সে যাই হোক, সেপ্টেম্বরের ভয়ঙ্কর হামলা দেখায় যে, লোকে যখন ঘৃণা ও হত্যাকে ন্যায়সঙ্গত প্রমাণ করতে ধর্মকে ব্যবহার করতে শুরু করে, সকল মহান বিশ্ব ধর্মের সহানুভূতিময় নৈতিকতাকে বিসর্জন দেয়, তখন তারা এমন এক পথে যাত্রা করে যেখানে বিশ্বাসের পরাজয় ফুটে ওঠে। এই আগ্রাসী ধার্মিকতা এর আরও অধিকতর চরম উপাদানকে নৈতিকতার অন্ধকারে ঠেলে দিতে পারে যা আমাদের সবাইকেই বিপদাপন্ন করে তোলে। তিনটি ধর্ম বিশ্বাসের মৌলবাদীরা যদি আরও রেডিক্যাল ও ধ্বংসাত্মক বিশ্বাস আলিঙ্গন করতে শুরু করে থাকে, সেটা সত্যিই ভীতিকর একটা পরিবর্তন হবে। সুতরাং, এই গভীর হতাশার পেছনে কী লুকিয়ে আছে ও কোন জিনিসটা মৌলবাদীদের তাদের কর্মকাণ্ডে বাধ্য করে, সেটা বুঝতে পারাটা অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। এখনও এটা ঠিক যে মৌলবাদীদের কেবল একটা সামান্য অংশই সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে অংশ নেয়, বাকি সবাই তাদের চোখে বিশ্বাসের প্রতি পরিহাসময় মনে হওয়া এক পৃথিবীতে ধর্মীয় জীবন যাপন করার প্রয়াস পাচ্ছে। আমাদের অব্যাহত অজ্ঞতা ও বিতৃষ্ণা যদি আরও বিপূল সংখ্যক মৌলবাদীকে সহিংসতার পথে ঠেলে দেয়, সেটা হবে খুবই দুঃখজনক। আসুন আমরা এই ভীতিকর সম্ভাবনাকে রোধ করার জন্যে যা কিছু সম্ভব করার প্রয়াস পাই।
সূচনা
বিগত বিংশ শতাব্দীর শেষ ভাগের অন্যতম চমকপ্রদ পরিবর্তন ছিল প্রতিটি প্রধান ধর্মীয় ঐতিহ্যেই জনপ্রিয়ভাবে ‘মৌলবাদ’ নামে পরিচিত এক ধরনের উগ্র ধার্মিকতা। অনেক সময় এর প্রকাশ মারাত্মক হতে দেখা যায়। মৌলবাদীরা মসজিদে প্রার্থনাকারীদের গুলি করে হত্যা করেছে, অ্যাবরশন ক্লিনিকে কর্মরত ডাক্তার ও নার্সদের খুন করেছে, নিজেদের প্রেসিডেন্টদের গুলি করে মেরেছে, এমনকি শক্তিশালী সরকারেরও পতন ঘটিয়েছে। মৌলবাদীদের খুব অল্প সংখ্যার সংখ্যালঘু অংশই এইসব সন্ত্রাসী ঘটনা ঘটিয়ে থাকে, কিন্তু সবচেয়ে শান্তিপ্রিয় ও নিয়মনিষ্ঠরাও যেন বিভ্রান্ত বোধ করছে, কারণ তাদের যেন আধুনিক সমাজের অধিকাংশ মূল্যবোধের সাথেই চরমভাবে বিরোধিতায় মত্ত মনে হয়। গণতন্ত্র, বহুত্ববাদ, ধর্মীয় সহিষ্ণুতা, শান্তিরক্ষা, বাক-স্বাধীনতা কিংবা গির্জা ও রাষ্ট্রের বিচ্ছিন্নতার ব্যাপারে মৌলবাদীদের কোনও অবকাশ নেই। ক্রিশ্চান মৌলবাদীরা প্রাণের উৎপত্তি