সিদ্ধান্তটা রোমান্টিক ছিল। কিন্তু তাঁর ভালোবাসার পাত্রদের জন্যে দারুণ বেদনার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল সেটা। গৌতমের মা-বাবা, পরে স্মৃতিচারণ করেছেন তিনি, আদরের সন্তানকে সাধুদের পোশাকে পরিণত হওয়া গেরুয়া জোব্বা গায়ে চাপিয়ে মাথা আর দাড়িগোঁফ কামাতে দেখে কান্নায় ভেঙে পড়েছিলেন।[৪] কিন্তু আমাদের এও বলা হয়েছে যে, বিদায় নেওয়ার আগে ঘুমন্ত স্ত্রী ও ছেলেকে এক নজর দেখবেন বলে জন্যে লুকিয়ে ওপরতলায় ওঠেন তিনি, কিন্তু কোনও রকম বিদায় সম্ভাষণ ছাড়াই আবার সেখান থেকে সরে আসেন।[৫] যেন স্ত্রী থেকে যাবার জন্যে কাকুতি-মিনতি শুরু করলে আপন সিদ্ধান্তে অটল থাকার ব্যাপারে নিজেকে বিশ্বাস করতে পারেননি। এটাই সমস্যার মূল। বনবাসী বহু সন্ন্যাসীর মতো তিনিও বিশ্বাস করতেন যে, দুঃখ ও বেদনায় ভরপুর এক অস্তিত্বের সঙ্গে বন্দিকারী বস্তু ও মানুষের সঙ্গে সম্পর্কই তাঁকে যন্ত্রণা ও দুঃখের সাথে বেঁধে দিয়েছে। সন্ন্যাসীদের কেউ কেউ পচনশীল জিনিসের প্রতি আবেগ ও আকাঙ্ক্ষাকে আত্মাকে টেনে নামানো মহাবিশ্বের সর্বোচ্চ চূড়ায় উঠে যাওয়া থেকে বিরত রাখা ‘ধুলিকণার’ সঙ্গে তুলনা করেছেন। নিজের বাড়িকে ‘ধূলিময়’ বর্ণনা করার সময় সম্ভবত এমন কিছুই বুঝিয়েছেন সিদ্ধার্থ। তাঁর বাবার বাড়ি মোটেই নোংরা ছিল না, কিন্তু তাঁর হৃদয়ে টান সৃষ্টিকারী মানুষে ও তাঁর চোখে মূল্যবান জিনিসপত্রে ছিল পরিপূর্ণ ছিল। পবিত্রতায় বসবাস করতে চাইলে তাঁকে এইসব বাঁধন ছিন্ন করে মুক্ত হতেই হবে। একেবারে গোড়া থেকেই সিদ্ধার্থ গৌতম ধরে নিয়েছিলেন সাংসারিক জীবন আধ্যাত্মিকতার সর্বোচ্চ পর্যায়ের সঙ্গে মানানসই নয়। এটা কেবল ভারতের অন্যান্য সাধুদের ধারণা ছিল না, বরং জেসাসও এমনটাই মনে করতেন। পরবর্তীকালে তিনি শিষ্যদের বলেছেন তাঁকে অনুসরণ করতে চাইলে অবশ্যই স্ত্রী-সন্তান ত্যাগ করতে হবে; পরিত্যাগ করতে হবে বয়োজ্যেষ্ঠ আত্মীয়দের।[৬]
সুতরাং আমাদের চলতি ‘পারিবারিক মূল্যবোধের’ বিশ্বাসের সঙ্গে একমত হতেন না গৌতম। পৃথিবীর অন্যান্য অংশে কুনফুসিয়াস (৫৫১-৪৭১) এবং সক্রেটিসের মতো তাঁর সমসাময়িক বা প্রায় সমসাময়িক ব্যক্তিরাও তাই। অবশ্যই সংসারি ছিলেন না তাঁরা, কিন্তু এই সময়কালে মানুষের দার্শনিক ও আধ্যাত্মিক উন্নতির প্রধান ব্যক্তিতে পরিণত হয়েছিলেন। কেন এই প্রত্যাখ্যানের প্রবণতা? পরবর্তী সময়ের বুদ্ধ ধর্মগ্রন্থসমূহ গৌতমের সংসার ত্যাগ ও তাঁর গৃহহীনতার পথে ‘অগ্রসর হওয়ার’ বিস্তারিত পৌরাণিক বিবরণ গড়ে তুলবে। বর্তমান অধ্যায়ের শেষ দিকে আমরা সেসব বিবেচনা করব। কিন্তু পালি লিপির প্রথম দিকের টেক্সটসমূহ তরুণের সিদ্ধান্তের প্রত্যক্ষ বর্ণনা তুলে ধরে। মানুষের জীবনের দিকে তাকিয়ে