ধন্যবাদ সবাইকে
শওকত হোসেন
মালিবাগ, ঢাকা
নতুন ভূমিকা
২০০১ সালের ১১ই সেপ্টেম্বর তারিখটি বিশ্বকে চিরতরে পাল্টে দেওয়া দিন হিসাবে ইতিহাসে স্থান করে নেবে। এই দিনই মুসলিম সন্ত্রাসীরা বিশ্ব বাণিজ্য কেন্দ্র ও পেন্টাগনের একটি অংশ ধ্বংস করে পাঁচ হাজারেরও বেশি মানুষকে হত্যা করেছিল। স্পষ্টতই টেলিভিশনে প্রচারের উদ্দেশ্যেই পরিকল্পিত কাজ ছিল এটা। বিশ্ব বাণিজ্য কেন্দ্রের জ্বলন্ত টাওয়ারজোড়া এবং পরবর্তী দর্শনীয় ধস সম্ভবত একবিংশ শতাব্দীর আইকনে পরিণত হবে। ইতিহাসে এই প্রথমবারের মতো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জনগণ কোনও বিদেশী শক্তির হাতে আক্রান্ত হয়েছে, কিন্তু কোনও জাতি রাষ্ট্র নয়, বা পারমানবিক মিসাইলও নয়, বরং স্রেফ পেননাইফ আর বক্স কাটার হাঁকানো ধর্মীয় চরমপন্থীদের হাতে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে পরিচালিত হামলা হলেও প্রথম বিশ্বে আমাদের সবার উদ্দেশ্যেই সতর্কবাণী ছিল এটা। এক নতুন ধরনের নগ্নতা, আক্রম্যতা বোধে আক্রান্ত হয়েছি আমরা, নিষ্ঠুরতার মাত্র এক মাসের কিছু বেশি সময় পর যখন আমি লিখছি, এখনও এটা স্পষ্ট নয় যে কীভাবে এই ঘটনাটি আমাদের আচরণকে প্রভাবিত করবে। পরিবর্তিত এই বিশ্বে একটা ব্যাপার ইতিমধ্যে স্পষ্ট হয়ে গেছে যে, কোনও কিছুই আর আগের মতো থাকবে না। সেপ্টেম্বর ১১-এর আগে যেসব অগ্রাধিকার ও উদ্বেগ আমাদের ব্যস্ত রেখেছিল সেগুলোকে এখন অপ্রাসঙ্গিক মনে হচ্ছে। আমরা ভীতিকর অস্বস্তিকর এক পরিবর্তনের মুখে পড়েছি।
অবশ্য মৌলবাদের গতিশীলতায় পরিবর্তন আসেনি। আক্রমণের ব্যাপকতা সম্পর্কে কারও পক্ষেই পূর্বধারণা করা সম্ভব ছিল না, কারণ তা ছিল ধারণাতীত। তবে এটা ছিল মৌলবাদীদের ঈশ্বরের পক্ষে তাদের চলমান যুদ্ধে নতুনতম ও সবচেয়ে ভয়ঙ্কর আক্রমণ। এই পৃষ্ঠাগুলোতে আমি যেমন তুলে ধরার প্রয়াস পাবো, প্রায় শতবছর ধরে ক্রিশ্চান, ইহুদি ও মুসলিমরা এক উগ্র ধরনের ধার্মিকতা গড়ে তোলার কাজে ব্যস্ত ছিল যার লক্ষ্য আধুনিক সেক্যুলার সংস্কৃতিতে অবনমিত ঈশ্বর ও ধর্মকে প্রান্তরেখা থেকে আবার মধ্যমঞ্চে ফিরিয়ে আনা। এইসব ‘মৌলবাদী’, যেমন তাদের আখ্যায়িত করা হয়ে থাকে, ধর্মের প্রতি উৎসগতভাবে বৈরী এক বিশ্বে বিশ্বাসের পক্ষে যুদ্ধ করে যাচ্ছে। সেক্যুলার আধুনিকতার বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে তারা; এই সংগ্রামের ভেতর দিয়ে তারা উল্লেখযোগ্য সাফল্য অর্জন করেছে। বিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে সাধারণভাবে পণ্ডিত ও ধারাভাষ্যকারগণ ধরে নিয়েছিলেন যে সেক্যুলারিজমই আগামীর আদর্শ এবং ধর্ম আর কখনওই আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে শক্তিতে পরিণত হতে পারবে না। কিন্তু মৌলবাদ এই প্রবণতাকে উল্টে দিয়েছে, ক্রমশঃ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও মুসলিম বিশ্বের উভয় ক্ষেত্রেই ধর্ম এমন এক শক্তিতে পরিণত হয়েছে যাকে প্রতিটি সরকার গুরুত্বের সাথে নিতে বাধ্য হয়েছে।
