এই নারী বিদ্বেষ হতে কী বুঝতে পারি আমরা? বুদ্ধ সবসময়ই নারী ও পুরুষ উভয়কে শিক্ষা দিয়েছেন। তিনি অনুমতি দেওয়ার পর হাজার হাজার নারী ভিক্ষুনিতে পরিণত হয়েছে। তাদের আধ্যাত্মিক অর্জনের প্রশংসা করেছেন বুদ্ধ। বলেছেন তারা সন্ন্যাসীদের সমপর্যায়ের হতে পারে। যথেষ্ট প্রাজ্ঞ সন্ন্যাসী ও ভিক্ষুনি, সাধারণ পুরুষ ও সাধারণ নারী অনুসারী না সংগ্রহ করা পর্যন্ত পরলোকে না যাওয়ার ভবিষ্যদ্বাণী করেছেন।[৪৫] টেক্সটে কোনও রকম বৈসাদৃশ্য আছে বলে মনে হয়। এটা কোনও কোনও পণ্ডিতকে এই উপসংহারে পৌঁছতে তাড়িত করেছে যে, নারীদের গ্রহণ করার বেলায় ক্রুদ্ধ সম্মতির কাহিনী ও আটটি বিধান পরবর্তী সময়ে সংযোজন, তা সংগঠনের পুরুষতান্ত্রিকতাকে প্রতিফলিত করে। বিসিই প্রথম শতাব্দী নাগাদ সন্ন্যাসীদের কেউ কেউ অবশ্যই তাঁদের আলোকপ্রাপ্তি হতে দূরে ঠেলে রাখা যৌনাকাঙ্ক্ষার জন্যে নারীদের দায়ী করেছেন। নারীদের তাঁরা আধ্যাত্মিক অগ্রগতির পথে সর্বজনীন বাধা হিসাবে দেখেছেন। অন্য পণ্ডিতগণ যুক্তি দেখিয়েছেন যে, আলোকপ্রাপ্ত হলেও বুদ্ধ সেই সময়ের সামাজিক শর্তাবলী এড়িয়ে যেতে পারেননি। পিতৃতান্ত্রিক নয়, এমন সমাজ কল্পনা করতে পারেননি তিনি। তাঁরা যুক্তি তুলে ধরেছেন, বুদ্ধের প্রাথমিক অনীহা সত্ত্বেও নারীদের অন্তর্ভুক্তি ব্যতিক্রমী কাজ ছিল যা প্রথমবারের মতো নারীদের সংসারের বাইরে একটা বিকল্পের সন্ধান দিয়েছিল।[৪৬]
একথা সত্যি হলেও নারীদের জন্যে সমস্যা ছিল যা উপেক্ষা করা ঠিক হবে না। বুদ্ধের মনে নারীরা হয়তো আলোকনকে অসম্ভব করে তোলা ‘কামনা’ হতে অবিচ্ছেদ্য ছিল। বাড়ি ছেড়ে সন্ধানে নামার সময় কোনও কোনও গৃহত্যাগীর মতো স্ত্রীকে সঙ্গী করার কথা ভাবেননি তিনি। স্রেফ ধরে নিয়েছিলেন তিনি (স্ত্রী) মুক্তি লাভে সঙ্গী হতে পারবেন না। কিন্তু সেটা গীর্জার ক্রিশ্চান ফাদারদের মতো যৌনতাকে বিরক্তিকর ভেবেছিলেন বলে নয়, বরং স্ত্রীর প্রতি আকৃষ্ট ছিলেন তিনি। ধর্মগ্রন্থে একটি অনুচ্ছেদ রয়েছে যা সন্ন্যাসীদের প্রক্ষেপণ বলে পণ্ডিতগণ একমত। ‘প্রভু, আমরা নারীদের সঙ্গে কেমন আচরণ করব?’ জীবনের শেষ দিকে বুদ্ধকে জিজ্ঞেস করলেন আনন্দ। ‘ওদের দিকে তাকিয়ো না, আনন্দ।’ ‘ওদের দিকে না তাকালে কেমন করে আচরণ করব?’ ‘ওদের সঙ্গে কথা বলো না, আনন্দ।’ ‘কিন্তু যদি কথা বলতে হয়?’ ‘অবশ্যই অভিনিবেশ পালন করতে হবে, আনন্দ।’[৪৭] বুদ্ধ ব্যক্তিগতভাবে হয়তো নারী বিদ্বেষ সমর্থন করতেন না, কিন্তু এমন হতে পারে যে এই কথাগুলো তিনি অতিক্রম করতে পারেননি এমন অস্বস্তির অবশেষ।
বুদ্ধ নারীদের ব্যাপারে নেতিবাচক ধারণা পোষণ করে থাকলে সেটা অ্যাক্সিয়াল যুগেরই রেওয়াজ। দুঃখজনক যে, সভ্যতা নারীর প্রতি সদয় ছিল না। প্রত্নতাত্ত্বিক আবিষ্কারসমূহ দেখায়, প্রাক-শহুরে সমাজে কখনও কখনও নারী উচ্চ মর্যাদা পেয়েছে, কিন্তু সামরিক রাষ্ট্রের উত্থান ও আদি নগরসমূহে বিশেষায়ণ তাদের অবস্থানের অবনতি ঘটিয়েছে। পুরুষ মানুষের সম্পত্তিতে পরিণত হয়েছে তারা, প্রায় সব পেশা হতে বাদ পড়েছে এবং মাঝে মাঝে প্রাচীন কোনও আইনি বিধানের কারণে নিষ্ঠুর নিয়ন্ত্রণের শিকার হয়েছে। অভিজাত নারীগণ কিছুটা ক্ষমতা ধরে রাখতে পেরেছেন, বুদ্ধ যখন ভারতে ধর্ম প্রচারণা করছেন, তখন অ্যাক্সিয়াল দেশসমূহে নারীরা আরও মর্যাদা হারিয়েছে। ইরান, ইরাক ও পরবর্তীকালে হেলেনিস্টিক দেশসমূহে মহিলাদের পর্দার আড়ালে হেরেমে বন্দি করা হয়েছে। নারী বিদ্বেষী ধ্যান-ধারণা বিকাশ লাভ করেছে। ধ্রুপদী এথেন্সের (৫০০-৩২৩) নারীরা বিশেষভাবে সুবিধা বঞ্চিত এবং সমাজ হতে প্রায় বিচ্ছিন্ন ছিল। কথিত আছে, নীরবতা ও আত্মসমর্পণই ছিল তাদের প্রধান গুণ। আদি হিব্রু ট্র্যাডিশনসমূহ মিরিয়িাম, ডেবোরাহ্ ও জায়েলের মতো নারীদের কাহিনীকে মর্যাদা দিয়েছে, কিন্তু বিশ্বাসের পয়গম্বরীয় সংস্কারের পর ইহুদি আইনে তাদের দ্বিতীয় শ্রেণীতে অবনমিত করা হয়েছে। উল্লেখযোগ্য, মিশরের মতো দেশে, যা কিনা প্রাথমিকভাবে অ্যাক্সিয়াল যুগে অংশ নেয়নি, নারীদের প্রতি অধিকতর উদার দৃষ্টিভঙ্গি ছিল।[৪৮] মনে হয়, নতুন আধ্যাত্মিকতার নারীদের প্রতি এক ধরনের অন্তর্গত বৈরিতা ছিল যা আমাদের সময় পর্যন্ত অব্যহত রয়ে গেছে। বুদ্ধের অন্বেষণ বীরত্বের দিক থেকে পুরুষালি: সব বাধা দূর করার প্রতিজ্ঞা, গৃহস্থ জগৎ ও নারীদের প্রত্যাখ্যান, নিঃসঙ্গ সংগ্রাম ও নতুন জগতে প্রবেশ, সমস্তই পুরুষালি গুণের প্রতাঁকে পরিণত হয়েছে। কেবল আধুনিক যুগে ক্রমেই এই প্রবণতার পরিবর্তন ঘটেছে। নারী তার নিজস্ব ‘যুক্তি’ খুঁজে নিয়েছে (এমনকি বুদ্ধের মতো একই শব্দ ব্যবহার করেছে তারা)। তারাও পুরোনো কৰ্তৃত্ব অস্বীকার করেছে এবং নিজস্ব নিঃসঙ্গ যাত্রায় নেমেছে।
নারীরা সংগঠনকে ধ্বংস করবে বলে ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন বুদ্ধু, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে সংঘে প্রধান সংকট দেখা দিয়েছিল পুরুষ অহমের সংঘাতের কারণে।[৪৯] বৌদ্ধ নীতিমালা অনুযায়ী অন্যায়কারী ভুল না বোঝা পর্যন্ত কোনও অপরাধ শাস্তিযোগ্য নয়। কোসাম্বিতে একজন আন্তরিক ও জ্ঞানী সাধুঁকে বহিষ্কার করা হয়। এই শাস্তিকে অন্যায় বলে প্রতিবাদ করেন তিনি, যেহেতু অন্যায় করার বিষয়টি তিনি বুঝতে পারেননি। কোসাম্বির ভিক্ষুরা নিমেষে বৈরী উপদলে ভাগ হয়ে যায়। বুদ্ধ এই বিভেদে এমনই বিপর্যস্ত বোধ করেছিলেন যে এক পর্যায়ে একাকী বনে বাস করতে চলে যান তিনি, আগ্রাসী সঙ্গীদের কাছে নাস্তানাবুদ এক হাতির সঙ্গে সখ্য গড়ে তোলেন। ঘৃণা, বলেছেন বুদ্ধ, কখনও আরও ঘৃণায় হ্রাস পায় না। কেবল বন্ধুত্ব ও সহানুভূতি দিয়েই তা নাকচ করা সম্ভব।[৫০] তিনি বুঝতে পেরেছিলেন, উভয় দলই ন্যায়ের পক্ষে আছে; কিন্তু বুদ্ধ এক পক্ষকে অন্য পক্ষের অবস্থান বোঝানোর চেষ্টা সত্ত্বেও সকল ভিক্ষুর অহমবাদ অপর পক্ষের দৃষ্টিভঙ্গি বোঝা অসম্ভব করে তুলেছিল। সারিপুত্ত ও নারীদের সংঘের প্রধান পজাপতিকে তিনি তিনি দু’পক্ষকেই সম্মানের সঙ্গে দেখাতে বলেছেন। উভয় শিবিরকে নিরপেক্ষভাবে দান করার নির্দেশ দিয়েছেন অনাথাপিন্দিকাকে। কিন্তু কোনও সমাধান চাপিয়ে দেননি তিনি। খোদ অংশগ্রহণকারীদের ভেতর থেকেই সমধান আসতে হবে। শেষ পর্যন্ত বরখাস্ত ভিক্ষু শান্ত হলেন: যদিও সেটা তার জানা ছিল না, কিন্তু তিনি অপরাধ করেছেন। অবিলম্বে পুনর্বহাল করা হলো তাঁকে এবং বিবাদের পরিসমাপ্তি ঘটল।[৫১]