এই কাহিনী আমাদের আদি সংঘ সম্পর্কে অনেক কিছু জানায়। সুসংহত সংগঠন ও কেন্দ্রীয় কর্তৃত্ব বলে কিছু ছিল না। প্রাচীন রাজ্যগুলোর সংঘের কাছাকাছি ছিল তা, যেখানে পরিষদের সকল সদস্যের মর্যাদা ছিল সমান। বুদ্ধ কর্তৃত্বপরায়ণ ও নিয়ন্ত্রক শাসক হতে অস্বীকৃতি জানিয়েছেন। পরবর্তী কালের ক্রিশ্চান ধর্মীয় সংস্থার ফাদার সুপিরিয়রের মতো ছিলেন না তিনি। আসলে একে একটি সংগঠন বলা ঠিক হবে না, বরং বিভিন্ন ধরনের সংগঠন একই ধৰ্ম্ম অনুসরণ করত ও একই জীবনধারা অনুযায়ী চলত। ছয় বছর পর পর বিক্ষিপ্ত ভিক্ষু ও ভিক্ষুনিরা ‘পতিমোক্ষ’ (‘শপথ’) নামে পরিচিত বিশ্বাসের ঘোষণা দিতে সমবেত হতেন।[৫২] নামটা যেমন বোঝায়, সংঘকে এক সূত্রে গাথাই ছিল এর উদ্দেশ্য:
ক্ষতিকর সমস্ত কিছু হতে বিরত থেকো
যা কিছু দক্ষ তা অর্জন করো
মনকে পরিশুদ্ধ করো,
এটাই বুদ্ধের শিক্ষা।
আত্ম সংযম ও ধৈর্য সমস্ত কৃচ্ছ্রতার
মাঝে সেরা,
বুদ্ধ ঘোষণা দিয়েছেন যে নিব্বানাই
সর্বোত্তম মূল্য,
অপরকে যে আঘাত করেনি সেই সত্যিকার
অর্থে গৃহস্থ জীবন হতে ‘অগ্রসর’ হতে পেরেছে।
অপরকে যে আহত করে না সে-ই প্রকৃত সন্ন্যাসী।
ছিদ্রান্বেষণ নয়, নয় ক্ষতি, নয় সংযম,
খাদ্য, একক শয্যা ও আসন সম্পর্কে জানা
ধ্যান হতে প্রাপ্ত উচ্চতর অনুভূতি প্রয়োগ,
জাগ্রত জন এই শিক্ষাই দিয়েছেন।[৫৩]
প্রজাতন্ত্রগুলোর বৈশিষ্ট্য পূর্ণ সম্মেলনের অনুরূপ এই অনুষ্ঠানের প্রতি বেশ গুরুত্ব আরোপ করেছিলেন বুদ্ধ। কাউকেই পতিমোক্ষ থেকে অনুপস্থিত থাকার সুযোগ দেওয়া হতো না, কারণ কেবল এই বিষয়টি আদি সংঘকে একত্রিত রেখেছিল।
অনেক পরে, বুদ্ধের পরলোকগমনের পর, সহজ আবৃত্তিকে আরও বিস্ত ারিত জটিল সম্মেলন দিয়ে পুনস্থাপিত করা হয়। প্রত্যেক অঞ্চলে পাক্ষিক ভিত্তিতে স্থানীয় সম্প্রদায় উপসোথা দিবসে এর আয়োজন করে। এই পরিবর্তন সংঘের একটি গোত্র হতে সংঘে পরিবর্তন তুলে ধরে। অন্য গোত্র থেকে পৃথককারী ধম্ম না গেয়ে সন্ন্যাসী ও সন্ন্যাসীনিরা সংঘের বিধিবিধান আবৃত্তি করতেন ও পরস্পরের কাছে অধিকার লঙ্ঘনের দায় স্বীকার করতেন। ততদিনে সংঘের বিধানের সংখ্যা বুদ্ধের আমলের তুলনায় অনেক বেড়ে গিয়েছিল। কোনও কোনও পণ্ডিত যুক্তি দেখান যে, বিনয়ায় লিপিবদ্ধ নিয়ম কানুন চূড়ান্ত রূপ নিতে দুই থেকে তিন শতাব্দী সময় লেগেছে। কিন্তু কেউ কেউ বিশ্বাস করেন, সংগঠনের চেতনা অন্ততপক্ষে মোটামুটিভাবে খোদ বুদ্ধ পর্যন্ত খুঁজে পাওয়া সম্ভব।[৫৪]
