অবশেষে বেসালি পৌঁছলেন বুদ্ধ। প্রথমে সমস্ত কিছু যেমন ছিল বরাবর তেমনই মনে হলো। অন্যতম নেতৃস্থানীয় পতিতা আম্বাপালির আম- বাগানে উঠলেন তিনি। বুদ্ধকে স্বাগত জানাতে রথের বহর নিয়ে হাজির হলো সে। ধম্ম শুনবার জন্যে তাঁর পায়ের কাছে বসল। বুদ্ধকে খাবারের আমন্ত্রণ জানাল। তিনি যখন সম্মতি দিয়েছেন, বেসালিতে বসবাসকারী লিছাবি গোত্রের সদস্যরা চমৎকারভাবে রঙ করা রথের মিছিল নিয়ে দলবেঁধে বুদ্ধকে আমন্ত্রণ জানাতে অগ্রসর হলো। অপূর্ব দৃশ্য ছিল সেটা। দেখে মুচকি হাসলেন বুদ্ধ, ভিক্ষুদের বললেন, স্বর্গের দেবতাদের চমৎকারিত্বের খানিকটা ধারণা আছে ওদের। বুদ্ধের চারপাশে ঘিরে বসল লিছাবিবাসীরা, বুদ্ধ তাদের ধম্মর বাণী দিয়ে ‘উদ্দীপ্ত, অনুপ্রাণিত ও উৎসাহিত’ করলেন। এই আলোচনার শেষে লিছাবিরা তাদের আমন্ত্রণের কথা জানাল। বুদ্ধ যখন বললেন তিনি আগেই আম্বাপালির নিমন্ত্রণ রক্ষা করেছেন, মনঃক্ষুণ্ণ হলো না তারা, তুড়ি বাজিয়ে চিৎকার করে উঠল, “ওহ, আম্বপালি আমাদের হারিয়ে দিয়েছে, বুদ্ধিতে হারিয়ে দিয়েছে।’ সেরাতে খাবারের সময় বারবণিতা তার আম-বাগানটি সংঘকে দান করে দেয়। বুদ্ধ কিছুদিন সেখানে অবস্থান করে ভিক্ষুদের দীক্ষা দেন। বুদ্ধকে ঘিরে স্বাভাবিক ব্যস্ততা, জাঁক ও উত্তেজনা ছিল, এবং তার মূলে অভিনিবেশ ও ধ্যানের নিবিড় অন্তস্থ জীবনের জন্যে এক অব্যাহত প্রেরণা।[১৬]
কিন্তু তারপর দৃশ্যপট মলিন হয়ে উঠতে শুরু করল। সন্ন্যাসীদের নিয়ে বেসালি ত্যাগ করে নিকটস্থ বেলুভাগামাকা গ্রামে অবস্থান গ্রহণ করেন বুদ্ধ। সেখানে কিছুদিন অবস্থান করার পর আকস্মিকভাবে সন্ন্যাসীদের বিদায় করে দিলেন তিনি। তাদের বেসালিতে ফিরে যেতে হবে। যেখানে সম্ভব বর্ষার অবকাশের জন্যে অবস্থান নিতে হবে। তিনি আর আনন্দ বেলুভাগামাকায় রয়ে যাবেন। বুদ্ধের জীবনে এক নতুন নিঃসঙ্গতার পর্যায় প্রবেশ করেছে। এই পর্যায় থেকে তিনি যেন বড় বড় শহর-নগর এড়িয়ে আরও অচেনা অজানা জায়গার খোঁজ করছিলেন। যেন এরই মধ্যে জগৎ ত্যাগ করতে শুরু করেছিলেন। ভিক্ষুরা বিদায় নেওয়ার পর মারাত্মক অসুস্থ হয়ে পড়েন বুদ্ধ। কিন্তু প্রবল আত্মনিয়ন্ত্রণের সাহায্যে যন্ত্রণা আড়াল করে অসুস্থতা কাটিয়ে ওঠেন। তাঁর পক্ষে এখুনি মৃত্যুবরণ করে পরম নিব্বানা (পরিনিব্বানা লাভ করা ঠিক হবে না, বোধি বুক্ষের নিচে অর্জন করা অলোকন যা পূর্ণাঙ্গ করে তুলবে। সবার আগে সংঘকে বিদায় জানাতে হবে। সুতরাং, সেরে উঠলেন বুদ্ধ, অসুস্থতার কামরা হতে বেরিয়ে যে কুঁড়েতে অবস্থান করছিলেন সেটার বারান্দায় আনন্দের সঙ্গে বসলেন।
বুদ্ধের অসুস্থতা আনন্দের অন্তরাত্মা টলিয়ে দিয়েছিল। ‘আশীর্বাদপ্রাপ্তকে আমি স্বাস্থ্যবান, তরতাজা দেখে অভ্যস্থ,’ বুদ্ধের পাশে বসার সময় কাঁপা কণ্ঠে বললেন তিনি। প্রথমবারের মতো উপলব্ধি করেছিলেন, তাঁর শুরু মারা যেতে পারেন। ‘আমার শরীরের আড়ষ্ট হয়ে যাওয়া টের পেয়েছি,’ বললেন তিনি। ‘আমি ঠিকমতো দেখতে পাই না। আমার মন বিভ্রান্ত।’ কিন্তু একটা কথা ভেবে সান্ত্বনা পেলেন তিনিঃ সংঘের উত্তরাধিকার ও পরিচালনা সম্পর্কে কোনও একটা সিদ্ধান্ত না নেওয়া পর্যন্ত বুদ্ধ মারা যাবেন না। গুরু বিদায় নেওয়ার পর যা পরিবর্তন হতে বাধ্য। দীর্ঘশ্বাস ফেললেন বুদ্ধ। ‘সংঘ আমার কাছে কী আশা করে, আনন্দ?’ অধৈর্য কণ্ঠে জানতে চাইলেন তিনি। যা শেখানোর ছিল ভিক্ষুরা তার সবই জানেন। কয়েকজন মনোনীত নেতার জন্যে কোনও গোপন মতবাদ নেই। ‘আমাকেই সংঘের পরিচালনা করতে হবে,’ বা ‘আমার ওপর সংঘ নির্ভরশীল,’ এজাতীয় ভাবনা কোনও আলোকপ্রাপ্ত মানুষের মনে আসে না। ‘আমি একজন বৃদ্ধ মানুষ, আনন্দ। আশি বছর বয়স।’ নির্দয় কণ্ঠে বললেন বুদ্ধ। ‘আমার দেহ পুরোনো ঠেলাগাড়ির মতো ঠক্কর ঠক্কর করে চলে। একমাত্র যে কাজটি স্বাচ্ছন্দ ও সতেজতা বয়ে আনে সেটা হচ্ছে ধ্যান, যা তাঁকে নিব্বানার মুক্তির সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়েছে। সুতরাং প্রত্যেক ভিক্ষু ও ভিক্ষুনির বেলায়ও তাই হওয়া উচিৎ। ‘তোমাদের প্রত্যেককে নিজেকে নিজের দ্বীপে পরিণত করতে হবে। অন্য কাউকে নয়, নিজেকেই নিজের আশ্রয় পরিণত করতে হবে।’ কোনও বৌদ্ধ অন্য কারও ওপর নির্ভর করতে পারে না। সংগঠনে নেতৃত্ব দেওয়ার জন্যে কারও প্রয়োজন নেই। ‘ধম্ম, কেবল ধৰ্ম্মই তার আশ্রয়।[১৭] ভিক্ষুরা কেমন করে আত্মনির্ভর হবে? উত্তর আগেই জানা আছে তাদের: ধ্যান, মনোসংযোগ, অভিনিবেশ ও জগৎ হতে শৃঙ্খলাপূর্ণ বিচ্ছিন্নতার মধ্য দিয়ে। সংঘের কাউকে পরিচালনা করার প্রয়োজন নেই, কোনও কেন্দ্রীয় কর্তৃপক্ষ নয়। বৌদ্ধদের জীবনধারার মোদ্দা কথা, এমন এক অন্তস্থ উৎস অর্জন করতে হবে যা এই ধরনের নির্ভরশীলতা সম্পূর্ণ হাস্যকর করে তোলে।
কিন্তু আনন্দ এখনও নিব্বানা লাভ করেননি। দক্ষ যোগি ছিলেন না তিনি। আত্ম-নির্ভরশীলতার এই মাত্রা অর্জন করতে পারেননি। ব্যক্তিগতভাবে মনিবের সঙ্গে সংযুক্ত ছিলেন তিনি। এই ধরনের যোগ বীরত্বের জন্যে প্রস্তুত নয়, কিন্তু বুদ্ধের প্রতি আরও শ্রদ্ধা (ভক্তি) প্রয়োজন, এমন বৌদ্ধদের আদর্শে পরিণত হবেন, তিনি তাদের উৎসাহিত করার জন্যে। কয়েক দিন পর আরেকটা ধাক্কা খেলেন আনন্দ। জনৈক নবীশ নালন্দা থেকে সারিপুত্ত ও মগ্গালানার মৃত্যু সংবাদ নিয়ে এলো। আবারও আনন্দের দিশাহারা অবস্থা দেখে কিঞ্চিৎ উত্তেজিত বোধ করলেন বুদ্ধ। কী প্রত্যাশা করেছিলেন তিনি? এটাই ধম্মের মূল কথা নয় যে কোনও কিছুই চিরকাল টিকে থাকে না এবং আমরা যা এবং যাকে ভালোবাসি তা থেকে সবসময়ই বিচ্ছেদ ঘটে? আনন্দ কি ভেবেছেন যে, বৌদ্ধরা যে বিধি অন্তর্দৃষ্টি নিয়ে বেঁচে আছে সারিপুত্ত তা সঙ্গে করে নিয়ে গেছেন বা সৎগুণের বিধান ও ধ্যানের জ্ঞানও সংঘ হতে বিদায় নিয়েছে? ‘না, প্রভু,’ প্রতিবাদ করলেন হতভাগ্য আনন্দ। আসলে সারিপুত্ত যে কত উদার ছিলেন, ধম্মের ক্লান্তিহীন ব্যাখ্যা দিয়ে কীভাবে সবাইকে সমৃদ্ধ ও সাহায্য করেছিলেন সেটা মনে না করে পারছেন না। দুঃসংবাদ বয়ে আনা নবীশের নিয়ে আসা ভিক্ষার পাত্র ও জোব্বা দেখাটা ছিল এক হৃদয় বিদারক দৃশ্য। ‘আনন্দ,’ আবার বললেন বুদ্ধ। ‘তোমাদের প্রত্যেককে যার যার দ্বীপ সৃষ্টি করতে হবে, নিজেকে, অন্য কাউকে নয়, নিজের আশ্রয় নির্মাণ করতে হবে: তোমাদের প্রত্যেককে ধম্মকেই তার দ্বীপে পরিণত করতে হবে, ধম্মই, অন্য কিছু নয়, তার আশ্রয়।[১৮]