দুই ঘনিষ্ঠ অনুসারীর মৃত্যুতে দুঃখ পাওয়ার বদলে তাঁরা পরিনিব্বানা লাভ করায় আমোদিত হয়ে উঠেছিলেন বুদ্ধ: মরণশীলতার দুর্বলতাসমূহ হতে পরম মুক্তি। গোটা সংঘের ভালোবাসার পাত্র এমন দুজন অনুসারী থাকাটা তাঁর জন্যে আনন্দের ব্যাপার ছিল। কীভাবে বিমর্ষ হবেন তিনি, বিলাপ করবেন, যেখানে তাঁরা তাঁদের অন্বেষার চরম লক্ষ্যে পৌঁছেছেন?[১৯] তা সত্ত্বেও অনলোকিতজনের জন্যে বুদ্ধের এক ধরনের মর্মপীড়া ও বিষণ্নতা ছিল। আনন্দ ছাড়া একান্তদের আর কেউ ছিল না। টেক্সটসমূহ একে আড়াল করার চেষ্টা করেছে, কিন্তু উত্তেজিত জনতা ও বন্ধুদের সঙ্গে বর্ণাঢ্য ভোজ আর হয়নি। তার বদলে দুই বৃদ্ধ বুদ্ধ ও আনন্দ একাকী সংগ্রাম চালিয়ে গেছেন। বেঁচে থাকার ক্লান্তি ও সঙ্গীদের বিদায় প্রত্যক্ষ করেছেন যা বুড়ো বয়সের ট্র্যাজিডি নির্মাণ করে। এমনকি বুদ্ধও হয়তো এর খানিকটা স্বাদ পেয়েছিলেন; জোরালোভাবে বিচ্ছিন্ন বোধ করেছেন, ছায়া-সত্তা মারার শেষবারের মতো অবির্ভূত হওয়া তাই বোঝায়। আনন্দ এবং তিনি বেসালির অসংখ্য মন্দিরের একটায় মাত্র সারাদিন একসঙ্গে কাটিয়েছেন। বুদ্ধ মন্তব্য করলেন, চাইলে তাঁর মতো সম্পূর্ণ আলোকপ্রাপ্ত একজন মানুষের পক্ষে ইতিহাসের অবশিষ্ট অংশ পাড়ি দেওয়া সম্ভব। টেক্সট আমাদের বলছে, তিনি আনন্দকে আভাস দিচ্ছিলেন, তিনি যদি তাঁর নির্দেশনাকাঙ্ক্ষী দেবতা ও মানুষের প্রতি সমবেদনার কারণে মর্ত্যে অবস্থান করার আবেদন জানান, বুদ্ধের বেঁচে থাকার ক্ষমতা আছে। কিন্তু তারপরেও, বেচারা আনন্দ মাথা খাটাতে পারেননি। তিনি বুঝতে না পারায় বুদ্ধকে ঐতিহাসিক পর্ব শেষ না হওয়া পর্যন্ত সংঘের সঙ্গে অবস্থান করার অনুরোধ জানাননি। এটা এমন এক ভুল ছিল যার জন্যে আদি সংঘের সদস্যগণ আনন্দকে দোষারোপ করেছেন-মনিবের প্রতি বহু বছরের নিবেদিতপ্রাণ সেবার বিনিময়ে অকিঞ্চিৎকর পুরস্কার। স্বয়ং বুদ্ধ যার প্রশংসা করতেন। কিন্তু বুদ্ধ আভাস দেওয়ার পর তার তাৎপর্য বুঝতে পারেননি আনন্দ। কোমল কণ্ঠে মামুলি মন্তব্য করে কাছের একটা খাটের পায়ের কাছে বসতে এগিয়ে যান তিনি।
হয়তো ক্ষণিকের জন্যে হলেও এমনকি বুদ্ধও হয়তো নিজের আয়ু ফুরিয়ে আসছে টের পেয়ে এমন একজন সঙ্গী কামনা করেছিলেন যিনি তাঁর মনের কথা আরও ভালোভাবে বুঝতে পারবেন। কারণ ঠিক সেই মুহূর্তে তাঁর ছায়া- সত্তা মারা উপস্থিত হলেন। ‘তথাগতকে এবার পরিনিব্বানা লাভ করতে দাও,’ প্রলুব্ধ করার সুরে ফিসফিস করে বললেন মারা। কেন চালিয়ে যাওয়া? চূড়ান্ত বিশ্রাম পাওনা হয়েছে তাঁর: সংগ্রাম অব্যাহত রাখার কোনও যুক্তি নেই। শেষবারের মতো মারাকে প্রত্যাখ্যান করলেন বুদ্ধ। দায়িত্ব সম্পন্ন না হওয়া পর্যন্ত পরিনিব্বানায় প্রবেশ করবেন না তিনি; যতক্ষণ না নিশ্চিত হচ্ছেন যে সংগঠন ও পবিত্র জীবন ঠিকমতো প্রতিষ্ঠা লাভ করেছে। কিন্তু, যোগ করলেন তিনি, অচিরেই ঘটবে সেটা: ‘তিন মাসের মধ্য,’ মারাকে বললেন তিনি, ‘তথাগত পরিনিব্বানা লাভ করবে।’[২১]
তারপরই ধর্মগ্রন্থসমূহ আমাদের বলছে যে, বেসালির কাঁপালা মন্দিরে বুদ্ধ সচেতন ও ইচ্ছাকৃতভাবে বেঁচে থাকার ইচ্ছা ত্যাগ করেন। এমন এক সিদ্ধান্ত যা গোটা সৃষ্টিজগতে অনুরণিত হয়েছে। ভূমিকম্পে কেঁপে উঠেছিল পৃথিবী, আনন্দকেও বুঝিয়ে দিয়েছিল যে অশুভ কিছু আসন্ন। গুরুগম্ভীর ডঙ্কা বাজতে শুরু করেছিল স্বর্গে। বেঁচে থাকার আবেদন জানানোর আর সময় নেই, অনুতপ্ত পরিচারক আনন্দকে বললেন বুদ্ধ। এখন তাঁকে অবশ্যই সংঘের উদ্দেশে বক্তব্য রাখতে হবে। সন্ন্যাসীদের কাছ থেকে আনুষ্ঠানিক বিদায় নিতে হবে। বেসালির আরামায় বিশাল রঙিন মিলনায়তনে আশপাশে বাসরত সকল ভিক্ষুর উদ্দেশে বক্তব্য রাখলেন তিনি। তাদের নতুন কিছু বলার ছিল না তাঁর। ‘তোমাদের আমি কেবল সেই সব জিনিসই শিক্ষা দিয়েছি যা আমার নিজের পূর্ণ অভিজ্ঞতা রয়েছে,’ বলেন তিনি। বিশ্বাসের ভিত্তিতে কোনও কিছু মেনে নেননি তিনি। তাদেরও পুরোপুরি তাঁর শিক্ষা দেওয়া সত্য জানতে হবে এবং ধ্যানের সাহায্যে সেগুলোকে জীবন্ত অভিজ্ঞতায় পরিণত করতে হবে, যাতে যোগির ‘প্রত্যক্ষ জ্ঞান’ দিয়ে সেগুলো আত্মস্থ করতে পারে। সবার ওপরে, তাদের অবশ্যই অন্যের জন্যে বাঁচতে হবে। কেবল আলোকপ্রাপ্তির জন্যেই পবিত্র জীবনের উদ্ভাবন করা হয়নি। তাছাড়া, নিব্বানা এমন পুরস্কার নয় যে ভিক্ষু স্বার্থপরের মতো নিজের কাছে লুকিয়ে রাখবেন। তাঁদের অবশ্যই ‘মানুষের জন্যে, জনগণের কল্যাণ ও সুখের জন্যে, জগতের প্রতি সমবেদনা হতে এবং দেবতা ও মানুষের মঙ্গল ও শুভের জন্যে’[২২] ধম্ম পালন করতে হবে।
