অন্যরা অবশ্য এই বলে যুক্তি তুলে ধরেন যে, কেউ পছন্দ করুক বা না করুক, ‘মৌলবাদ’ কথাটি টিকে থাকতেই এসেছে। আমি পরিভাষাটি যে সঠিক নয় তার সাথে একমত পোষণ করেছি, তবে আন্দোলনসমূহকে শনাক্ত করতে এটা কাজে লাগে, এবং তাদের ভেতরকার পার্থক্য সত্ত্বেও জোরাল পারিবারিক সাদৃশ্য রয়েছে। মার্টিন এ. মার্টি ও আর. স্কট অ্যাপলবী তাঁদের বিশালাকার ছয় খণ্ডের গ্রন্থ ফান্ডামেন্টালিস্ট প্রজেক্টের ভূমিকায় যুক্তি তুলে ধরেছেন যে, সকল ‘মৌলবাদ’ নির্দিষ্ট কিছু প্যাটার্ন অনুসরণ করে চলে। আধ্যাত্মিকতার যুদ্ধংদেহী ধরন এগুলো, অনুমিত সঙ্কটের প্রতি সাড়া হিসাবে এদের উদ্ভব ঘটেছে। তারা এমন শত্রুর বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত যাদের সেক্যুলারিস্ট বিশ্বাসসমূহ খোদ ধর্মের প্রতি বৈরী বলে বোধ হয়। মৌলবাদীরা এই যুদ্ধকে প্রচলিত রাজনৈতিক সংগ্রাম মনে করে না, বরং একে মহাজাগতিক শুভ ও অশুভ শক্তির ভেতরকার লড়াই হিসাবে কল্পনা করে। এরা নিশ্চিহ্নতার ভয়ে ভীত; তাই অতীতের নির্দিষ্ট কিছু মতবাদ ও অনুশীলনের নির্বাচিত পুনর্জাগরণের মাধ্যমে নিজেদের আসন-ছাড়া পরিচয়কে সংহত করার প্রয়াস পায়। দূষণ এড়াতে তারা প্রায়ই প্রতি-সংস্কৃতি গড়ে তোলার লক্ষ্যে সমাজের মূলধারা হতে নিজেদের প্রত্যাহার করে নেয়, কিন্তু মৌলবাদীরা বাস্তবতা বর্জিত স্বাপ্নিক নয়। তারা আধুনিকতার বাস্তবভিত্তিক যুক্তিবাদকে আত্মস্থ করে নিয়েছে, ক্যারিশম্যাটিক নেতার নির্দেশনায় তারা এইসব ‘মৌলবিশ্বাসকে’ পরিমার্জিত করে যাতে বিশ্বাসীদের কর্মপরিকল্পনার যোগান দেওয়ার মতো একটি আদর্শ নির্মাণ করা যেতে পারে। শেষ পর্যন্ত পাল্টা লড়াই করে তারা, ক্রমবর্ধমান সংশয়বাদী এক বিশ্বকে আবার পবিত্র করে তোলার প্রয়াস পায়।
আধুনিক সংস্কৃতির প্রতি এই বৈশ্বিক সাড়ার নিগূঢ়ার্থ অনুসন্ধানের জন্যে তিনটি একেশ্বরবাদী ধর্মবিশ্বাস ইহুদিবাদ, খৃস্টধর্ম ও ইসলামে মাথাচাড়া দিয়ে ওঠা অল্প কয়েকটি মৌলবাদী আন্দোলনের প্রতি দৃষ্টি দিতে চাই আমি। এদের একটির থেকে অন্যটিকে বিচ্ছিন্ন করে আলাদা আলাদাভাবে পর্যালোচনা না করে আমি এসবের বিকাশকে সময়ানুক্রমিকভাবে পাশাপাশি অনুসন্ধান করতে চাই, যাতে এগুলো কতটা গভীরভাবে একই রকম সেটা বুঝতে পারি। আমি বিষয়টিকে আরও বেশি গভীরতায় পরীক্ষা করার আশা করি, যাতে অধিকতর সাধারণ সামগ্রিক জরিপে তুলনায় অনেক বেশি ফল মিলবে। আমি যেসব আন্দোলন বেছে নিয়েছি সেগুলো হলো, আমেরিকান প্রটেস্ট্যান্ট মৌলবাদ, ইসরায়েলের ইহুদি মৌলবাদ এবং সুন্নী মুসলিম অধ্যুষিত মিশর ও শিয়া ইরানের মুসলিম মৌলবাদ। আমি এটা দাবি করছি না যে আমার আবিষ্কারসমূহ আবিশ্যিকভাবে মৌলবাদের অন্যান্য ধরনের বেলায়ও প্রযোজ্য হবে। তবে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ও প্রভাবশালী এই বিশেষ আন্দোলনগুলো কীভাবে সাধারণ ভীতি, উদ্বেগ ও আকাঙ্ক্ষায় তাড়িত হয়েছে সেটা তুলে ধরার আশা করছি, যা আধুনিক সেক্যুলার বিশ্বের অদ্ভুত কঠিন জীবনের বিশেষ কিছু সমস্যার প্রতি সাড়া হিসাবে অস্বাভাবিক মনে হয় না।
