এদিকে রাজপুত্র অজাতাশত্তুর কাছে একটা প্রস্তাব নিয়ে হাজির হলেন দেবদত্ত। আগের দিনে, বললেন তিনি, মানুষের আয়ু এখনকার চেয়ে বেশি ছিল। রাজা বিম্বিসারা এখনও টিকে আছেন। অজাতাশত্তু হয়তো কোনওদিনই সিংহাসনে বসতে পারবেন না। বাবাকে তিনি হত্যা করছেন না কন? দেবদত্ত অন্যদিকে বুদ্ধকে হত্যা করতে পারেন। এই দুই বৃদ্ধ কেন তাঁদের পথে বাধা হয়ে থাকবেন? দেবদত্ত ও অজাতাশত্তু চমৎকার একটা জুটি হতে পারতেন। অসাধারণ সাফল্য অর্জন করা যাবে। বুদ্ধিটা রাজপুত্রের মনে ধরল। কিন্তু ঊরুতে ছুরি বেঁধে রাজার অন্দরমহলে লুকিয়ে ঢোকার সময় আটক করা হয় তাঁকে। তিনি সমস্ত অপরাধ স্বীকার করেন। গুপ্তহত্যার পরিকল্পনায় দেবদত্তের ভূমিকা জানার পর সেনাবাহিনীর কিছু কর্মকর্তা গোটা সংঘকে শেষ করে দিতে চেয়েছিলেন,, কিন্তু বিম্বিসারা যুক্তি দেখান যে বুদ্ধ আগেই দেবদত্তকে বহিষ্কার করেছেন, এই দুষ্কৃতকারীর কর্মকাণ্ডের জন্যে তাঁকে দায়ী করা যাবে না। অজাতাশত্তুকে তাঁর সামনে হাজির করার পর রাজা বিষণ্ণ কণ্ঠে জানতে চাইলেন কেন তিনি তাঁকে হত্যা করতে চেয়েছেন। আমি রাজত্ব চাই, মহামান্য।’ খোলাখুলি জবাব দিলেন অজাতাশত্তু। অযথা এতদিন বুদ্ধের অনুসারী ছিলেন না বিম্বিসারা। ‘যদি রাজত্ব চেয়ে থাক, রাজকুমার,’ সহজ কণ্ঠে বললেন তিনি। ‘এরাজ্য তোমার।’[৭] পাসেনেদির মতো তিনিও সম্ভবত রাজনীতির জন্যে প্রয়োজনীয় অদক্ষ ও আগ্রাসী আবেগ সম্পর্কে সজাগ ছিলেন, তাই জীবনের শেষ কটি বছর আধ্যাত্মিক জীবন যাপন করে কাটিয়ে দিতে চেয়েছেন। অবশ্য সিংহাসন ত্যাগ কোনও উপকার হয়নি তাঁর। সেনাবাহিনীর সমর্থনে অজাতাশত্তু বাবাকে গ্রেপ্তার করান এবং উপোস মৃত্যুবরণ করেন তিনি।
নতুন রাজা এরপর বুদ্ধকে হত্যার দেবদত্তের পরিকল্পনায় মদদ যোগান। সেনাবাহিনী হতে প্রশিক্ষিত গুপ্তঘাতক সরবরাহ করেন তিনি। কিন্তু ওদের একজন তীর-ধনুক নিয়ে তাঁর কাছাকাছি যাবার পরেই আতঙ্কে স্থির হয়ে যায়। ‘এসো, বন্ধু,’ কোমল কণ্ঠে বলেন বুদ্ধ। ‘ভয় পেয়ো না।’ নিজের কাজের ভুল বুঝতে পারায় তার অন্যায় ক্ষমা করে দেওয়া হয়েছে। বুদ্ধ এরপর সৈন্যটিকে সাধারণ মানুষের উপযোগি নির্দেশনা দিলেন। খুবই অল্প সময়ের ভেতর অনুতপ্ত ঘাতক একজন শিষ্যে পরিণত হয়েছিল। একের পর এক তার সতীর্থ ষড়যন্ত্রীরা অনুসরণ করল।