আনন্দের কান্নার সংবাদ পেয়ে তাঁকে ডেকে পাঠালেন বুদ্ধ। ‘যথেষ্ট হয়েছে, আনন্দ,’ বললেন তিনি। ‘বিষণ্ন হয়ো না। দুঃখ করো না।’ তিনি কি বারবার ব্যাখ্যা করেননি যে কোনও কিছুই স্থায়ী নয়, বরং বিচ্ছেদই জীবনের বিধান? ‘আর আনন্দ,’ উপসংহার টানলেন বুদ্ধ, ‘বহু বছর অন্তহীন ভালোবাসা ও দরদ দিয়ে আমার সেবা করেছ তুমি। আমার শারীরিক প্রয়োজনের দিকে খেয়াল রেখেছ। তোমার কথা চিন্তায় সমর্থন যুগিয়েছে। তুমি পূণ্য অর্জন করেছ, আনন্দ। চেষ্টা চালিয়ে যাও। তুমিও শিগগিরই আলোকপ্রাপ্ত হবে।[২৯]
কিন্তু তখনও সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছেন আনন্দ। ‘প্রভু,’ চেঁচিয়ে উঠলেন তিনি, ‘এই ভয়ঙ্কর ছোট শহরে চূড়ান্ত বিশ্রামে যাবেন না। এখানে মাটির দেয়াল, এই বিধর্মী জংলী, বিরান এলাকায়।’ জীবনের অধিকাংশ সময় রাজাগহ, কোসাম্বি, সাবস্তি ও বারানসির মতো বিরাট শহরে কাটিয়েছেন বুদ্ধ। এখানে একাকী, এই অবিশ্বাসীদের মাঝে মৃত্যুবরণ না করে সেগুলোরই কোনও একটায় ফিরে অভিজাত অনুসারীদের মাঝে অনুসন্ধান শেষ করতে পারবেন না কেন? টেক্সট দেখায়, আদি সংঘ কুশিনারার অস্পষ্টতা ও তাদের গুরুর দূরে জঙ্গলে মারা যাওয়ার ব্যাপারে বিব্রত ছিল। কুশিনারা এককালে সমৃদ্ধ শহর ও একজন চক্কবত্তীর রাজধানী ছিল বলে আনন্দকে চাঙ্গা করার চেষ্টা করলেন বুদ্ধ। কিন্তু কুশিনারাকে বেছে নেওয়ার পেছনে বুদ্ধের নিশ্চয়ই গভীরতর কোনও কারণ ছিল। কোনও বৌদ্ধ অতীত অর্জনের ওপর নির্ভর করে থাকতে পারে না। সংঘকে সব সময় বিস্মৃত বিশ্বে সাহায্য পৌঁছে দিতে সামনে যেতে হবে। একজন বুদ্ধ কোনও আলোকিত মানুষের দৃষ্টিতে কুশিনারার মতো ছোট হতদরিদ্র শহরকে দেখবেন না। বহু বছর ধরে তিনি তাঁর মুক্ত সম্পূর্ণ ভিন্ন দৃষ্টিকোণ হতে বাস্তবতাকে দেখার প্রশিক্ষণ দিয়ে এসেছেন। আমাদের অনেকেই সত্তার বোধ ফাঁপিয়ে তোলার জন্যে যে বাহ্যিক মর্যাদার ওপর নির্ভর করি তাঁর সেটা প্রয়োজন ছিল না। তথাগত হিসাবে তাঁর অহমবাদ ‘বিদায় নিয়েছিল।’ একজন বুদ্ধের নিজের কথা ভাববার সময় নেই, মৃত্যু শয্যায়ও না। একেবারে শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত অন্যের জন্যে বেঁচে ছিলেন তিনি। তাঁর বিজয়ের অংশী হতে কুশিনারার মাল্লয়ীদের বনে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন। এক পথচারী ভিক্ষুকেও নির্দেশনা দিতে সময় ব্যয় করেছেন। অন্য গোত্রের অনুসারী হলেও বুদ্ধের শিক্ষার প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিলেন এই ভিক্ষু, বুদ্ধ অসুস্থ ও ক্লান্ত বলে আনন্দের প্রতিবাদ সত্ত্বেও।