গৌতম কেবলই দুঃখ-কষ্টের এক করুণ চক্র দেখতে পেয়েছেন। জন্ম-যন্ত্রণা দিয়ে যার শুরু এবং যা অনিবার্যভাবে ‘জরা, অসুস্থতা, মৃত্যু, বিষাদ ও বিকৃতির’[৭] দিকে এগিয়ে যায়। এই সর্বজনীন নিয়মের কোনও ব্যতিক্রম নন তিনি। এখন তিনি তরুণ, স্বাস্থ্যবান এবং সুদর্শন, কিন্তু যখনই আসন্ন ক্লেশের কথা ভাবতে যান, তারুণ্যের সমস্ত আনন্দ ও আস্থা তাঁকে ছেড়ে যায়। বিলাসী জীবনযাত্ৰা অর্থহীন, তুচ্ছ মনে হয়। জরাগ্রস্ত কোনও বৃদ্ধ পুরুষ বা ঘৃণ্য কোনও রোগে বিকৃত হয়ে যাওয়া কাউকে দেখে ‘বিদ্রোহী’ হয়ে ওঠার অনুভূতি মানিয়ে উঠতে পারেন না। একই নিয়তি–কিংবা এর চেয়ে খারাপ কিছু–তাঁর ও তাঁর প্রিয়জনের উপর পতিত হবে।[৮] তাঁর বাবা-মা, শিশু-পুত্রসহ স্ত্রী, বন্ধুবান্ধব সবাই সমান নাজুক ও দুর্বল। ওদের আঁকড়ে ধরে ভালোবাসায় আকৃষ্ট হওয়ার সময় আবেগের সাথে এমন কিছুতে নিজেকে জড়াচ্ছেন যা কেবল দুঃখ বয়ে আনতে পারে। স্ত্রী সৌন্দর্য হারাবে, ছোট্ট রাহুলা আগামীকালই মারা যেতে পারে। মরণশীল, ক্ষণস্থায়ী বস্তুর মাঝে সুখের সন্ধান কেবল অযৌক্তিকই নয়: ভালোবাসার পাত্র ও নিজের জন্যে অপেক্ষমান দুঃখ-দুর্দশা বর্তমানের ওপর গভীর ছায়া ফেলেছে, এইসব সম্পর্কের সমস্ত আনন্দ কেড়ে নিয়েছে।
কিন্তু জগতকে এমন বিবর্ণ রূপে কেন দেখেছেন গৌতম? মরণশীলতা জীবনের এমন এক সত্য যা সহ্য করা কঠিন। মানুষই একমাত্র প্রাণী যারা একদিন মারা যেতে হবে জেনে জীবন ধারণ করে। বিলুপ্তির এই দর্শন নিয়ে চিন্তা করা সব সময়ই তার কাছে কঠিন ঠেকে। কেউ কেউ স্রেফ বালিতে মাথা লুকিয়ে জগতের দুঃখের কথা ভাবতে অস্বীকার যায়। কিন্তু এটা অবশ্যই সঠিক নয়, কারণ আমরা পুরোপুরি অপ্রস্তুত অবস্থায় থাকলে জীবনের ট্র্যাজিডি বিপর্যয়কর হয়ে দাঁড়াতে পারে। প্রাচীন কাল থেকেই নারী-পুরুষ হতাশাব্যাঞ্জক ভিন্নরকম প্রমাণ থাকা সত্ত্বেও আমাদের অস্তিত্বের পরম অর্থ ও মূল্য আছে এমন একটা বোধের চর্চা করার জন্যে ধর্মের উৎপত্তি ঘটিয়েছিল। কিন্তু মাঝে মাঝে বিশ্বাসের মিথ ও অনুশীলনকে অবিশ্বাস্য ঠেকে। মানুষ তখন নিত্য নৈমিত্তিক জীবনের ক্লেশের ঊর্ধ্বে ওঠার জন্যে অন্য উপায়ের আশ্রয় নেয়: শিল্পকলা, সঙ্গীত, যৌনতা, খেলাধুলা কিংবা দর্শন। আমরা খুব সহজে হতাশ হয়ে পড়ি আবার আমরাই জীবন যে ভালো কিছু, নিজেদের মাঝে সেই আস্থা সৃষ্টিতে কঠোর পরিশ্রম করি, যদিও চারপাশে যন্ত্রণা, নিষ্ঠুরতা, অসুস্থতা আর অনাচারই দেখতে পাই কেবল। গৃহত্যাগের সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় কেউ হয়তো ভাবতে পারে গৌতম বুদ্ধ জীবনের তিক্ত বাস্তবতার সঙ্গে মানিয়ে চলার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছিলেন; পরিণত হয়েছিলেন এক গভীর বিষণ্নতার শিকার।