেবে রেখে গেছে মারকো। গুঙ্গিয়ে উঠলেও চালু হল ইঞ্জিন। এক্সিলারেটরে পা রাখতেই মাটির রাস্তায় নেমে এল গাড়ি। সমাধির দিকে ছুটল এলিস।
পেছনেই শোনা গেল চিৎকার। এখনো আশপাশ দিয়ে বাতাসে শিস কেটে যাচ্ছে বুলেট। মেঝের সাথে এক্সিলারেটর চেপে ধরতেই ল্যান্ড ক্রুজারের গায়েও লাগল একটা। যে করেই হোক ওকে সমাধিতে পৌঁছাতে হবে। ওখানে থাকা দুজন সশস্ত্র গার্ড নিশ্চয়ই ওকে এই হঠাৎ ভেঙে পড়া নরক থেকে উদ্ধার করতে পারবে।
সাইটে পৌঁছাতে খুব বেশি সময় লাগল না। কিন্তু অবাক হয়ে গেল গাঢ় অন্ধকারে ঢাকা নিশ্চুপ চারপাশ দেখে। ফ্লাডলাইটস আর জেনারেটর কিছুই কাজ করছে না। সব বন্ধ।
গার্ডরা কোথায়?
লাফ দিয়ে গাড়ি থেকে নেমেই এবড়ো-খেবড়ো রাস্তা ধরে ছুটল এলিস। বহুবার এখানে এলেও এতটা অন্ধকারে কখনো পথ চলতে হয়নি। মাথার উপর জ্বলতে থাকা তারার আলোই ভরসা।
হঠাৎ করেই মাটির উপর পড়ে থাকা ভারী কিছুর সাথে ঠোক্কর খেয়ে পা বেধে পড়ে গেল। কোনোমতে ব্যালান্স ফিরে পেতেই মনে হল দম আটকে মরে যাবে।
জর্ডি!, দুজন গার্ডের একজন। নিচু হয়ে চেক করলেও কোন পালস পেল না। একেবারে নিথর হয়ে পড়ে আছে অসাড় দেহটা।
উদ্বিগ্ন মুখে উঠে দাঁড়াল এলিস। কী ঘটছে জানার প্রয়োজন থাকলেও মন বলছে এক্ষুনি পালাতে হবে।
নিজের সাথে যুদ্ধ করছে, এমন সময় আন্ডারগ্রাউন্ড সমাধির প্রবেশ মুখের উপর নেমে এলো গভীর একটা ছায়া।
পুরোপুরি জমে গেল এলিস। এতক্ষণে দেখতে পেয়েছে হেলিকপ্টার।
হাজার চিন্তার মাঝেও একটা কথা বেশ স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে; ফাঁদে পড়ে গেছে ও!
৪. সাহায্য প্রার্থনা
আনোয়ার!
হা করেই ইমেইলটার দিকে তাকিয়ে আছেন ইমরান। নিজের চোখকেই যেন বিশ্বাস হচ্ছে না।
পিতা-মাতাকে হারানোর পর লক্ষ্ণৌতে চাচার কাছে চলে যাবার আগ পর্যন্ত মীরাটে একসাথে বেড়ে উঠেছেন আনোয়ার আর ইমরান। বহুবছর আগের কথা হলেও এখনো অটুট আছে দুজনের সম্পর্ক। ইমরান আইপিএস এ জয়েন করেছেন আর আনোয়ার লক্ষ্ণৌতে নিজের ছোট একটা ব্যবসা শুর করলেও তেমন সুবিধে করতে পারেননি। তারপরেও টিকে আছে এ বন্ধুত্ব।
কিন্তু মাত্র পাঁচ বছর আগে হঠাৎ করেই উবাও হয়ে গেছে আনোয়ার।
আর এখন আবার এমনভাবে উদয় হয়েছে যেন অতীতের কোনো ছায়া।
পুরনো বন্ধুর সাথে দেখা হবার কথা ভাবতেই উদ্বেলিত হয়ে উঠল হৃদয়। অথচ ইমেইলটা খোলার সাথে সাথে মনে হল মুখে কারো ঘুষি খেয়েছেন।
মাত্র দুটো শব্দ লেখা আছে।
সাহায্য, আনোয়ার।
.
…আগুনের মধ্যে ঝাঁপ
শ্যাফট থেকে উঠে আসা ছায়াটাকে নিজের দিকে এগিয়ে আসতে দেখে পাথরের মত নিশ্চল দাঁড়িয়ে রইল এলিস। লোকটার এক হাত কোমরে দেখেই বুঝতে পারল পিস্তল ধরে আছে।
কী ঘটছে খুঁজে দেখার সব চেষ্টা বাদ দিয়ে দৌড় লাগাল। গাড়ির কাছে ফিরে এসে ড্রাইভারের দরজা খুলে গাড়ির ভেতরে সেঁধিয়ে যেতেই পিস্তলের গর্জনে খান খান হয়ে গেল রাতের নীরবতা। এই অস্ত্রটাতে কোনো সাইলেন্সার নেই। অর্থাৎ গোপন করার কোনো চেষ্টা করা হয়নি।
চুরমার হয়ে গেল জানালার কাঁচ।
কানের পাশ দিয়ে গিয়ে প্যাসেঞ্জার সিটে বিধে গেল আরেকটা বুলেট।
এতক্ষণে জীবন্ত হয়ে উঠল ল্যান্ড ক্রুজারের শক্তিশালী ইঞ্জিন। টপ স্পিডে রিভার্স করতেই নুড়ি পাথরের উপর ক্যাচকোচ শব্দ তুলল টায়ার। ফরোয়ার্ড গিয়ারে চাপ দিয়ে সমাধি থেকে বের হবার জন্য প্রাণান্তকর চেষ্টা শুরু করল এলিস। স্টেরিও সিস্টেমের উপর গুলি লাগতেই হুইলের উপর মাথা নামিয়ে ফেলল। ভয়ে হিস্টিরিয়া রোগীর মত অবস্থা। তারপরেও আতঙ্ক দমাতে গিয়ে মাথার মাঝে কেবল একটাই চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছে।