কিন্তু পালি টেক্সট এমনকি এই ভীতিকর সম্ভাবনা বিবেচনায়ও আনেনি I কুণ্ডকে খাবার মাটি চাপা দেওয়ার বুদ্ধের অনুরোধ অদ্ভুত ছিল। কিন্তু কিছুদিন ধরে অসুস্থ ছিলেন তিনি। অচিরেই মারা যাবেন বলে প্রত্যাশিত ছিল। সেরাতে রক্তবমি শুরু করেন তিনি, তীব্র, যন্ত্রণায় আক্রান্ত হন, কিন্তু আবারও অসুস্থতা সামলে আনন্দকে নিয়ে কুশিনারার পথ ধরেন। এখন মাল্লা প্রজাতন্ত্রের সীমানায় ছিলেন তিনি। এখানকার অধিবাসীরা বুদ্ধের ধারণার প্রতি তেমন আগ্রহী ছিল বলে মনে হয় না। টেক্সট আমাদের বলছে, সন্ন্যাসীদের স্বাভাবিক দল ছিল তাঁর সঙ্গে, কিন্তু আনন্দ বাদে সংগঠনের কোনও প্রবীন সদস্য তাঁর সঙ্গে ছিলেন না। কুশিয়ানারার পথে ক্লান্ত হয়ে পড়েন বুদ্ধ, পানি খেতে চান। নদী স্থবির ও দুর্গন্ধময় হওয়া সত্ত্বেও বুদ্ধের পাত্র নিয়ে আনন্দ এগিয়ে যাওয়ামাত্র পানি স্বচ্ছ টলটলে হয়ে ওঠে। ধর্মগ্রন্থসমূহ শেষের এই দিনগুলোর মলিন নিঃসঙ্গতা চাপা দিতে এইসব ঘটনার প্রতি জোর দিয়েছে। আমরা জানতে পারি, যাত্রার শেষ পর্যায়ে একজন মাল্লিয় পথিককে দীক্ষা দেন বুদ্ধ। লোকটা মানানসইভাবে তার পুরোনো গুরু আলারা কালামের অনুসারী ছিল। বুদ্ধের মনোসংযোগের মান দেখে মানুষটি এত মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিল যে সেখানেই সে ত্রিসীমা আশ্রয় নির্মাণ করে এবং বুদ্ধ ও আনন্দকে সোনার কাপড়ের দুটো জোব্বা উপহার দেয়। কিন্তু বুদ্ধ তাঁর জোব্বা পরার পর আনন্দ চেঁচিয়ে বলে উঠলেন যে তাঁর উজ্জ্বল চামড়ার তুলনায় ওটাকে একেবারেই মলিন লাগছে: বুদ্ধ ব্যাখ্যা করলেন যে এটা তিনি যে অচিরেই-কুশিনারায় পৌঁছার পর-চূড়ান্ত নিব্বানা লাভ করবেন সেই চিহ্ন। খানিক পরে আনন্দকে বললেন তাঁর মৃত্যুর জন্যে কেউ যেন কুণ্ডকে দায়ী না করে: পরিনিব্বানা লাভের আগে বুদ্ধকে শেষ খাদ্য যোগানো বিরাট পূণ্যের কাজ।[২৫]
এই পরিনিব্বান। আসলে কী? এটা কি স্রেফ বিলুপ্তি? যদি তাই হয়, তাহলে শূন্যতাকে কেন এমন মহৎ অর্জন হিসাবে দেখা হয়েছে? এই ‘চূড়ান্ত’ নিব্বানা বোধি রক্ষের নিচে বুদ্ধ যে প্রশান্তি লাভ করেছিলেন তার চেয়ে আলাদা হবে কেমন করে? স্মরণযোগ্য, ‘নিব্বানা’ শব্দটির মানে ‘শীতল হওয়া’ বা কোনও শিখার মতো ‘নিভে যাওয়া’। টেক্সট বর্তমান জীবনে নিব্বানা অর্জনের পরিভাষা হচ্ছে সা-উপদি-সেসা। একজন আরাহান্ত আকাঙ্ক্ষা, ঘৃণা ও অজ্ঞতার আগুন নিভিয়ে ফেলেছেন, কিন্তু এখনও তার মাঝে ‘জ্বালানি’র (উপদি) ‘অবশিষ্ট’ (সেসা) রয়ে গেছে, যতক্ষণ তিনি দেহে অবস্থান করছেন, মন আর ইন্দ্রিয় কাজে লাগাচ্ছেন ও আবেগ অনুভব করছেন আরও জ্বালানোর একটা সম্ভাবনা রয়ে গেছে। কিন্তু একজন আরাহান্ত যখন মারা যান এই খণ্ড আর জ্বলে উঠতে পারে না, ফলে নতুন অস্তিত্বের শিখা প্রজ্জ্বলিত করতে পারে না।[২৬] সুতরাং আরাহান্ত সামসারা হতে মুক্ত এবং নিব্বানার শান্তি ও প্রতিরক্ষায় পুরোপুরি নিমজ্জিত হতে পারেন।
