কিন্তু ব্যাপারটা তেমন ছিল না। এক সাধারণ ভারতীয় গৃহের সাংসারিক জীবন নিয়ে প্রকৃতই মোহমুক্তি ঘটেছিল গৌতমের, কিন্তু তিনি খোদ জীবনের আশা হারাননি। বরং সম্পূর্ণ উল্টো। তিনি স্থির নিশ্চিত ছিলেন, অস্তিত্বের হেঁয়ালির একটা সমাধান আছে, তিনিই সেটা উদ্ধার করতে পারবেন। গৌতম ‘পেরেলিয়ান দর্শন’ নামে পরিচিত দর্শনের অনুসারী ছিলেন, কারণ প্রাক- আধুনিক পৃথিবীর সকল সংস্কৃতির মানুষের কাছে তা সুবিদিত ছিল।[৯] ঐ জাগতিক জীবন অনিবার্যভাবে নাজুক এবং মৃত্যুর ছায়ায় এর অবস্থান, কিন্তু তা সমগ্ৰ বাস্তবতাকে তুলে ধরে না। ধারণা করা হতো মর্ত্য জীবনের সমস্ত কিছুর আরও শক্তিশালী, ইতিবাচক স্বর্গীয় অনুকৃতি রয়েছে। এখানে আমাদের সব অভিজ্ঞতাই স্বর্গীয় বলয়ের একটা আদি রূপের অনুসরণ: দেবতাদের জগৎ হচ্ছে আদি নকশা, মানবীয় বাস্তবতা যার মলিন ছায়ামাত্র। এই ধারণা প্রাচীন বিশ্বের বেশির ভাগ সংস্কৃতির মিথোলজি, আচার এবং সামাজিক প্রতিষ্ঠানসমূহ তুলে ধরে এবং আমাদের কালের অধিকতর প্রথাগত সমাজকে প্রভাবিত করে চলেছে। আধুনিক বিশ্বে আমাদের পক্ষে এমন ধারণা উপলব্ধি করা কঠিন, কারণ একে প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতায় প্রমাণ করা যাবে না; আমরা যাকে সত্যের জন্যে অনিবার্য মনে করি সেই যৌক্তিক অবলম্বনের ঘাটতি রয়েছে এর। কিন্তু এই মিথ সত্যিই আমাদের অপরিণত বোধ তুলে ধরে যে, জীবন অসম্পূর্ণ এবং এখানেই সব কিছু শেষ হতে পারে না; নিশ্চয়ই অন্য কোথাও আরও ভালো, পূর্ণাঙ্গ ও সন্তুষ্টিকর একটা কিছু আছে। নিবিড় ও আন্তরিক প্রতীক্ষা শেষে প্রায়শঃ মনে হয় আমাদের ঠিক নাগালের বাইরে কিছু একটা রয়ে গেছে। গুরুত্বপূর্ণ একটা পার্থক্যসহ এই বিশ্বাসের অংশীদার ছিলেন গৌতম। এই ‘একটা কিছু’ দেবতাদের স্বর্গীয় জগতে সীমাবদ্ধ, এটা বিশ্বাস করেননি তিনি। তাঁর বিশ্বাস ছিল, দুঃখ-দুর্দশা, শোক ও যন্ত্রণা-ভরা মরণশীল এই জগতেই তিনি একে প্রদর্শনযোগ্য বাস্তবতায় পরিণত করতে পারবেন।
এভাবে নিজেকে যুক্তি দেখিয়েছেন তিনি, আমাদের জীবনে ‘জন্ম, জরা, অসুস্থতা, মৃত্যু, দুঃখ আর দুর্নীতি’ থাকলে এইসব দুঃখ-দুর্দশার ইতিবাচক প্রতিরূপ থাকতেও বাধ্য; সুতরাং অস্তিত্বের আরেকটি ধরণ আছে। সেটা আবিষ্কার করাই তাঁর কাজ। ‘ধরা যাক,’ বলেছেন তিনি, ‘আমি যদি অজাত, অজর, অসুখহীন, মৃত্যুহীন, দুঃখহীন, অবিকৃত ও এই বন্ধন হতে পরম মুক্তির সন্ধান শুরু করি?’ পরিপূর্ণ সন্তুষ্টিকর এই অবস্থাকে তিনি বললেন নিব্বানা (‘নির্বাপিত হওয়া’)।