এই গ্রন্থের পরিশিষ্টে আমি তুলে ধরেছি যে মৌলবাদ বিদায় নিচ্ছে না, বরং এটা আধুনিক দৃশ্যপটেরই অংশ, এবং এমন এক বাস্তবতা যার মোকাবিলা করা আমাদের শিখতে হবে। মৌলবাদের ইতিহাস দেখায় যে, এই উগ্র ধার্মিকতা আমরা অগ্রাহ্য করলেই মিলিয়ে যায় না। মৌলবাদের হুমকির অস্তিত্ব নেই ভান করা বা মুষ্টিমেয় উন্মাদ লোকের বদ্ধমূল ধারণা হিসাবে মৌলবাদকে সেক্যুলার বিতৃষ্ণার সাথে নাকচ করে দেওয়া মোটেই ঠিক নয়। ইতিহাস আরও দেখায় যে, মৌলবাদকে দমন করার প্রয়াস স্রেফ তাকে আরও চরম রূপ দেয়। এটা পরিষ্কার, সকল ধর্মবিশ্বাসের মৌলবাদীরা কী প্রকাশ করতে চাইছে উপলব্ধি করার জন্যে আমাদের মৌলবাদী ইমেজারিসমূহকে বোধগম্য করে তুলতে হয়েছে। কারণ এইসব আন্দোলন এক ধরনের উদ্বেগ ও অসন্তোষ তুলে ধরে যা কোনও সমাজই উপেক্ষা করে থাকতে পারে না। সেপ্টেম্বর ১১-র পর থেকে বিশ্বের বহু স্থানে ক্রমেই চরম রূপ ধারণ করতে চলা মৌলবাদী আন্দোলনসমূহকে উপলব্ধি করা অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ক্রিশ্চান রাইটের সদস্যরা ১৯৭০ দশকের মৌলবাদের সীমা অতিক্রম করে গেছে বলে মনে হচ্ছে। এই গ্রন্থের শেষ অধ্যায়ে আমি জেরি ফলওয়েল ও মরাল মেজরিটিকে অনেক পিছে ফেলে যাওয়া রিকন্সট্রাকশনিজম ও ক্রিশ্চান আইডেন্টিটি আন্দোলন নিয়ে আলোচনা করেছি। এগুলো উত্তর-মৌলবাদের একটি ধরন, যা ঢের বেশি ভীতিকর, অনমনীয় ও চরম। একইভাবে ছিনতাইকারীরা যেন ইসলামি মৌলবাদের ক্ষেত্রে কোনও ধরনের ভয়ঙ্কর পরিবর্তন তুলে ধরেছে বলে মনে হয়। বিন লাদেন সৈয়দ কুতবের প্রচলিত মৌলবাদী পরিভাষায় কথা বললেও ছিনতাইকারীরা, বিন লাদেনের যাদের কুতবিয় পরিভাষায় ‘ভ্যানগার্ড’ আখ্যায়িত করেছেন, সম্পূর্ণ ভিন্ন ধরনের মৌলবাদের আবির্ভাব ঘটাতে পারত, এমন কিছু অতীতে যা আমরা প্রত্যক্ষ করিনি। প্রথম বিমানের চালক মিশরিয় ছিনতাইকারী মুহাম্মদ আতা ছিল প্রায়-মদ্যপ ধরনের, বিমানে আরোহনের আগেও ভদকা খাচ্ছিল সে। পেনসিলভেনিয়ায় ক্র্যাশ করা বিমানের অভিযুক্ত লেবানিজ পাইলট জিয়াদ জাররাহিও মদ্যপ ছিল, হামবুর্গে নিয়মিত নাইটক্লাবে যাতায়াত করত সে। ছিনতাইকারীরা লাস ভেগাসের বিভিন্ন ক্লাব ও নারীসঙ্গও উপভোগ করত।
এইসব তথ্য বের হয়ে আসার সাথে সাথে খুব অদ্ভুত কিছু ব্যাপার ঘটছে বলে আমি সজাগ হয়ে উঠেছিলাম। মুসলিমদের পক্ষে ধর্মীয়ভাবে অ্যালকোহল পান নিষিদ্ধ। একজন মুসলিম শহীদ পেট ভর্তি ভদকা নিয়ে আল্লাহর সাথে সাক্ষাৎ করতে যাচ্ছে, এমন ধারণা ১৯৯৪ সালে হেবরনের গ্রেট মস্কে হামলা চালিয়ে উনত্রিশজন মুসলিমকে হত্যা করার আগে শূকরের মাংস ও ডিম দিয়ে নাশতা সারা বারুচ গোল্ডম্যানের মতো ইহুদি মৌলবাদীর আত্মহত্যার পথ বেছে নেওয়ার মতোই অচিন্তনীয়। কোনও ধার্মিক মুসলিম বা ইহুদিই এই ধরনের আচরণে নিজেকে জড়িত করার কথা ভাবতে পারে