সংঘই বৌদ্ধ মতবাদের প্রাণ, কারণ এর জীবনধারা বাহ্যিকভাবে নিব্বানার অন্তস্থ অবস্থা ধারণ করে।[৫৫] সন্ন্যাসী ও সন্ন্যাসীনিদের অবশ্যই কেবল গৃহ হতেই ‘অগ্রসর হতে’ হবে না বরং সত্তাও ত্যাগ করতে হবে। একজন ভিক্ষু ও ভিক্ষুনি প্রাপ্তি ও ব্যয়ের সঙ্গে সম্পর্কিত ‘আকাঙ্ক্ষা’ বিসর্জন দিয়েছেন, তাদের যা দেওয়া হয় সম্পূর্ণ তার উপর নির্ভর করেন তাঁরা। সামান্যেই সন্তুষ্ট থাকেন। সংঘের জীবনধারা সদ্যস্যদের ধ্যানে সাহায্য করে আমাদের দুঃখ-কষ্টের চাকায় বেঁধে রাখা অজ্ঞতা, লোভ ও ঘৃণার আগুন দূর করতে সক্ষম করে তোলে। সহানুভূতি ও সাম্প্রদায়িক ভালোবাসার আদর্শ নিজস্ব অহমবাদ একপাশে সরিয়ে রেখে অন্যের জন্যে বাঁচতে শেখায়। এইসব প্রবণতাকে অভ্যাসে পরিণত করে সন্ন্যাসী ও সন্ন্যাসীনিরা অটল অন্তস্থ শান্তি –পবিত্র জীবনের মোক্ষ-নিব্বানা অর্জন করতে পারে। সংঘ পৃথিবীর বুকে এখনও টিকে থাকা অন্যতম প্রাচীন স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা। একমাত্র জৈন সংগঠনই এমনি প্রাচীনত্ব দাবি করতে পারে। এর স্থায়িত্ব মানুষ ও মানবীয় জীবন সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ একটা কিছু জানায় আমাদের। সুবিশাল সৈন্যবাহিনী দিয়ে পারিচালিত বিরাট বিরাট রাজ্য ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে গেছে। কিন্তু ভিক্ষুদের সংগঠন প্রায় ২,৫০০ বছর টিকে আছে। আদি বুদ্ধ কিংবদন্তীতে বুদ্ধ ও চক্কবত্তীকে পাশাপাশি দেখিয়ে যে বৈপরীত্যের আভাস দেওয়া হয়েছিল: এটা তাই। বার্তাটিকে এমন মনে হয় যে, নিজেকে রক্ষা করে নয়, বরং নিজেকে বিলিয়ে দিয়েই আপনি বেঁচে থাকতে পারেন।
কিন্তু সংঘের সদস্যরা সিংহভাগ জনগণের জীবনধারার দিকে পিঠ ফিরিয়ে নিলেও সাধারণভাবে লোকে কিন্তু তাঁদের প্রতি অসন্তুষ্ট হয়নি, বরং তাঁদের দারুণভাবে আকর্ষণীয় মনে করেছে। এটাও আমাদের জানায় যে বুদ্ধের আবিষ্কৃত জীবন পদ্ধতি অমানবিক মনে করা হয়নি, বরং গভীরভাব মানবিক আরামাগুলো নির্জন আউটপোস্ট ছিল নাঃ রাজণ্য, ব্রাহ্মণ, বণিক, ব্যবসায়ী, আমাত্য, অভিজাত এবং অন্যান্য গোত্রের সদস্যরা ভিড় জমাতেন এখানে। পাসেনেদি ও বিম্বিসারা নিয়মিত বুদ্ধের পরামর্শের জন্যে আসতেন। বুদ্ধ হয়তো অপরাহ্নে পদ্মপুকুরের ধারে বসে থাকতেন, কিংবা কুঁড়ে ঘরের বারান্দায় বসে মোমবাতির শিখায় মথের ঝাঁপিয়ে পড়া দেখতেন। বুদ্ধ বসতিগুলোয় সাধুদের ভিড় জমানোর কথা পড়ি আমরা। বুদ্ধকে প্রশ্ন করতে প্রতিনিধি দল আসত। হাতির পিঠে চেপে অভিজাতজন ও বণিকরা আসতেন এবং কোনও অঞ্চলের তরুণের দল বুদ্ধকে খাবার আমন্ত্রণ জানাতে সদলবলে হাজির হতো।