[১০] গৌতমের দৃঢ় বিশ্বাস ছিল, আমরা যেভাবে ফুঁ দিয়ে অগ্নিশিখা নিভিয়ে দিই ঠিক তেমনি মানবাত্মার এত দুঃখ-কষ্টের কারণ আবেগ, সম্পর্ক ও মোহকে ‘নির্বাপিত’ করা সম্ভব। নিব্বানা লাভ অনেকটা আমরা জ্বর হতে সেরে ওঠার পর যেমন ‘ঠাণ্ডা’ অনুভব করি অনেকটা সেকরম: গৌতমের আমলে সম্পর্কিত বিশেষণ নিব্বুতা দৈনন্দিন খিঁচুনি বোঝাতে ব্যবহৃত শব্দ ছিল। তো গৌতম গৃহত্যাগ করছিলেন মানুষকে আক্রান্তকারী অসুস্থতার একটা প্রতিকারের খোঁজে যা নারী ও পুরুষকে অসুখে পূর্ণ করে রাখে। জীবনকে এমন হতাশাব্যঞ্জক ও দুঃসহ করে তোলা এই সর্বজনীন দুঃখদুর্দশা চিরকাল বয়ে বেড়ানো আমাদের নিয়তি নয়। আমাদের জীবনের অভিজ্ঞতা বর্তমানে ভ্রান্তিময় হলেও, আদিরূপের আইন অনুযায়ী অস্তিত্বের আরেকটা রূপ নিশ্চয়ই আছে যা ত্রুটিপূর্ণ ও ক্ষণস্থায়ী নয়। ‘এমন কিছু আছে যা সাধারণভাবে জন্ম নেয় না, যেটা সৃষ্টও নয় আবার যা অক্ষত থেকে যায়,’ পরবর্তী জীবনে জোর দিয়ে বলবেন গৌতম। ‘এর অস্তিত্ব না থাকলে, উদ্ধার পাওয়ার উপায় বের করা অসম্ভব হয়ে দাঁড়াবে।’[১১]
আধুনিক কেউ তাঁর এমনি আনাড়ি আশাবাদে হাসতে পারেন, চিরকালীন আদিরূপের মিথকে সম্পূর্ণ আজগুবি মনে করতে পারেন। কিন্তু গৌতম দাবি করেছেন, উদ্ধারের পথ পেয়েছেন তিনি, সুতরাং নিব্বানার অস্তিত্ব ছিল। অবশ্য বহু ধর্মীয় ব্যক্তির মতো তিনি এই মহৌষধকে অতিপ্রাকৃত মনে করেননি। অন্য জগৎ হতে স্বর্গীয় সহায়তার ওপর নির্ভর করেননি তিনি। বরং তাঁর স্থির বিশ্বাস ছিল, নিব্বানা এমন একটা অবস্থা যা মানব সন্তানের পক্ষে সম্পূর্ণ স্বাভাবিক। যে কোনও প্রকৃত সন্ধানীই এর দেখা পাবে। গৌতম বিশ্বাস করেছেন এই অসম্পূর্ণ জগতেই তিনি তাঁর কাঙ্ক্ষিত স্বাধীনতা পাবেন। দেবতাদের বার্তার অপেক্ষায় না থেকে উত্তরের খোঁজে নিজের মাঝে সন্ধান চালাবেন, মনের দূরতম কন্দরে ঢুকবেন এবং তাঁর সকল শারীরিক সম্পদ কাজে লাগাবেন। শিষ্যদের একই কাজ করতে বলবেন তিনি। জোর দিয়ে বলবেন, কেউ যেন তাঁর শিক্ষাকে জনশ্রুতি ধরে না নেয়। তাদের অবশ্যই নিজস্ব অভিজ্ঞতা দিয়ে তাঁর সমাধানের সত্যতা প্রমাণ করতে হবে। নিজেদেরই বের করতে হবে যে, তাঁর পদ্ধতি ফল দেয়। দেবতাদের কাছ থেকে কোনও সাহায্য প্রত্যাশা করতে পারবে না তারা। দেবতাদের অস্তিত্ব আছে, বিশ্বাস করতেন গৌতম, কিন্তু তাঁদের ব্যাপারে তেমন আগ্রহী ছিলেন না। এখানেও তাঁর সময় ও সংস্কৃতিরই মানুষ ছিলেন তিনি। ভারতীয় জনগণ অতীতে দেবতাদের পূজা করেছে: বনদেবতা ইন্দ্র; স্বর্গীয় শৃঙ্খলার রক্ষক বরুণ; অগ্নিদেবতা অগ্নি। কিন্তু ষষ্ঠ শতাব্দী নাগাদ এইসব দেবতা অধিকাংশ চিন্তাশীল মানুষের ধর্মীয় সচেতনতা থেকে হারিয়ে যেতে শুরু করেছিলেন। তাদেরকে ঠিক মূল্যহীন হিসাবে দেখা হতো না, কিন্তু পূজা-অর্চনার পাত্র হিসাবে অপর্যাপ্ত হয়ে গিয়েছিলেন। মানুষ ক্রমবর্ধমান হারে সচেতন হয়ে উঠছিল যে, দেবতারা তাদের প্রকৃত ও যথার্থ সাহায্য করতে পারবেন না। তাঁদের সম্মানে প্রদত্ত উৎসর্গ আসলে মানবীয় দুর্দশা প্রশমিত করেনি। অধিক হারে নারী-পুরুষ পুরোপুরি নিজেদের ওপর নির্ভর করার সিদ্ধান্ত নিচ্ছিল। তাদের বিশ্বাস ছিল সৃষ্টি জগৎ নৈর্ব্যক্তিক আইনে শাসিত হয়, দেবতারাও যার অধীন। দেবতারা গৌতমকে নিব্বানার পথ দেখাতে পারবেন না, তাঁকে আপন প্রয়াসের ওপর নির্ভর করতে হবে।