বৃদ্ধ বয়সকে বরাবরই দুঃখের প্রতীক হিসাবে দেখেছেন বুদ্ধ যা সকল মরণশীল সত্তাকে আক্রান্ত করে। পাসেনেদি যেমন মন্তব্য করেছিলেন, তিনি স্বয়ং বুড়িয়ে গেছেন। আনন্দ নিজেও যদি এখন আর তরুণ নেই, প্রভুর মাঝে পরিবর্তন লক্ষ করে সম্প্রতি হতাশা বোধ করেছেন তিনি। তাঁর চামড়া কুঁচকে গেছে, হাত-পা থলথলে হয়ে গেছে, দেহ কুঁজো, অনুভূতি যেন দুর্বল হয়ে আসছে। ‘ঠিক বলেছ, আনন্দ’ সায় দিয়েছেন বুদ্ধ।[৪] বৃদ্ধ বয়স আসলেই নিষ্ঠুর। কিন্তু বুদ্ধের শেষ বছরের কাহিনী বয়সের কারণে কৃচ্ছ্রতা সাধনের বিপর্যয়ের চেয়ে বরং বৃদ্ধ মানুষের নাজুকতার উপরই বেশি আলোকপাত করেছে। উচ্চাভিরাষী তরুণেরা প্রবীনদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায়, ছেলেরা আপন পিতাদের হত্যা করে। বুদ্ধের জীবনের শেষ পর্যায়ে টেক্সট পবিত্রতার অনুভূতি হারিয়ে যাওয়া সন্ত্রাসের জগৎ নিয়ে আলোচনা করেছে। অহমবাদ পরম শাসক হয়ে দাঁড়িয়েছে; ঈর্ষা, ঘৃণা, লোভ ও উচ্চাকাঙ্ক্ষা সহানুভূতি ও প্রেমময়-দয়ায় প্রশমিত হবার নয়। মানুষের আকাঙ্ক্ষার সামনে বাধা হয়ে দাঁড়ানো যে কাউকে নিষ্ঠুরভাবে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। সব রকম শোভনতা ও মর্যাদা অদৃশ্য হয়ে গেছে। প্রায় পঞ্চাশ বছর বুদ্ধ যে বিপদের মোকাবিলা করার চেষ্টা করেছেন সেই বিপদের ওপর গুরুত্ব আরোপ করে ধর্মগ্রন্থগুলো আমাদের সমাজের সহিংসতা ও নিষ্ঠুরতার মুখোমুখি হতে বাধ্য করে যার বিরুদ্ধে আপন স্বার্থহীনতা ও প্রেমময়-দয়ার সংগ্রাম সূচনা করেছিলেন তিনি।
এমনকি সংঘও এই লৌকিক চেতনা মুক্ত ছিল না। আট বছর আগে আরও একবার সংঘাতের কারণে হুমকির মুখে পড়েছিল সংঘ এবং সাঁইত্রিশ বছর ধরে বুদ্ধের নিবেদিতপ্রাণ অনুসারী আরেক বৃদ্ধ রাজা বিম্বিসারাকে হত্যার ষড়যন্ত্রে যোগ দিয়েছিল। কেবল বিনয়াতেই আমরা এই বিদ্রোহের পূর্ণ বিবরণ পাই। এটা সম্পূর্ণ ঐতিহাসিক নাও হতে পারে, তবে সতর্ক বাণী প্রকাশ করে: এমনকি সংঘের নীতিমালা লঙ্ঘিত হতে পারে এবং মারাত্মক করে তোলা যেতে পারে। বিনয়া অনুসারে নাটের গুরু ছিলেন বুদ্ধের শ্যালক দেবদত্ত। কাপিলাবাস্তুতে বুদ্ধের প্রথম বাড়ি সফরের পর সংঘে যোগ দিয়েছিলেন তিনি। পরবর্তী কালের ধারাভাষ্যসমূহ আমাদের বলে যে দেবদত্ত তরুণ বয়স হতেই বিদ্বেষ পরায়ণ ছিলেন। একসঙ্গে বেড়ে ওঠার সময় থেকেই তরুণ গৌতমের তীব্র প্রতিপক্ষ ছিলেন তিনি। কিন্তু পালি টেক্সট এ সম্পর্কে কিছুই জানে না, দেবদত্তকে ব্যক্রিমহীনভাবে নিবেদিতপ্রাণ সন্ন্যাসী হিসাবে উপস্থাপন করেছে। তিনি মেধাবী বাগ্মী ছিলেন বলে মনে হয়। বুদ্ধ বৃদ্ধ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে দেবদত্ত সংঘে তাঁর নিয়ন্ত্রণ নিয়ে অসন্তুষ্ট হয়ে ওঠেন। নিজস্ব শক্তি বলয় গড়ে তোলার সিদ্ধান্ত নেন তিনি। ধর্মীয় জীবনের সবরকম অনুভূতি হারিয়ে ফেলেছিলেন দেবদত্ত। নিষ্ঠুরভাবে আত্মপ্রচারণা