অবশেষে আনন্দের দিকে ফিরলেন তিনি। স্বাভাবিক সহানুভূতি দিয়ে তাঁর চিন্তায় প্রবেশ করেছেন। ‘তুমি হয়তো ভাবছ, আনন্দ’: ‘গুরুর বাণী এখন অতীতের কথা: এখন আর আমাদের কোনও গুরু নেই।’ কিন্তু ব্যাপারটা এভাবে দেখা ঠিক হবে না। আমি বিদায় নেওয়ার পর তোমাকে যে ধম্ম আর অনুশীলন শিক্ষা দিয়েছি তাকেই গুরুর আসনে বসাও।[৩০] সবসময়ই অনুসারীদের তাঁর নয়, বরং ধম্মের মুখাপেক্ষী হতে বলেছেন তিনি। তিনি নিজে কখনও গুরুত্বপূর্ণ ছিলেন না। অন্তিম যাত্রার সঙ্গী ভিক্ষুদের দিকে ফিরলেন এরপর। আরও একবার তাদের মনে করিয়ে দিলেন, ‘প্রতিটি জিনিস হারিয়ে যাবে। আন্তরিকতার সঙ্গে তোমাদের মুক্তির অন্বেষণ করো।[৩১]
অনুসারীদের শেষ পরামর্শ দেওয়ার পর অচেতন হয়ে পড়লেন বুদ্ধ। সন্ন্যাসীদের কেউ কেউ চেতনার উচ্চতর স্তর হয়ে তাঁর যাত্রা অনুসরণ করতে সক্ষম হলেন যা তিনি ধ্যানমগ্ন অবস্থায় প্রায়ই করতেন। কিন্তু ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য অভিজ্ঞতায় প্রভাবিত মন বিশিষ্ট কারও চেনা অবস্থার অতীতে চলে গিয়েছিলেন তিনি। দেবতাগণ আনন্দ-উল্লাস করার সময় কম্পিত হয়েছে পৃথিবী। আলোকপ্রাপ্ত হননি যেসব ভিক্ষু কেঁদেছেন তারা। এমন এক বিলুপ্তির অভিজ্ঞতা লাভ করেছেন বুদ্ধ যা বৈপরীত্যমূলকভাবে সত্তার পরম স্তর ও মানুষের মোক্ষ।
দমকা হাওয়ায় নেভা শিখা
যেমন বিশ্রামে যায়, সংজ্ঞায়িত করা যায় না।
তেমনি আলোকপ্রাপ্তজন স্বার্থপরতা হতে মুক্ত
অবকাশে যান, সংজ্ঞায়িত করা যাবে না।
সকল কল্পনার অতীতে–
ভাষার শক্তির অতীতে গমন করেছেন।[৩২]
শেষ
তথ্যসূত্র
১. সাম্যত্তা নিকয়া, ৩: ২৫।
২. মাজহিমা নিকয়া, ৮৯।
৩. ভিক্ষু নানামোলি (অনু. ও সম্পা.), দ্য লাইফ অভ দ্য বুদ্ধা, অ্যাকর্ডিং টু দ্য পালি ক্যানন, কান্ডি, শ্রী লঙ্কা, ১৯৭২, ২৮৫ (ধারাভাষ্যে রয়েছে এই কাহিনী, লিপিতে নয়। )
৪. মাজহিমা নিকয়া, ১০৪।
৫. বিনয়া: কুলাভাগ্য, ৭: ২।
৬. প্রাগুক্ত, ৭: ৩।
৭. প্রাগুক্ত।
৮. প্রাগুক্ত।
৯. প্রাগুক্ত।
১০. প্রাগুক্ত।
১১. প্রাগুক্ত।
১২. প্রাগুক্ত, ৭: ৫।
১৩. দিঘা নিকয়া, ১৬।
১৪. প্রাগুক্ত।
১৫. প্রাগুক্ত।
১৬. প্রাগুক্ত।
১৭. প্রাগুক্ত, সাম্যত্তা নিকয়া, ৪৭: ৯।
১৮. দিঘা নিকয়া, ১৬; আঙুত্তারা নিয়া, ৮: ১০।
১৯. প্রাগুক্ত, ৪৭: ১৪।
২০. দিঘা নিকয়া, ১৬; আঙুত্তারা নিকয়া, ৮: ১০।
২১. দিঘা নিকয়া, ১৬।
২২. প্রাগুক্ত।
২৩. নানামোলি, লাইফ অভ বুদ্ধা, ৩৫৭-৫৮।
২৪. মাইকেল এডওয়ার্ডস, ইন দ্য ব্লোইং আউট অভ আ ফ্লেইম: দ্য ওঅর্ল্ড অভ দ্য বুদ্ধা অ্যান্ড দ্য ওঅর্ল্ড অভ ম্যান, লন্ডন, ১৯৭৬, ৪৫।