সুতরাং নিব্বানা ক্রিশ্চানদের স্বর্গের মতো কোনও জায়গা নয় যেখানে মৃত্যুর পর বিশ্বাসীরা দল বেঁধে যাবে। প্রাচীন বিশ্বের খুবই অল্প সংখ্যক মানুষ এই পর্যায়ে আনন্দময় অমরত্বের আশা করত। প্রকৃতপক্ষে, গৌতমের আমলে ভারতীয় জনগণ বর্তমান যন্ত্রণাকর অস্তিত্বের নিগড়ে পুরোপুরি বন্দি মনে করছে নিজেদের। ষষ্ঠ শতাব্দীতে ব্যাপক গ্রহণযোগ্যতা লাভকারী পুনর্জন্মের মতবাদ থেকে যেমনটা দেখতে পাই আমরা। মনে করা হতো যে, নারী বা পুরুষ মৃত্যুর পর তার বর্তমান জীবনের কর্মকাণ্ডের (কম্ম) মান দিয়ে নির্ধারিত এক নতুন রূপে পুনর্জন্ম নেবে। খারাপ কৰ্ম্ম’র মানে হবে আপনি ক্রীতদাস, জানোয়ার বা গাছ হিসাবে পুনর্জন্ম নেবেন; সুকৰ্ম্ম পরবর্তী কালে উন্নত অস্তিত্ব নিশ্চিত করবে: আপনি রাজা এমনকি দেবতা হিসাবেও পুনর্জন্ম লাভ করতে পারেন। কারণ কোনও একটি স্বর্গে পুনর্জন্ম লাভ করা সুখকর পরিসমাপ্তি নয়, কারণ ঐশ্বরিকতা অন্য যে কোনও অবস্থার চেয়ে অধিকতর স্থায়ী নয়। শেষ পর্যন্ত এমনকি দেবতারও তাঁকে স্বর্গীয় রূপ দানকারী সৎ কম্ম ফুরিয়ে যাবে, তিনি মারা যাবেন এবং পৃথিবীতে কম সুবিধাজনক অবস্থায় পুনর্জন্ম নেবেন। সুতরাং, সকল সত্তাই সামসারা (‘এগিয়ে নেওয়া’)র অন্তহীন চক্রে বাঁধা পড়ে আছে যা তাকে এক জীবন থেকে অন্য জীবনে ঠেলে দেয়। বহিরাগত কারও কাছে একে উদ্ভট তত্ত্ব মনে হয়, কিন্তু এটা দুঃখ-দুর্দশার সমস্যা সমাধানের সিরিয়াস প্রয়াস ছিল। একে প্রায়শঃই দুষ্টের পালনকারী ও ঘনঘন ভ্রান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণকারী বলে মনে হওয়া ব্যক্তিরূপী ঈশ্বরকে মানুষের নিয়তি নির্ধারণের জন্যে দায়ী করার চেয়ে অন্তস্থভাবে অনেক বেশি সন্তোষজনক হিসাবে দেখা যেতে পারে। কম্মের বিধান সম্পূর্ণ নৈর্ব্যক্তিক মেকানিজম যা ন্যায়সঙ্গতভাবে কারও প্রতি বৈষম্য ছাড়াই প্রযুক্ত হয়েছে। কিন্তু একের পর এক জীবন কাটানোর সম্ভাবনা উত্তর ভারতের অধিকাংশ মানুষের মতো গৌতমকেও আতঙ্কে পূর্ণ করে তুলেছিল।
এটা হয়তো বোঝা কঠিন। আজকাল আমাদের অনেকেই অনুভব করেন যে আমাদের জীবন অতি সংক্ষিপ্ত। নতুন করে জীবন শুরুর সুযোগ পেলে তাঁরা খুশি হবেন। কিন্তু গৌতম ও তাঁর সমসাময়িকদের পুনঃমৃত্যুর চেয়ে পুনর্জন্মের সম্ভাবনাই বেশি আতঙ্কের কারণ ছিল। জরাগ্রস্থ হওয়ার প্রক্রিয়া সহ্য করা বা ক্রমাগত অসুস্থ হতে হতে ভীতিকর ও যন্ত্রণাদায়ক মৃত্যুর মোকাবিলা একবারই যথেষ্ট খারাপ ছিল, কিন্তু বারবার এই প্রক্রিয়ার ভেতর দিয়ে যেতে বাধ্য হওয়াটা অসহনীয়, একেবারেই অর্থহীন মনে হয়েছে। মানুষকে সামসারা থেকে মুক্ত হতে সাহায্য করে চূড়ান্ত মুক্তি অর্জনের লক্ষ্যেই সে সময়ের অধিকাংশ ধর্মীয় সমাধান পরিকল্পিত