পরদিন সকালে বুদ্ধ ও আনন্দ শহরে খাবার ভিক্ষা করার পর বুদ্ধ ঘুরে দাঁড়িয়ে দীর্ঘ সময় বেসালির দিকে চেয়ে রইলেন: শেষবারের মতো দেখে নিচ্ছেন। এরপর ভানদাগামার পথ ধরেন ওঁরা। এই পর্যায় হতে বুদ্ধের ভ্রমণ যেন সত্য জগতের মানচিত্র হতে সরে যাচ্ছিল। ভানদাগামায় কিছুদিন অবস্থান করে সেখানকার ভিক্ষুদের নির্দেশনা দেওয়ার পর আনন্দকে নিয়ে ধীরে ধীরে উত্তরে হস্তিগামা, আম্বাগামা, জাম্বুগামা ও ভোগানাগামা (এগুলোর সবই কোনও চিহ্ন না রেখে হারিয়ে গেছে) হয়ে পাভায় এসে কুণ্ড নামের এক স্বর্ণকারের বাগিচায় অবস্থান গ্রহণ করলেন। বুদ্ধকে শ্রদ্ধা জানালেন কুণ্ড, মনোযোগ দিয়ে নির্দেশনা শুনলেন, তারপর এক অসাধারণ ভোজে নিমন্ত্রণ করলেন তাঁকে যেখানে কিছু সুকারামাদ্দাভা (‘শূকরের নরম মাংস’) ছিল। খাবারটা আসলে কী ছিল নিশ্চিত নয় কেউঃ কোনও কোনও ভাষ্যকার বলেন এটা ছিল বাজারের শূকরের মাংস (বুদ্ধ কখনও তাঁর জন্যে বিশেষভাবে হত্যা করা কোনও প্রাণীর মাংস খাননি): অন্যরা যুক্তি দেখিয়েছেন, এটা হয় কুচিকুচি করে কাটা শূয়োরের মাংস বা শূয়োরের খাবার সুগন্ধী ব্যাঙের ছাতা ছিল। কারও মতে এটা ছিল বিশেষ ধরনের আরক। বুদ্ধ সেরাতে মারা গিয়ে পরিনিব্বানা লাভ করতে পারেন ভেবে কুণ্ড এ খাবার তাঁর জীবন অনির্দিষ্ট কাল প্রলম্বিত করবে বলে ভেবেছিলেন।[২৩] সে যাই হোক, বুদ্ধ সুকারামাদ্দাধা খাওয়ার জন্যে জোর করলেন; অন্য ভিক্ষুদের টেবিলের অন্যান্য খাবার খেতে বললেন। খাবার শেষে পর কুণ্ডকে তিনি বললেন অবশিষ্ট খাবরটুকু মাটি চাপা দিতে, যেহেতু আর কেউ–এমনকি দেবতাও নয়–এটা হজম করতে পারবে না। এটা কুণ্ডের রান্নার নৈপুণ্যের বিপরীত মূল্যায়ন হতে পারে। কিন্তু কোনও কোনও আধুনিক পণ্ডিত মত দিয়েছেন যে, বুদ্ধ বুঝতে পেরেছিলেন সুকারামাদ্দাভায় বিষ মেশানো হয়েছিল: তাঁরা বুদ্ধের দিক থেকে নিঃসঙ্গতা ও জায়গার দূরত্বকে বুদ্ধ ও সংঘের দূরত্বের চিহ্ন হিসাবে দেখেছেন এবং বিশ্বাস করেন যে দুজন বৃদ্ধ রাজার মতো তিনিও সহিংস মৃত্যু বরণ করেছেন।[২৪]