সব যুগ ও ঐতিহ্যে সব সময়ই এমন লোক থাকে যারা তাদের সময়ে আধুনিকতার বিরুদ্ধে লড়াই করেছে। কিন্তু আমাদের আলোচ্য মৌলবাদ আবিশ্যিকভাবেই বিংশ শতাব্দীর আন্দোলন। পশ্চিমে প্রথম আবির্ভূত বৈজ্ঞানিক ও সেক্যুলার সংস্কৃতির বিপক্ষে এটি একটি প্রতিক্রিয়া। পাশ্চাত্য সম্পূর্ণ নজীরবিহীন ও একেবারেই ভিন্ন ধরনের সভ্যতার বিকাশ ঘটিয়েছে, তবে তখন থেকেই তা বিশ্বের অন্যান্য এলাকায়ও শেকড় গেড়েছে। সুতরাং, এর প্রতি ধর্মের সাড়াও অনন্য ছিল। আমাদের নিজস্ব কালে বিকশিত মৌলবাদী আন্দোলনসমূহের আধুনিকতার সাথে একটি প্রতীকী সম্পর্ক রয়েছে। এগুলো পাশ্চাত্যের বৈজ্ঞানিক যুক্তিবাদকে প্রত্যাখ্যান করতে পারে, কিন্তু একে বাদ দিতে পারে না। পশ্চিমা সভ্যতা জগৎ পাল্টে দিয়েছে। ধর্মসহ কোনও কিছুই আর আগের মতো হয়ে উঠতে পারবে না। সারাবিশ্ব জুড়ে মানুষ এই নতুন অবস্থার সাথে যুঝে চলেছে, সম্পূর্ণ ভিন্ন ধরনের এক সমাজের জন্যে পরিকল্পিত ধর্মীয় ঐতিহ্যকে নতুন করে মূল্যায়ন করতে বাধ্য হয়েছে তারা।
প্রাচীন বিশ্বে একই ধরনের ক্রান্তিকাল গেছে, যার মেয়াদ ছিল মোটামুটিভাবে ৭০০ থেকে ২০০ বিসিই পর্যন্ত; ইতিহাসবিদগণ একে অ্যাক্সিয়াল যুগ বলেন, কারণ মানুষের আধ্যাত্মিক বিকাশের ক্ষেত্রে খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিল এই সময়টি। খোদ সময় পর্বটি ছিল হাজার হাজার বছরের অর্থনৈতিক ও সেই সুবাদে সামাজিক ও সাংস্কৃতিক বিবর্তনের ফল ও সংশ্লেষ। বর্তমান ইরাকের সুমের ও প্রাচীন মিশরে এর সূচনা ঘটেছিল। বিসিই চতুর্থ ও তৃতীয় সহস্রাব্দের জনগণ তাদের তাৎক্ষণিক চাহিদা মেটানোর লক্ষ্যে ফসল ফলানোর বদলে কৃষিতে উদ্বৃত্ত ফলানোয় সক্ষম হয়ে উঠেছিল। এর সাহায্যে তারা বাণিজ্য পরিচালনা করে আরও আয় অর্জন করতে পারত। এই বিষয়টিই তাদের প্রথম সভ্যতা গড়ে তুলতে, শিল্পকলার বিকাশ ও ক্রমবর্ধমানহারে শক্তিশালী রাজনীতির বিকাশে সক্ষম করে তুলেছিল: নগর, নগর- রাষ্ট্র ও শেষ পর্যন্ত সাম্রাজ্য। কৃষিভিত্তিক সমাজে ক্ষমতা আর স্থানীয় রাজা বা পুরোহিতদের করায়ত্ত ছিল না; এর কেন্দ্রবিন্দু অন্তত আংশিকভাবে হলেও প্রতিটি সংস্কৃতির সম্পদের উৎস বাজার এলাকায় স্থানান্তরিত হয়েছিল। এমনি পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে মানুষ শেষতক আবিষ্কার করতে শুরু করে যে তাদের পূর্বপুরুষদের দারুণভাবে উপকারে আসা প্রাচীন প্যাগান মতবাদ এখন আর তাদের অবস্থার সাথে খাপ খাচ্ছে না।