সেপ্টেম্বর ১১-এর প্রলয়কাণ্ডকে এই গ্রন্থে বর্ণিত মৌলবাদের ইতিহাসের যৌক্তিক পরিণাম হিসাবে দেখা যেতে পারে। প্রায়শঃই লোকে যেমনটা ভেবে থাকে, মৌলবাদ কোনও সচেতন পশ্চাদপদতা নয়। এটা অতীতে ফিরে যাওয়া নয়। এইসব মৌলবাদ আবিশ্যকভাবেই আধুনিক আন্দোলন এবং নিজ সময় ছাড়া অন্য কোনও কালেই শেকড় গাড়তে পারবে না। এটা ছিল সেক্যুলার আধুনিকতার বিরুদ্ধে পরিচালিত সবচেয়ে প্রলয়ঙ্করী অক্রমণ, এরচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ লক্ষ্য আর বেছে নিতে পারত না সন্ত্রাসীরা। সেপ্টেম্বর ১১-র চেয়ে আর কখনওই মৌলবাদীরা মিডিয়ার এমন দক্ষ সদ্ব্যবহার করতে পারেনি। প্রথম বিমানের ধ্বংসে সচেতন হয়ে ওঠা লক্ষ লক্ষ মানুষ ততক্ষণে যার যার টিভি সেটের সামনে বসে বিশ্ব বাণিজ্য কেন্দ্রের দাক্ষিণ টাওয়ারে দ্বিতীয় প্লেনের হামলে পড়া দেখতে হাজির হয়ে গিয়েছিল। মৌলবাদীরা আধুনিক বাবেল মনে হওয়া প্রকৃতির বিরোধিতা করে গড়ে তোলা অসাধারণ ভবন ধ্বংস করার লক্ষ্যে আধুনিক প্রযুক্তি কাজে লাগিয়েছে। মৌলবাদীদের কাছে এই ধরনের কাঠামো ঈশ্বরের সার্বভৌমত্বের বিরুদ্ধে চ্যালেঞ্জ ঠেকতে পারে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতি ও সামরিক শ্রেষ্ঠত্বের প্রতীক বিশ্ব বাণিজ্য কেন্দ্র ও পেন্টাগন ধর্মীয় অভিশাপের মুখে তাসের ঘরের মতো জমিনে লুটিয়ে পড়েছে। মারাত্মক আঘাত ছিল এটা। কেবল হাজার মানুষ প্রাণই হারায়নি, বরং আমেরিকার গর্বিত স্বয়ংসম্পূর্ণতা ও আস্থা টাওয়ারগুলোর সাথে সাথে ধসে পড়েছে। মানুষ আর কোনওদিনই সেপ্টেম্বর ১০-এর মতো নিজেদের নিরাপদ ভাবতে পারবে না। দশকের পর দশক এয়ারপ্লেনগুলো মানুষকে এক ধরনের অতিমানবীয় মুক্তির বোধ যুগিয়েছে, তাদের মেঘের অনেক উপরে বসে থাকতে সক্ষম করে তুলেছে, প্রাচীনকালের দেবতাদের মতোই ক্ষিপ্র বেগে সারা পৃথিবী ঘুরে বেড়াতে পেরেছে তারা। কিন্তু এখন তাদের অনেকেই আকাশে উড়তে ভয় পাচ্ছে। ওদের মাটিতে নামিয়ে আনা হয়েছে, নিয়ে আসা হয়েছে আসল রূপে, ওদের সেক্যুলার ডানা ছেঁটে দেওয়া হয়েছে এবং ভয়ঙ্করভাবে ফুটো করে দেওয়া হয়েছে আত্মবিশ্বাস।
প্রধান সন্দেহভাজন ওসামা বিন লাদেন মৌলিক চিন্তাবিদ নন। তাঁর ধ্যানধারণা সম্পূর্ণই মিশরিয় মৌলবাদী সৈয়দ কুতবের ধারণা ভিত্তিক। এই গ্রন্থের অষ্টম অধ্যায়ে তাঁর বিষয়ে আলোচনা করা হয়েছে। কুতবের পরিভাষা ব্যবহার করে বিন লাদেন ঘোষণা করেছেন যে, সেপ্টেম্বর ১১-র ঘটনাপ্রবাহ বিশ্ব দুটি শিবিরে বিভক্ত থাকার বিষয়টিই তুলে ধরেছে: একটি ঈশ্বরের পক্ষে, অন্যটি তাঁর বিপক্ষে। কিন্তু দীর্ঘদিন ধরেই বিশ্ব দুটি ভিন্ন শিবিরে ভাগ হয়ে আছে, সেটা বিন লাদেনের বর্ণনা মোতাবেক না হয়ে থাকলেও। অনেক দশক ধরে আধুনিকতার সুযোগ সুবিধা উপভোগ ও সমর্থন করে আসছে যারা আর আধুনিক সমাজ থেকে নিজেদের বিচ্ছিন্ন করে নেওয়া মৌলবাদীরা পরস্পরে প্রতি চরম বিতৃষ্ণার সাথে দুর্বোধ্যতার মহাগহ্বরের উপর দিয়ে তাকিয়ে আছে। সেপ্টেম্বর ১১-র নিষ্ঠুরতা কেবল ভুল বোঝাবুঝির মাত্রাটুকু কতটা গভীর এবং ভিত্তি কতটা বিপজ্জনক হয়ে উঠেছে সেটাই তুলে ধরে। এটা সভ্যতার সংঘাত নয়, মৌলবাদ সব সময়ই আন্তসমাজ বিরোধ। যেন এই বিষয়টিকে জোরাল করে তুলতেই আমেরিকান ক্রিশ্চান মৌলবাদী জেরি ফলওয়েল ও প্যাট রবার্টসন প্রায় সাথে সাথেই ঘোষণা করেছিলেন যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সেক্যুলার মানবতাবাদীদের পাপের জন্যে ওই ট্র্যাজিডি ছিল ঈশ্বরেরই বিচার-এমনি দৃষ্টিভঙ্গি মুসলিম ছিনতাইকারীদের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে খুব একটা ভিন্ন কিছু নয়।