জীবনের শেষ বছরে এই বিপদ নিয়ে আলোচনা করেছেন বুদ্ধ। এখন আশি বছর বয়স্ক তিনি। রাজা অজাতাশত্তু ততদিনে মগধের সিংহাসনে দারুণভাবে অধিষ্ঠিত। প্রায়ই বুদ্ধের সঙ্গে দেখা করেন তিনি। মাল্লা, বিদেহা, লিচাবি, কোলিয়া ও বাজ্জির বিরুদ্ধে আক্রমণ শানানোর পরিকল্পনা করছিলেন তিনি। তাঁর রাজ্যের পুবে অবস্থিত এই রাজ্যগুলো ‘বাজ্জিয়’ নামে একটা প্রতিরক্ষা সংগঠন গড়ে তুলেছিল। তাদের মানচিত্র থেকে মুছে ফেলে নিজের রাজ্যের অঙ্গীভূত করতে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ ছিলেন রাজা। কিন্তু আক্রমণ শুরু করার আগে বাসাকারা নামে একজন ব্রাহ্মণ মন্ত্রীকে তিনি কী করতে যাচ্ছেন বুদ্ধকে জানাতে ও মনোযোগ দিয়ে বুদ্ধের মন্তব্য শুনবার নির্দেশ দিয়ে পাঠালেন তাঁর কাছে। বুদ্ধ ছিলেন দুর্বোধ্য, বাসাকারাকে তিনি বললেন বাজ্জীয়রা যতক্ষণ প্রজাতন্ত্রীয় ঐতিহ্য মেনে চলছে, ‘ঘনঘন উল্লেখযোগ্য উপস্থিতি নিয়ে সভা করছে,’ মতৈক্যের মাঝে জীবন কাটাচ্ছে, প্রবীনদের সমান দেখাচ্ছে, মনোযোগ দিয়ে তাদের পরামর্শ শুনছে, এবং পূর্বসুরিদের আইন ও ধার্মিকতা পালন করছে, ততক্ষণ রাজা অজাতাশত্তু তাদের পরাস্ত করতে পারবেন না। মনোযোগ দিয়ে শুনলেন বাসাকারা, তারপর বুদ্ধকে বললেন বাজ্জীয়রা যেহেতু এখন এই সমস্ত শর্তই মেনে চলছে সেহেতু এখন তারা অপরাজেয়। তিনি রাজাকে এই সংবাদ দিতে ফিরে গেলেন।[১৩] অবশ্য বৌদ্ধিয় কিংবদন্তীতে আছে এর অল্প কিছুদিন পরেই রাজা অজাতাশত্তু বাজ্জকীয়দের পরাস্ত করতে সক্ষম হন। নেতাদের মাঝে অনৈক্যের বীজ বপন করার জন্যে এইসব প্রজাতন্ত্রে গুপ্তচর পাঠিয়ে এই সাফল্য অর্জন করেন তিনি। বাসাকারা বিদায় নেওয়ার পর দরজার আড়ালে বুদ্ধের উচ্চারিত কথায় তাই এক ধরনের তাগিদ ও মর্মস্পর্শী সুর ছিল। সংঘের ক্ষেত্রেও একই শর্ত আরোপ করেন তিনিঃ যতক্ষণ এর সদস্যরা প্রবীন ভিক্ষুদের সম্মান করবে, ঘনঘন সম্মেলন অনুষ্ঠান করবে ও ধম্মের প্রতি সম্পূর্ণ অনুগত থাকবে ততদিন সংঘ টিক থাকবে।
গোত্রীয় প্রজাতন্ত্রগুলো অনিবার্য ধ্বংসের মুখে ছিল। সেগুলো ছিল অতীতের অংশ এবং অচিরেই নতুন উগ্র শাসকদের করতলগত হবে। রাজা পাসেনেদির ছেলে বুদ্ধের নিজ গোত্র শাক্যদের অচিরেই পরাস্ত করে হতালীলা চালাবেন। কিন্তু বুদ্ধের সংঘ ছিল নতুন, হালনাগাদ এবং পুরোনো প্রজাতান্ত্রিক সরকারগুলোর দক্ষ আধ্যাত্মিক রূপ। অধিকতর সহিংস ও নিপীড়ক শাসকগণ যেসব মূল্যবোধ হারানোর হুমকির মুখে ছিল সেগুলোই কঠোরভাবে অনুসরণ করে যাবে সংঘ। কিন্তু এ জগৎ বিপদসংকুল। সংঘ আভ্যন্তরীণ মতানৈক্য, প্রবীনদের অসম্মান, প্রেমময়-দয়ার ঘাটতি ও দেবদত্তের কেলেঙ্কারীর সময় আবির্ভূত অগভীরতা হতে বাঁচতে পারবে না। ভিক্ষু ও ভিক্ষুনিদের অবশ্যই মনোযোগি হতে হবে, আধ্যাত্মিক দিক দিয়ে সতর্ক আর ধ্যানমূলক অনুশীলনের প্রতি উদ্যমী ও বিশ্বস্ত থাকেত হবে যা আলোক বয়ে আনতে পারে। সন্ন্যাসীরা যতদিন ‘গল্পগুজব, অলস সময় কাটানো আর মেলামেশা’র মতো অদক্ষ কাজ এড়িয়ে যাবেন, ‘যত দিন তাদের নীতিবর্জিত বন্ধু থাকবে না এবং এধরনের মানুষের প্রভাবে পড়া এড়াতে পারবেন, যতদিন তাঁরা সন্ধানের মাঝপথে বিরতি দিয়ে মাঝারি পর্যায়ের আধ্যাত্মিকতায় সন্তুষ্ট হবেন না’[১৪] ততদিন সংগঠনের অবনতি ঘটবে না। তাঁরা এতে ব্যর্থ হলে আর পাঁচটা ধর্ম নিরপেক্ষ প্রতিষ্ঠানের চেয়ে ভিন্ন কিছু থাকবে নাঃ শাসকদের দুর্নীতির শিকারে পরিণত হবে এটা, চরমভাবে দুর্নীতিগ্রস্থ হয়ে পড়বে।
বাসাকারার সঙ্গে সভার পর রাজাগহ ছেড়ে বেসালিতে বাস্যা অবকাশ যাপন করবেন বলে উত্তরে রওনা দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন বুদ্ধ। যেন রাজা অজাতাশত্তুর ‘বাজ্জীয়দের নিশ্চিহ্ন করার’ পরিকল্পনার প্রকাশ মুহূর্তের জন্যে বিতৃষ্ণ করে তুলেছিল তাঁকে, অবরুদ্ধ প্রজাতন্ত্রগুলোর প্রতি তাঁর দরদ সম্পর্কে সজাগ করে তুলেছিল। কর্মজীবনের অধিকাংশ সময় কোসালা ও মগধে কাটিয়েছেন তিনি, সেখানে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব সম্পন্ন করেছেন। কিন্তু এখন এই রাজ্যগুলোর রাজনৈতিক জীবনকে চালিতকারী আগ্রাসনের শিকার একজন বৃদ্ধ গাঙ্গেয় উপত্যকার আরও প্রত্যন্ত এলাকার উদ্দেশে চলেছেন।
ধীর গতিতে সন্ন্যাসীদের বিরাট একটা দল নিয়ে মগধ এলাকা হয়ে প্ৰথমে নালন্দা ও তারপর মহান বৌদ্ধ রাজা অশোকের রাজধানী (২৬৯-২৩২ বিসিই) পাটালিগামে (আধুনিক পাটলা) পৌঁছেন তিনি। অশোক এমন এক রাজ্য গড়ে তুলবেন যা সহিংসতাকে এড়িয়ে ধম্মের সহানুভূতির নীতিমালা গ্রহণের প্রয়াস পেয়েছিল। বুদ্ধ বাজ্জীয়দের বিরুদ্ধে আসন্ন যুদ্ধের প্রস্তুতি হিসাবে মগধের মন্ত্রীদের নির্মাণাধীন সুবিশাল দুর্গ লক্ষ করলেন, শহরের ভবিষ্যৎ খ্যাতির ভবিষ্যদ্বাণী করলেন তিনি। সাধারণ ভক্তরা এখানে গালিচা বিছিয়ে, বড় বড় কুপি জ্বালিয়ে বুদ্ধকে একটা বিশ্রাম ঘর ছেড়ে দিল। সারারাত সাধারণ মানুষের প্রয়োজন উপযোগি করে তোলা ধম্ম ব্যাখ্যা করলেন বুদ্ধ। তিনি উল্লেখ করলেন, দক্ষ আচরণ এই জগতেও একজন শুদ্ধ নারী বা শুদ্ধ পুরুষের জন্যে উপকারী হতে পারে। তাদের তাীবনেও আলোকনের পথে অগ্রসর হওয়া নিশ্চিত করবে।[১৫]