হয়েছিল। নিব্বানার মুক্তি ছিল বোধের অতীত, কারণ তা আমাদের দৈনন্দিন অভিজ্ঞতা হতে বহু দূরবর্তী ছিল। হতাশা, দুঃখ বা বেদনা নেই, আবার আমাদের নিয়ন্ত্রণের অতীত উপাদানে বাঁধা নয় এমন একটা জীবনধারা বর্ণনা করার বা চিন্তা করার মতো কোনও ভাষা নেই আমাদের। কিন্তু গৌতমের আমলের সাধুরা এই স্বাধীনতাকে প্রকৃত সম্ভাবনা বলে মেনে নিয়েছিলেন। পশ্চিমা জনগণ প্রায়ই ভারতীয় চিন্তাচেতনাকে নেতিবাচক ও নাস্তিবাদী বলে বর্ণনা করে থাকে। আসলে তা নয়। এটা ছিল শ্বাসরুদ্ধকরভাবে আশাবাদী। গৌতম পরিপূর্ণভাবে এর অংশীদার ছিলেন।
খাবারের জন্যে হাত পাতে এমন একজন যাযাবর সন্ন্যাসীর গেরুয়া বসন পরে গৌতম যখন পিতৃগৃহ ত্যাগ করলেন, তাঁর বিশ্বাস ছিল উত্তেজনাকর কোনও অ্যাডভেঞ্চার নেমেছেন তিনি। তিনি ‘প্রশন্ত পথে’র প্রলোভন ও ‘গৃহহীনতা’র উজ্জ্বল, নিখুঁত অবস্থা অনুভব করেছেন। এই সময় সকলেই ‘পবিত্র জীবন’কে মহান অনুসন্ধান বলে উল্লেখ করত। রাজা, বণিক ও সম্পদশালী পরিবারগুলো সমানভাবে এই ভিক্ষুদের সম্মান করত, তাদের খাওয়ানোর সুযোগ পেতে পরস্পরের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় নামত। কেউ কেউ তাদের নিয়মিত পৃষ্ঠপোষক ও শিষ্যে পরিণত হয়েছিল। এটা কোনও উন্মাদনা ছিল না। ভারতীয় জনগণ অন্য যে কারও মতো বস্তুবাদী হতে পারে, কিন্তু আধ্যাত্মিকতা সন্ধানকারীদের সম্মান দেখানোর সুপ্রাচীন ঐতিহ্য রয়েছে তাদের। তারা তাদের সমর্থন অব্যাহত রেখেছে। তারপরও বিসিই ষষ্ঠ শতাব্দীর শেষ দিকে গাঙ্গেয় এলাকায় বিশেষ একরকম তাগিদ ছিল। মানুষ গৃহত্যাগীদের দুর্বল সমাজ-ত্যাগী হিসাবে দেখেনি। ওই অঞ্চলে আধ্যাত্মিক সংঘাত চলছিল। গৌতমের অনুভূত বিভ্রান্তি ও বৈষম্যের ব্যাপকতা ছিল। সাধারণ মানুষ একটা নতুন ধর্মের প্রয়োজন সম্পর্কে মরিয়াভাবে সচেতন ছিল। এভাবে সন্ন্যাসী এমন এক অনুসন্ধানে লিপ্ত ছিলেন যা প্রায়শঃই নিজস্ব বিশাল ক্ষতির মাধ্যমে শিষ্যদের উপকারে আসবে। শক্তি, বল ও দক্ষতা বোঝাতে গৌতমকে প্রায়শঃই বীরত্বসূচক উপমায় বর্ণনা করা হয়। তাঁকে সিংহ, বাঘ ও হিংস্র হাতির সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে। তরুণ বয়সে তাঁকে ‘সুদর্শন অভিজাতজন, দুর্ধর্ষ সেনাদলের নেতা বা হস্তি বাহিনীর প্রধান’[১২] হিসাবে কল্পনা করা হয়েছে। এই সন্ন্যাসীদের লোকে নারী-পুরুষকে দুঃখদুর্দশা থেকে মুক্ত করার লক্ষ্যে আত্মার জগতে অভিযান চালানো অগ্রগামী হিসাবে দেখত। চলমান অস্থিরতার কারণে অনেকেই একজন বুদ্ধের আগমন আকাঙ্ক্ষা করত, এমন একজন যিনি ‘আলোকপ্রাপ্ত,’ মানুষের পূর্ণ সম্ভাবনায় ‘জাগ্রত’। যিনি আকস্মিকভাবে অচেনা ও নিঃসঙ্গ হয়ে ওঠা এক জগতে শান্তির খোঁজ পেতে অন্যদের সাহায্য করতে পারবেন।