[৮] এরপর ব্যাপারটা নিজের হাতে তুলে নিতে বাধ্য হলেন দেবদত্ত। প্রথমে বুদ্ধকে চাপা দেওয়ার জন্যে পাহাড় চূড়া হতে এক বিরাট পাথর গড়িয়ে দিলেন তিনি, কিন্তু বুদ্ধের পায়ে সামান্য আঘাত লাগা ছাড়া অন্য কোনও ক্ষতি হলো না। এরপর নীলগিরি নামে এক হিংস্র হাতি ছেড়ে দিলেন বৃদ্ধের পেছনে। কিন্তু শিকারকে দেখামাত্র বুদ্ধ হতে উৎসারিত প্রেমের তরঙ্গে পরাস্ত হয়ে শুঁড় নামিয়ে স্থির দাঁড়িয়ে পড়ল নীলগিরি। ওটার কপালে হাত বুলিয়ে দিলেন বুদ্ধ। ব্যাখ্যা করে বুঝিয়ে দিলেন, সহিংসতা আগামী জন্মে কোনও উপকারে আসবে না তার। নীলগিরি বুদ্ধের পায়ের কাছ থেকে শুঁড় দিয়ে বালি টেনে নিজের মাথায় ছিটাল, পিছিয়ে গেল তারপর। বুদ্ধ দৃষ্টির আড়ালে না যাওয়া পর্যন্ত তৃষ্ণার্ত চোখে তাকিয়ে রইল তাঁর দিকে। এরপর শান্ত পায়ে আস্ত বিলের দিকে ফিরে গেল। সেদিন থেকে বদলে যাওয়া এক পশু।[৯]
বুদ্ধ যেন এইসব আক্রমণ হতে সুরক্ষিত, এটা বুঝতে পেরে ষড়যন্ত্রকারীরা কৌশল বদল করল। ক্ষমতা দখলের প্রয়াসে সফল অজাতাশতু দেবদত্তকে ঝেড়ে ফেলে বুদ্ধের একজন সাধারণ শিষ্যে পরিণত হলেন। এবার নিঃসঙ্গ হয়ে পড়লেন দেবদত্ত, সংঘের অভ্যন্তরে সমর্থন যোগাড়ের প্রয়াস পেলেন তিনি। বেসালির কিছু তরুণ, অনভিজ্ঞ সন্ন্যাসীর কাছে বুদ্ধের মধ্যপন্থা ঐতিহ্য হতে অগ্রহণযোগ্য বিচ্যুতি বলে প্রচার করলেন। বৌদ্ধদের উচিৎ অধিকতর ঐতিহ্যবাহী সাধকদের কঠোর আদর্শে ফিরে যাওয়া। পাঁচটি নতুন বিধানের প্রস্তাব রাখলেন দেবদত্ত: বর্ষাকালে আরামার বদলে সংঘের সকল সদস্যকে বনে-জঙ্গলে বাস করতে হবে; তাদের অবশ্যই কেবল ভিক্ষার উপর নির্ভর করতে হবে, সাধারণের বাড়িতে আমন্ত্রণ রক্ষা করতে পারবে না; নতুন জোব্বার বদলে অবশ্যই রাস্তায় কুড়িয়ে পাওয়া ন্যাকড়া পরতে হবে; কুঁড়ে ঘরের বদলে অবশ্যই খোলা জায়গায় ঘুমাতে হবে; এবং তারা কখনও জীবিত প্রাণীর মাংস খেতে পারবে না।