কিন্তু তার মানে কী? আমরা দেখেছি, বুদ্ধ সব সময়ই নিব্বানার সংজ্ঞা দিতে অস্বীকার করেছেন। কারণ অনুভূতি ও মনের আওতার বাইরের এই অভিজ্ঞতাকে বর্ণনা করার মতো কোনও পরিভাষা আমাদের নেই। ঈশ্বর সম্পর্কে নেতিবাচক সুরে কথা বলে যেসব একেশ্বরবাদী তাদের মতো বুদ্ধ মাঝেমাঝে নিব্বানা কী নয় সেটাই ব্যাখ্যা করতে পছন্দ করতেন। শিষ্যদের তিনি জানিয়েছেন যে এটা একটা অবস্থা।
যেখানে জমিন বা পানি, আলো বা হাওয়া, অসীম বা স্থান কোনওটাই নেই; এটা কারণের অসীমতা নয় আবার পরম শূণ্যতাও নয়…এটা বর্তমান জগৎ বা ভিন্ন জগৎ নয়; এটা চন্দ্র ও সূর্য দুটোই।[২৭]
তার মানে এই নয় যে আসলেই ‘কিছু না’ বুঝিয়েছে এটা। আমরা দেখেছি, নিব্বানায় কোনও আরাহান্তের বিলুপ্তি ঘটার দাবি বৌদ্ধদের ক্ষেত্রে ধর্মদ্রোহীতায় পরিণত হয়েছিল। তবে এটা সত্তার অতীত এক অস্তিত্ব। স্বার্থপরতা নেই বলে প্রশান্তিময়। আমরা যারা অনালোকিত, যাদের দিগন্ত এখনও অহমবাদে সংকীর্ণ, তারা এই অবস্থা কল্পনা করতে পারবে না। কিন্তু যারা অহমের মৃত্যু অর্জন করেছে, তারা জানে যে স্বার্থহীনতা শূন্যতা নয়। বুদ্ধ শিষ্যদের মনের অন্তস্তলের এই প্রশান্তিময় স্বর্গোদ্যান কী সে সম্পর্কে ধারণা দেওয়ার প্রয়াসে নেতিবাচক ও ইতিবাচক পরিভাষার মিশ্রণ ঘটিয়েছেন নিব্বানা, বলেছেন তিনি, ‘লোভ, ঘৃণা ও বিভ্রমের নির্বাপন’; তৃতীয় মহান সত্যি; এটা ‘কলঙ্কহীন,’ অদুৰ্বল,’ ‘অভঙ্গুর,’ ‘অলঙ্ঘনীয়,’ ‘অহতাশ,’ ‘অনাক্রান্ত’ এবং ‘বৈরিতাহীন।’ এইসব বৈশিষ্ট্য জোর দেয় যে নিব্বানা আমরা জীবনে যেসব বিষয় অসহনীয় বলে আবিষ্কার করি তার সবই নাকচ করে। এটা নিশ্চিহ্নতার অবস্থা নয়; এটা ‘মৃত্যুহীন।’ কিন্তু নিব্বানা সম্পর্কে ইতিবাচক কথাও বলা যেতে পারে: এটা ‘সত্যি,’ ‘নিগূঢ়,’ ‘অপর পার,’ ‘চিরন্তন,’ ‘শান্তি, ‘ উৎকৃষ্ট লক্ষ্য,’ ‘নিরাপত্তা’ ‘মুক্তি,’ ‘স্বাধীনতা’, ‘দ্বীপ,’ ‘আশ্রয়,’ ‘পোতাশ্রয়, ‘ ‘শরণ,’ ‘ওপার।’[২৮] এটা দেবতা ও মানুষ উভয়ের পক্ষেই পরম শুভ। এক অনির্বচনীয় শান্তি ও সম্পূর্ণ নিরাপদ আশ্রয়। এইসব ইমেজের অনেকগুলোই ঈশ্বরকে বর্ণনা করার বেলায় একেশ্বরবাদীদের ব্যবহৃত শব্দের স্মারক।