শুরু করেছিলেন; তাঁর দৃষ্টি সংকীর্ণ হয়ে পড়েছিল: ভালোবাসায় পৃথিবীর চতুর্কোণে ব্যাপকভাবে বিস্তৃত হওয়ার বদলে সম্পূর্ণ নিজের ভবিষ্যৎ নিয়ে মগ্ন হয়ে পড়েছিলেন, ঘৃণা ও ঈর্ষার হারিয়ে গেছেন। প্রথমে মগধের সেনাপ্রধান ও রাজা বিম্বিসারার উত্তরসুরি রাজকুমার অজাতাশত্তুর শরণাপন্ন হলেন তিনি। ইদ্ধির চোখ ঝলসানো প্রদর্শনীতে মুগ্ধ করে ফেললেন রাজকুমারকে, আপন যোগির ক্ষমতাকে কলুষিত করার সুস্পষ্ট লক্ষণ। কিন্তু দেবদত্তের পৃষ্ঠপোষকে পরিণত হলেন রাজকুমার: প্রতিদিন রাজাগহের উপকণ্ঠে শকুন-চূড়ার আরামায় দেবদত্তের কাছে ভিক্ষুদের জন্যে বিপুল খাবারভর্তি পাঁচশো রথ পাঠাতে লাগলেন। আনুকূল্যপ্রাপ্ত রাজ-সন্ন্যাসীতে পরিণত হলেন দেবদত্ত। তোষামোদ তাঁর মাথা খারাপ করে দিয়েছিল, তিনি সংঘের নিয়ন্ত্রণ কেড়ে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। কিন্তু শ্যালকের কর্মকাণ্ড সম্পর্কে বুদ্ধকে যখন সতর্ক করা হলো, অবিচলিত রইলেন তিনি। এইয়াত্রার অদক্ষ আচরণ দেবদত্তের জন্যে কেবল তিক্ত পরিসমাপ্তিই ডেকে আনতে পারে।[৫]
বুদ্ধ যখন রাজাগহের বাইরে বাঁশ বনে অবস্থান করছিলেন, সেই সময় প্রথম প্রচেষ্টা চালান দেবদত্ত। ভিক্ষুদের এক বিরাট সমাবেশে দেবদত্ত আনুষ্ঠানিকভাবে বুদ্ধকে পদত্যাগ করে সংঘের নিয়ন্ত্রণ তাঁর হাতে ছেড়ে দেওয়ার প্রস্তাব রাখেন। ‘আশীর্বাদপ্রাপ্ত জন এখন বৃদ্ধ হয়েছেন, বহু বছরের বয়সের ভারে ক্লান্ত…জীবনের শেষ পর্যায়ে পৌঁছেছেন,’ তোষামোদের সুরে বললেন তিনি। ‘এখন তাঁকে বিশ্রাম নিতে দাও।’ প্রবলভাবে প্রত্যাখ্যান করলেন বুদ্ধ: এমনকি তাঁর দুই প্রধান অনুসারী সারিপুত্ত ও মগ্গালানার হাতেও সংঘ তুলে দেবেন না তিনি। দেবদত্তের মতো এমন বেপথু মানুষকে কেন এমন পদ দিতে যাবেন? অপমানিত ও হিংস্র হয়ে উঠলেন দেবদত্ত, প্রতিশোধ নেওয়ার প্রতিজ্ঞা করে আরামা ত্যাগ করলেন। সংগঠনের নেতৃত্ব নিয়ে তেমন একটা উদ্বিগ্ন ছিলেন না বুদ্ধ। তিনি বরাবরই জোর দিয়ে এসেছেন, সংঘের, কোনও কেন্দ্রীয় কর্তৃত্বপূর্ণ ব্যক্তির প্রয়োজন নেই, কেননা প্রত্যেক সন্ন্যাসী তার নিজের জন্যে দায়ী। কিন্তু বিরোধ সৃষ্টি করার যেকোনও প্রয়াস, দেবদত্ত যেমন করেছেন, অশুভ। অহমবাদ, উচ্চাকাঙ্ক্ষা, বৈরিতা ও প্রতিযোগিতার পরিবেশ আধ্যাত্মিক জীবনের সঙ্গে মোটেই মানানসই নয়, সংঘের মূল উদ্দেশ্যকেই তা নাকচ করে দেবে। তো বুদ্ধ প্রকাশ্যে নিজেকে এবং সংঘকে দেবদত্ত হতে বিচ্ছিন্ন করে নিয়ে সারিপুত্তকে রাজাগহে দেবদত্তকে নিষিদ্ধ করার নির্দেশ দিলেন। ‘আগে,’ ব্যাখ্যা দিলেন তিনি, ‘এক রকম স্বভাব ছিল দেবদত্তের, এখন ভিন্ন স্বভাব হয়েছে তার।’ কিন্তু ক্ষতি যা হবার হয়ে গিয়েছিল। শহরবাসীদের কেউ কেউ বিশ্বাস করেছিল যে রাজকুমারের সঙ্গে দেবদত্তের নতুন সখ্যতায় ঈর্ষান্বিত হয়ে পড়েছেন বুদ্ধ। কিন্তু অধিকতর বিবেচনা সম্পন্ন ব্যক্তিরা কোনও সিদ্ধান্ত প্রকাশ করেনি।[৬]