[১০] এই পাঁচটি বিধান দেবদত্তের পক্ষত্যাগের ঐতিহাসিক মূল সত্য তুলে ধরতে পারে। রক্ষণশীল ভিক্ষুদের কেউ কেউ হয়তো সংগঠনের ক্রমাবনতিতে উদ্বিগ্ন হওয়ায় মূল সংঘ হতে বেরিয়ে যাবার প্রয়াস পেয়েছিলেন। দেবদত্ত এই সংস্কার আন্দোলনের সঙ্গে সম্পর্কিত থেকে থাকতে পারেন। তাঁর প্রতিপক্ষ বুদ্ধের মধ্যপন্থার পক্ষাবলম্বীরা হয়তো বিনয়ায় প্রাপ্ত নাটকীয় কিংবদন্তী আবিষ্কার করে দেবদত্তের নামে কালিমা লেপন করতে চেয়েছেন।
দেবদত্ত তাঁর পঞ্চবিধান প্রকাশ করে বুদ্ধকে সমগ্র সংঘের জন্যে তা বাধ্যতামূলক করার আহ্বান জানালে যেকোনও সন্ন্যাসীই তাঁর খুশিমতো জীবন যাপনের অধিকারী বলে প্রত্যাখ্যান করলেন বুদ্ধ, এইসব ব্যাপারে জবরদস্তি সংগঠনের চেতনার পরিপন্থী। সন্ন্যাসীদেরই মনস্থির করতে হবে, তাদের কারও নির্দেশনা অনুসরণে বাধ্য করা যাবে না। উল্লসিত হয়ে উঠেছিলেন দেবদত্ত। বুদ্ধ তাঁর ন্যায় অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করেছেন! অনুসারীদের কাছে বিজয়ীর সুরে তিনি ঘোষণা দিলেন, বুদ্ধ বিলাসিতার কাছে নতি স্বীকার করে আত্মতুষ্টিতে নিপতিত হয়েছেন। এখন দুর্নীতিগ্রস্ত ভাই হতে নিজেদের বিচ্ছিন্ন করে নেওয়া তাদের দায়িত্ব।[১১] পাঁচশো অনুসারী নিয়ে রাজাগহের উপকণ্ঠে গয়াশিসা পাহাড়ে শিবির গাড়লেন দেবদত্ত, অন্যদিকে বিদ্রোহী ভিক্ষুদের ফিরিয়ে আনতে সারিপুত্ত ও মগ্গালানাকে পাঠালেন বুদ্ধ। তাঁদের আসতে দেখে দেবদত্ত ধরে নিলেন বুদ্ধকে ত্যাগ করে তাঁর দলে যোগ দিতে আসছেন ওরা। উল্লসিত হয়ে শিষ্যদের একটা সভা ডাকলেন তিনি, গভীর রাত পর্যন্ত বক্তব্য রাখলেন। তারপর পিঠ ব্যথার কথা বলে সারিপুত্ত ও মগ্গালানাকে বক্তব্য রাখার সুযোগ দিয়ে শুতে চলে গেলেন। এই দুজন বিশ্বস্ত নেতা বক্তব্য শুরু করার পর অচিরেই ভিক্ষুদের বুদ্ধের কাছে ফিরে যেতে রাজি করিয়ে ফেললেন। কোনওরকম শাস্তি ছাড়াই তাঁদের বরণ করে নেন বুদ্ধ।[১২] কোনও কোনও টেক্সট আমাদের বলে, দেবদত্ত আত্মহত্যা করেছেন। অন্যগুলোর মতে বুদ্ধের সঙ্গে সমঝোতায় পৌঁছার আগেই মারা যান তিনি। এইসব কাহিনীর সত্য যাই হোক, বৃদ্ধ বয়সের ভোগান্তি সম্পর্কে সত্যি কথা জানায়। সতর্কতামূলক কাহিনীও শোনায়। এমনকি সাধারণ জনজীবনে প্রকট স্বার্থপরতা, উচ্চাকাঙ্ক্ষা আর মতানৈক্য হতে সংঘও মুক্ত ছিল না।