এমনি উত্তেজনা ও কর্ম চাঞ্চল্যের ভেতর থাকতেন বুদ্ধের শান্ত নিয়ন্ত্রিত অবয়ব, নতুন ‘জাগ্রত’ পুরুষ। আমাদের মধ্যে যারা তাঁর মতো সম্পূর্ণ আত্ম- পরিত্যাগে অক্ষম তাদের কাছে তিনি অস্পষ্ট ও জ্ঞানাতীত রয়ে যান, কারণ আলোকপ্রাপ্তির পর নৈর্ব্যক্তিক হয়ে গেছেন তিনি, যদিও কখনওই দয়াহীন বা শীতল নন। তাঁর দিক হতে সংগ্রাম বা প্রয়োসের কোনও চিহ্ন নেই। আলোকপ্রাপ্তির রাতে যেমন চেঁচিয়ে উঠেছিলেন, যা করার তার সবই সম্পন্ন করেছেন তিনি। তিনি তথাগত, যিনি অদৃশ্য হয়ে গেছেন। তাঁর কোনও ব্যক্তিগত বন্ধন ছিল না; ছিল না কোনও আগ্রাসী তাত্ত্বিক মতবাদও। পালি টেক্সটে প্রায়শঃ তাঁকে অমানবীয় সত্তার সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে, সেটা তাঁকে অতিপ্রাকৃত মনে করা হয়েছে বলে নয়, বরং মানুষ তাঁকে কোন শ্রেণীতে ফেলতে হবে জানত না বলে। এক ব্রাহ্মণ একদিন দেখলেন, একটা গাছের নিচে স্থির, ধ্যানমগ্ন বুদ্ধ বসে আছেন। ‘তাঁর মানসিক শক্তি বিশ্রামরত, তাঁর মন অটল। তাঁর আশপাশের সবকিছু আত্মনিয়ন্ত্রণ ও প্রশান্তি প্রকাশ করছিল।’ এ দৃশ্য ব্রাহ্মণকে বিস্ময়াভিভূত করে তুলল। বুদ্ধকে দেখে দাঁতাল হাতির কথা মনে হলো তাঁর: অপরিমেয় শক্তি ও বিপুল সম্বাবনাকে নিয়ন্ত্রণে এনে বিরাট শান্তিতে পরিণত করার সেই একই ছবি। শৃঙ্খলা, সংযম ও পরিপূর্ণ প্রশান্তি বিরাজ করছিল। এমন মানুষ কখনও দেখেননি ব্রাহ্মণ। ‘আপনি কি দেবতা, প্রভু?’ জিজ্ঞেস করলেন তিনি। ‘না,’ জবাব দিলেন বুদ্ধ। ‘আপনি কি তবে দেবদূত…বা আত্মায় রূপান্তরিত হচ্ছেন?’ আবার প্রশ্ন করলেন ব্ৰাহ্মণ। কিন্তু বুদ্ধ আবার জবাব দিলেন, তিনি তা নন। ভিন্ন কিছুতে রূপান্তরিত হয়েছিলেন তিনি। হাজার হাজার বছর আগে পৃথিবীতে জীবন কাটানো শেষ বুদ্ধের পর তাঁর মতো মানুষ জগৎ আর দেখেনি। বিগত এক জীবনে একবার দেবতা ছিলেন তিনি, ব্যাখ্যা দিয়েছেন বুদ্ধ; পশু ও সাধারণ মানুষ হিসাবেও জীবন কাটিয়েছেন, কিন্তু প্রাচীন, অসজীব মানবতার সঙ্গে তাঁকে বন্দি করে রাখা সবকিছু নির্বাপিত হয়ে গেছে, ‘একেবারে গোড়ায় কাটা পড়েছে, তাল গাছের গুঁড়ির মতো উপড়ে ফেলা হয়েছে, সম্পূর্ণ উৎপাটিত।’ ব্রাহ্মণ কি কখনও এমন লাল পদ্ম দেখেছেন যেটা জলের গভীরে জীবন শুরু করে জল ছাড়িয়ে না যাওয়া পর্যন্ত পুকুরের ওপর উঠে এসেছে? জিজ্ঞেস করলেন বুদ্ধ। আমিও পৃথিবীতে জন্ম নিয়ে বড় হয়েছি,’ অতিথিকে বললেন তিনি। ‘কিন্তু আমি জগৎ ছাড়িয়ে গেছি। এখন আর এর সংস্পর্শে নেই।’ এই জীবনে নিব্বানা লাভের মাধ্যমে মানুষের প্রকৃতিতে এক নতুন সম্ভাবনার প্রকাশ ঘটিয়েছেন তিনি। বেদনার এই জগতে অবশিষ্ট সৃষ্টির সঙ্গে শান্তিতে, নিজের সঙ্গে সুনিয়ন্ত্রিত ও সামঞ্জস্যের সঙ্গে বাঁচা সম্ভব। কিন্তু এই শান্ত নিষ্কৃতি লাভের জন্যে নারী- পুরুষকে অহমবাদ হতে বেরিয়ে এসে সম্পূর্ণ অন্যান্য সত্তার স্বার্থে জীবন যাপন করতে হবে। বহিরাগত কারও কাছে যত ভীতিকরই মনে হোক না কেন সত্তার কাছে এমন মৃত্যু-অন্ধকার নয়। এটা মানুষকে তার নিজস্ব প্রকৃতি সম্পর্কে সম্পূর্ণ সজাগ করে তোলে যাতে তারা নিজেদের ক্ষমতার সর্বোচ্চ বিন্দুতে বাস করতে পারে। বুদ্ধকে কেমন করে শ্রেণীবন্ধ করবেন ব্রাহ্মণ? ‘আমার কথা মনে রেখ,’ তাঁকে বলেছেন বুদ্ধ, ‘জাগ্রত একজন হিসাব।[৫৬]
তথ্যসূত্র
১. সাম্যত্তা নিকয়া, ২২: ৮৭।
২. অ্যান্ড্রু স্কিলটন, আ কনসাইজ হিস্ট্রি অভ বুদ্ধজম, বার্মিংহাম, যুক্তরাজ্য, ১৯৯৪, ১৯।
৩. বিনয়া: কুলাভাগ্য, ১: ১২; সুকুমার দত্ত, বুড্ডিস্ট মঙ্কস অ্যান্ড মনাস্টারিজ অভ ইন্ডিয়া, লন্ডন, ১৯৬২, ২২।
৫. বিনয়া: মহাভাগ্য, ১: ১৩।
৬. প্রাগুক্ত, ১: ১৪-২০।
৭. মির্চা এলিয়াদ, ইয়োগা, ইমমর্টালিটি অ্যান্ড ফ্রিডম (অনু. উইলিয়াম আর, ট্রাস্ক); লন্ডন, ১৯৫৮, ৮৫-৯০।
৮. সুত্তা নিপাতা, ১৩৬; উদনা, ১: ৪।
৯. বিনয়া: মহাভাগ্য, ১: ২০।
১০. প্রাগুক্ত, ১: ২১; সাম্যত্তা নিকয়া, ৩৫: ২৮।
১১. রিচার্ড এফ. গমব্রিচ; থেরাভেদা বুদ্ধজম: আ সোশ্যাল হিস্ট্রি ফ্রম অ্যানশেন্ট বেনারেস টু মডার্ন কলোম্বো, লন্ডন ও নিউ ইয়র্ক, ১৯৮৮, ৬৫-৬৯।
১২. বিনয়া: মহাভাগ্য, ১: ২১।
১৩. প্রাগুক্ত, ১: ২২।
১৪. প্রাগুক্ত, ১: ২৩।
১৫.এডোয়ার্ড কনযে, বুদ্ধজম; ইটস্ এসেন্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট, অক্সফোর্ড ১৯৫৭, ৯১-৯২।
১৬. বিনয়া: মহাভাগ্য, ১: ২৪।
১৭. জাতকা, ১: ৮৭; আঙুত্তারা নিকয়ার ব্যাখ্যা, ১: ৩০২; এডোয়ার্ড জে. টমাস. দ্য লাইফ অভ বুদ্ধা ইন লেজেন্ড অ্যান্ড হিস্ট্রি, লন্ডন, ১৯৬৯, ৯৭- ১০২; ভিক্ষু নানামোলি (অনু. ও সম্পা.), দ্য লাইফ অভ দ্য বুদ্ধা, অ্যাকর্ডিং টু দ্য পালি ক্যানন, ক্যান্ডি, ক্যান্ডি, শ্রী লঙ্কা, ১৯৭২, ৭৫-৭৭।
১৮. টমাস, লাইফ অভ বুদ্ধা, ১০২-৩
১৯. বিনয়া কুলাভাগ্য, ৬: ৪; সাম্যত্তা নিকয়া, ১০: ৮।
২০. ট্রেভর লিঙ, দ্য বুদ্ধা: বুড্ডিস্ট সিভিলাইজেশন ইন ইন্ডিয়া অ্যান্ড সিলোন, লন্ডন, ১৯৭৩, ৪৬-৪৭।
২১. বিনয়া: কুলাভাগ্য, ৬: ৪; সাম্যত্তা নিকয়া ১০: ৮।
২২. দত্ত, বুড্ডিস্ট মঙ্কস, ৫৮।
২৩. বিনয়া: মহাভাগ্য, ৩: ১।
২৪. প্রাগুক্ত, ৮: ২৭।