প্রকৃতপক্ষে নিব্বানা অনেকাংশেই খোদ বুদ্ধের মতোই। মহায়না মতবাদের অনুসারী পরবর্তী কালের বৌদ্ধরা দাবি করবে, তিনি নিব্বানায় এমন ওতপ্রোতভাবে মিশে গিয়েছিলেন তাঁরা হয়ে পড়েছিলেন অবিচ্ছেদ্য। ঠিক ক্রিশ্চানরা যেমন মানুষ জেসাসকে নিয়ে চিন্তা করার সময় ঈশ্বর কেমন হতে পারেন উপলব্ধি করতে পারে, তেমনি বৌদ্ধরাও বুদ্ধকে এই অবস্থার মানবীয় রূপ হিসাবে দেখতে পায়। এমনকি তাঁর জীবনেই মানুষ এর আভাস লাভ করেছে। যে ব্রাহ্মণ বুদ্ধকে কোনও শ্রেণীতে ফেলতে পারেননি, যেহেতু তিনি জাগতিক বা স্বর্গীয় শ্রেণীতে খাপ খাননি, তিনি অনুভব করেছেন যে নিব্বানার মতো বুদ্ধ ‘ভিন্ন কিছু।’ বুদ্ধ তাঁকে বলেছিলেন, তিনি হচ্ছেন ‘যে জেগে উঠেছে,’ এমন একজন মানুষ যিনি ইহজাগতিক মানুষের ভীতিকর, বেদনাময় সীমাবদ্ধতা ঝেড়ে ফেলে বাইরের কিছু অর্জন করেছেন। রাজা পাসেনেদিও বুদ্ধকে আশ্রয়, নিরাপত্তা ও বিশুদ্ধতার একটা স্থান হিসাবে দেখেছেন। গৃহ ত্যাগ করার পর তিনি আপন অন্তরে শান্তির এই নতুন অঞ্চল আবিষ্কার না করা পর্যন্ত মানবীয় প্রকৃতি নিয়ে গবেষণা করেছেন। কিন্তু তিনি অনন্য ছিলেন না। পবিত্র জীবনে গুরুত্বের সঙ্গে অংশগ্রহণকারী যে কেউ নিজের মাঝে এই স্বৰ্গীয় প্রশান্তি লাভ করতে পারে। পঁয়তাল্লিশ বছর অহমহীন মানুষ হিসাবে জীবন কাটিয়েছেন বুদ্ধ। সুতরাং, তিনি বেদনার সঙ্গে বসবাসে সক্ষম ছিলেন। কিন্তু এখন জীবনের অন্তিম প্রান্তের দিকে যখন এগিয়ে যাচ্ছেন, বয়সের শেষ অসম্মানটুকুও ঝেড়ে ফেলবেন। তরুণ বয়সে লোভ ও বিভ্রমের কারণে জ্বলন্ত ‘জ্বালানি কাঠ,’ খণ্ড বহুদিন আগেই নির্বাপিত হয়েছে। এখন তা ছুঁড়ে ফেলে দেওয়া যাবে। তিনি অপর পারে পৌঁছাতে যাচ্ছেন। তো দুর্বল কিন্তু আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে অজানা ছোট শহরের দিকে এগিয়ে চললেন তিনি যেখানে পরিনিব্বনা লাভ করবেন।
বুদ্ধ ও আনন্দ, দুজন বৃদ্ধ ভিক্ষুদের মিছিলসহ হিরন্নবতী নদী পেরিয়ে কুশিনারা মুখী পথের এক শালবনে প্রবেশ করলেন। ততক্ষণে বেদনায় আক্রান্ত হয়েছেন বুদ্ধ। শুয়ে পড়লেন তিনি। সঙ্গে সঙ্গে ফুলে ফুলে ভরে উঠল শালবন, পাঁপড়ি ঝরাতে শুরু করল, যদিও সেটা ফুল ফোঁটার মৌসুম ছিল না। দেবতায় ভরে গেল জায়গাটা। বুদ্ধ বললেন, তাঁর শেষ বিজয় দেখতে এসেছেন তাঁরা। কিন্তু বুদ্ধকে বেশি সম্মান দিয়েছিল অনুসারীদের তিনি যে ধৰ্ম্ম এনে দিয়েছিলেন তার প্রতি তাদের আনুগত্য।