সম্পর্কে জীববিজ্ঞান ও পদার্থবিদ্যার বিভিন্ন আবিষ্কারকে প্রত্যাখ্যান করে, জোর দিয়ে বলে বুক অভ জেনেসিসই সবদিক থেকে বৈজ্ঞানিকভাবে নির্ভুল। অনেকেই অতীতের শৃঙ্খল ছুঁড়ে ফেলে দিচ্ছে যখন, এমন একটা সময়ে ইহুদি মৌলবাদীরা আগের চেয়ে অনেক বেশি কঠোরভাবে প্রত্যাদিষ্ট বিধান পালন করে চলেছে, মুসলিম নারীরা পশ্চিমা নারীদের স্বাধীনতাকে প্রত্যাখ্যান করে বোরখা ও চাদরে নিজেদের আবৃত্ত করছে। মুসলিম ও ইহুদি মৌলবাদীরা উভয়ই প্রবলভাবে সেক্যুলারিস্ট হিসাবে সূচিত আরব-ইসরায়েল বিরোধকে চরমভাবে ধর্মীয় দৃষ্টিতে ব্যাখ্যা করে। তাছাড়া, মৌলবাদ কেবল মহান একেশ্বরবাদী ধর্মগুলোতেই সীমাবদ্ধ নয়। বুদ্ধ, হিন্দু, ও এমনকি কনফুসীয় মৌলবাদীও রয়েছে। উদার সংস্কৃতির বহু কষ্টে আহরিত অন্তর্দৃষ্টি যাকে দূরে ঠেলে দিয়েছে, যা ধর্মের নামে যুদ্ধ ও হত্যা করে এবং রাজনীতি ও জাতীয় সংগ্রামের ক্ষেত্রে পবিত্রকে টেনে আনার সংগ্রাম করে।
এই ধর্মীয় পুনর্জাগরণ বহু পর্যবেক্ষককে হতবাক করে দিয়েছে। বিংশ শতাব্দীর মধ্যবর্তী বছরগুলোতে সাধারণভাবে ধরে নেওয়া হয়েছিল যে, সেক্যুলারিজম অপরিবর্তনযোগ্য প্রবণতা, ধর্মবিশ্বাস আর কোনওদিনই বৈশ্বিক কর্মকাণ্ডে তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারবে না। ধরে নেওয়া হয়েছিল যে, মানবজাতি আরও যৌক্তিক হয়ে উঠবে, তাদের আর ধর্মের প্রয়োজনই হবে না বা একে জীবনের একেবারেই ব্যক্তিগত পর্যায়ে সীমিত রেখেই সন্তুষ্ট থাকবে। কিন্তু ১৯৭০ দশকের শেষের দিকে মৌলবাদীরা সেক্যুলার আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে ধর্মকে প্রান্তিক অবস্থান থেকে একেবারে মধ্যমঞ্চে তুলে নিয়ে আসে। অন্ততপক্ষে এই দিক থেকে তারা লক্ষণীয় সাফল্য অর্জন করেছে। ধর্ম আবারও এমন এক শক্তিতে পরিণত হয়েছে যাকে কোনও সরকারের পক্ষেই আর নিরাপত্তার সাথে উপেক্ষা করে থাকা সম্ভব হচ্ছে না। মৌলবাদ পরাজয়ের মুখোমুখি হয়েছে বটে, কিন্তু কোনওভাবেই নিষ্ক্রিয় হয়ে যায়নি। এটা এখন আধুনিক দৃশ্যপটের অত্যাবশ্যক অংশে পরিণত হয়েছে। ভবিষ্যতের অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক বলয়ে নিশ্চিতভাবেই গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকাই পালন করবে। সুতরাং, এই ধরনের ধার্মিকতার মানে কী, কীভাবে এবং কোন কারণে এর বিকাশ ঘটল, আমাদের সংস্কৃতি সম্পর্কে আমাদের তা কী জানাতে পারে এবং কেমন করে সবচেয়ে ভালোভাবে এর মোকাবিলা করা যেতে পারে সেটা বোঝার চেষ্টা করা খুবই জরুরি।