না। বেশির ভাগ মৌলবাদীই অর্থডক্স জীবন অনুসরণ করে, অ্যালকোহল, নাইটক্লাব আর শিথিল রমনী হচ্ছে জাহিলিয়াহর বৈশিষ্ট্য, অজ্ঞ, ঈশ্বরবিহীন বর্বরতা মুসলিম মৌলবাদীরা সৈয়দ কুতবের নির্দেশ অনুসরণ করে যাকে কেবল বর্জনেরই শপথ গ্রহণ করেনি, বরং নিশ্চিহ্ন করারও শপথ নিয়েছে। ছিনতাইকারীরা যেন কেবল ধর্মের যেসব মৌল বিধানকে রক্ষা করার শপথ নিয়েছিল সেগুলোকেই অমান্য করার পথে যায়নি, বরং প্রচলিত মৌলবাদীদের অনুপ্রাণিতকারী নীতিমালাকেও পদদলিত করেছে।
পরের পাতাগুলোয় আমি বহু উন্মলতাবাদী আন্দোলনের বর্ণনা দিয়েছি যেখানে জনগণ ইচ্ছাকৃতভাবে প্রবল উদ্বেগ ও পরিবর্তনের পর্যায়ে পবিত্রতম রীতিনীতি লঙ্ঘন করে গেছে। এখানে সপ্তদশ শতকের মেসায়াহ চরিত্র শাব্বেতাই যেভি, তাঁর শিষ্য জ্যাকব ফ্রাংক ও ‘পবিত্র পাপের’ পক্ষে বক্তব্যদানকারী সপ্তম শতকের ইংল্যান্ডের বিপ্লবী পয়গম্বরগণও অন্তর্ভুক্ত রয়েছেন। সময় এতটাই মরিয়া ছিল যে, সম্পূর্ণ নতুন কিছুর প্রয়োজন হয়ে পড়েছিল। প্রাচীন মূল্যবোধসমূহ আর কাজে লাগছিল না; কেবল প্রাচীন রীতিনীতির পাইকারী লঙ্ঘনের ভেতর দিয়েই অর্জনযোগ্য নতুন বিধান ও নতুন স্বাধীনতা প্রয়োজন হয়ে পড়েছিল।
আমি আরও দেখিয়েছি যে, মৌলবাদের অধিকতর চরম রূপে এক ধরনের অন্তস্থঃ ধ্বংসাত্মক প্রবণতা রয়েছে। তিনটি ধর্ম বিশ্বাসের সবকটাতেই মৌলবাদীরা ধ্বংস ও নিশ্চিহ্নকরণের কল্পনা লালন করেছে। অনেক সময়, যেমন দশম অধ্যায়ে আমি দেখিয়েছি, পরিকল্পিতভাবেই স্বয়ং-ধ্বংসাত্মক বিভিন্ন কর্মকাণ্ড পরিচালনায় বাধ্য করা হয়ে থাকে তাদের। ১৯৭৯ সালে ডোম অভ রক উড়িয়ে দেওয়ার লক্ষ্যে জুইশ আন্ডারগ্রাউন্ডের পরিকল্পনা এর জ্বলন্ত নজীর। এই ঘটনার ফলে ইসরায়েল রাষ্ট্রের বিনাশ ঘটতে পারত। এই ইহুদি মৌলবাদীরা এক পৌরাণিক বিশ্বাসে চালিত হয়েছে। এই পৃথিবীর বুকে তারা প্রলয় ঘটাতে পারলে ঈশ্বর তখন মহাকাশ থেকে নিষ্কৃতি অবতরণ করাতে ‘বাধ্য’ হবেন। আবার, মুসলিম আত্মঘাতী বোমারুদের চেয়ে ব্যাপক ধ্বংসবাদী কর্মকাণ্ড কল্পনা করা কঠিন। সম্পূর্ণ ভিন্ন এক স্তরে ১৯৮০-র দশকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে টেলিভিশন কেলেঙ্কারীর সৃষ্টিকারী জিম ও ট্যামি ফেয় বেকার এবং জিমি সোয়াগনের বিচিত্র অ্যান্টিকসমূহ জেরি ফলওয়েলের অধিকতর সুবোধ মৌলবাদের বিরুদ্ধে ঢের চরম ধ্বংসবাদী বিদ্রোহ তুলে ধরে। এটাও উত্তর-মৌলবাদের একটা রূপ ছিল যা ‘পবিত্র পাপে’র উন্মুলতার অন্বেষণ তুলে ধরে। সেপ্টেম্বর ১১-র ছিনতাইকারীরাও সম্ভবত এমন একটা অবস্থানে পৌঁছে গিয়েছিল যেখানেও তারাও মুসলিম উন্মুলতা- উত্তর-মৌলবাদের একটি ধরন গড়ে তুলছিল, কোনও কিছুকেই আর পবিত্র ভাবতে পারছিল না ওরা। একবার এই পর্যায়ে পৌঁছে গেলে সবচেয়ে নিষ্ঠুর ও অশুভ আচরণকেও ইতিবাচক শুভ কাজ হিসাবে দেখা হতে পারে।