মৃত্যুপথযাত্রী বুদ্ধ তাঁর অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া সংক্রান্ত নির্দেশনা দান করলেন : তাঁর দেহভষ্মকে চক্কবত্তীর দেহভষ্মের মতো করে দেখতে হবে;মরদেহ কাপড়ে মুড়ে সুগন্ধী কাঠের আগুনে পোড়াতে হবে, তারপর দেহাবশেষ কোনও বৃহৎ নগরের প্রধান চত্বরে কবর দিতে হবে। গোড়া থেকে শেষ পর্যন্ত বুদ্ধকে চক্কবত্তীর সাথে তুলনা করা হয়েছে এবং আলোকন লাভের পর জগতকে নিপীড়ন আগ্রাসনভিত্তিক ক্ষমতার ভিত্তির বিকল্প প্রস্তাব দিয়েছিল। অন্তে ্যষ্টিক্রিয়ার ব্যবস্থা এই বিচিত্র বিপরীত বৈশিষ্ট্যের দিকে ইঙ্গিত করে। তরুণ গৌতম যখন মগধ ও কোসালায় আসেন তখন যে রাজাদের এমন ক্ষমতাধর মনে হয়েছিল, তাঁরা দুজনই শেষ হয়ে গেছেন। তাঁদের মৃত্যুর সহিংসতা ও নিষ্ঠুরতা দেখিয়েছে যে রাজ্যগুলো স্বার্থপরতা, লোভ উচ্চাভিলাষ, হিংসা, ঘৃণা ও ধ্বংস নিয়ে চালিত হয়েছে। সেগুলো সমৃদ্ধি ও সংস্কৃতিক অগ্রগতি বয়ে এনেছিল; উন্নয়নের ধারা তুলে ধরেছে ও বহু মানুষের উপকার সাধন করেছে। কিন্তু অন্য আরেক ধরনের জীবন ছিল যা এমন সহিংসভাবে নিজেকে চাপিয়ে দেয়নি, যা সত্তাকে ক্ষমতাবান করে তোলার জন্যে নিবেদিত ছিল না এবং যা আধুনিক নারী-পুরুষকে আরও সুখী, আরও মানবিক করে তুলেছে।
অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার আয়োজন আনন্দের সহ্যের অতীত হয়ে পড়েছিল। শেষের এই দিনগুলোয় তাঁর কষ্ট আমাদের একজন অনালোকিত ও আরাহান্তকে বিচ্ছিন্ন করে রাখা বিপুল দূরত্বের কথা মনে করিয়ে দেয়। বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে বৌদ্ধ মতবাদ সম্পর্কে সবই জানতেন আনন্দ। কিন্তু এই জ্ঞান যোগির ‘প্রত্যক্ষ জ্ঞানের’ বিকল্প হতে পারে না। মনিবকে হারানোর বেদনা বোধ করার সময় কোনও কাজে আসবে না তা। সারিপুত্তের মৃত্যুর চেয়েও সীমাহীন খারাপ এই বেদনা। জাগতিক, যৌক্তিক মন দিয়ে ভোগান্তির মহান সত্য বুঝতে পেরেছিলেন তিনি। কিন্তু সেটা এমনভাবে আত্মস্থ করেননি যে সকল সত্তার সঙ্গে মিশে থাকবে। এখনও তিনি মেনে নিতে পারেননি যে সমস্ত কিছুই ক্ষণস্থায়ী, একসময় হারিয়ে যাবে। কারণ তিনি কুশলী যোগি ছিলেন না। তিনি এইসব মতবাদে ‘প্রবেশ’ করতে পারেননি, জীবিত বাস্তবতায় পরিণত করতে পারেননি এগুলোকে। যোগিদের মতো নিশ্চিন্ত বোধ করার বদলে কেবল তীব্র বেদনা বোধ করেছেন। আপন দেহভষ্ম সম্পর্কে বুদ্ধের নিরাসক্ত নির্দেশনা শোনার পর মনিবের বিছানার পাশ হতে উঠে গেলেন আনন্দ, পালালেন বনের অন্য একটা কুঁড়ের দিকে। দীর্ঘ সময় দেয়ালে মাথা ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কাঁদলেন। সম্পূর্ণ ব্যর্থ মনে হলো নিজেকে; ‘এখনও নবীশ রয়ে গেছি আমি, ‘ কাঁদলেন প্রবীন ভিক্ষু। ‘পবিত্র জীবনের লক্ষ্যে পৌঁছতে পারিনি। আমার অনুসন্ধান অপূর্ণ রয়ে গেছে।’ আধ্যাত্মিক মহীরুহদের মাঝে জীবন কাটিয়েছেন তিনি। এখন কে তাঁকে সাহায্য করবে? কে তাঁকে নিয়ে মাথা ঘামাতে যাবে? ‘আমার মনিব পরিনিব্বানা লাভ করতে যাচ্ছেন-আমরা দরদী মনিব, আমার প্রতি সবসময় দয়া দেখিয়েছেন যিনি।’