কিন্তু সামনে অগ্রসর হওয়ার আগে বহুল-সমালোচিত খোদ ‘মৌলবাদ’ কথাটির দিকে আমাদের একটু সংক্ষিপ্ত নজর দেওয়া প্রয়োজন। বিংশ শতাব্দীর প্রথম দশকগুলোতে আমেরিকান প্রটেস্ট্যান্টরাই সবচেয়ে প্রথম এই পরিভাষাটি ব্যবহার করে, তাদের কেউ কেউ নিজেদের অন্য অধিকতর ‘উদার’ প্রটেস্ট্যান্টদের থেকে ভিন্ন হিসাবে তুলে ধরার জন্যে ‘মৌলবাদী’ আখ্যায়িত করতে শুরু করেছিল। তাদের মতে উদারবাদীরা ক্রিশ্চান ধর্মবিশ্বাসকে বিকৃত করছিল। মৌলবাদীরা মৌলবিশ্বাসে ফিরে যেতে চেয়েছে ও ক্রিশ্চান ঐতিহ্যের ‘মৌল বিষয়’গুলোর উপর গুরুত্ব আরোপ করেছে। একে তারা ঐশীগ্রন্থের আক্ষরিক ব্যাখ্যা ও বিশেষ কিছু বিশ্বাসকে মেনে নেওয়ার সাথে একীভূত করে নিয়েছিল। ‘মৌলবাদ’ পরিভাষাটি তখন থেকেই অন্য বিশ্ব ধর্মের সংস্কারবাদী আন্দোলনসমূহকে এমনভাবে বর্ণনা করার কাজে ব্যবহার করা হয়ে আসছে যা মোটেও সন্তোষজনক নয়। এটা যেন বোঝাতে চায় মৌলবাদী এর সব ধরনের প্রকাশে সম্পূর্ণই একরৈখিক। ব্যাপারটা মোটেই তা নয়। প্রতিটি ‘মৌলবাদ’ নিজেই একটি আইন এবং এর নিজস্ব গতিশীলতা রয়েছে। পরিভাষাটি এমন ধারণাও দেয় যে, মৌলবাদীরা উৎসগতভাবে রক্ষণশীল, অতীতচারী; কিন্তু তাদের ধারণাসমূহ আবিশ্যিকভাবেই আধুনিক ও দারুণভাবে উদ্ভাবনী ধরনের। আমেরিকান প্রটেস্ট্যান্টরা তাদের ‘মৌলবিশ্বাসে’ ফিরে যেতে চেয়ে থাকতে পারে, কিন্তু সেটা তারা করেছে লক্ষণীয়ভাবে আধুনিক কায়দায়। এমনও যুক্তি দেখানো হয়েছে যে, এই ক্রিশ্চান পরিভাষাটিকে সম্পূর্ণ ভিন্ন অগ্রাধিকার বিশিষ্ট আন্দোলনের ক্ষেত্রে প্রয়োগ করা যায় না। উদাহরণ স্বরূপ, মুসলিম ও ইহুদি মৌলবাদ মূলতঃ মতবাদ নিয়ে তেমন একটা সচেতন নয়, এটা আবিশ্যিকভাবেই ক্রিশ্চান সংশ্লিষ্ট বিষয়। ‘মৌলবাদে’র আক্ষরিক অনুবাদ থেকে আমরা উসুলিয়াহ শব্দ পাই, যার মানে দাঁড়ায় ইসলামি আইনের বিভিন্ন বিধান ও নীতিমালার উৎস নিয়ে গবেষণা। পশ্চিমে ‘মৌলবাদী’ হিসাবে তকমা পাওয়া বেশিরভাগ অ্যাক্টিভিস্টই ইসলামি বিদ্যাচর্চায় নিয়োজিত নয়, তাদের সম্পূর্ণ ভিন্ন উদ্বেগের বিষয় রয়েছে। সুতরাং ‘মৌলবাদ’ কথাটির ব্যবহার ভ্রান্তিকর।