সকল প্রাণী সুখী হোক! শক্তিশালী কি দুর্বল, উচ্চ, মধ্য
বা নিচু গোত্রের,
ক্ষুদ্র বা বৃহৎ, দৃশ্য বা অদৃশ্য, কাছের বা দূরের,
জীবিত বা জন্ম প্রত্যাশী-সকলেই সুখী হোক!
কেউ যেন কাউকে মিথ্যা না বলে বা কোথাও কোনও সত্তাকে
ঘৃণা না করে।
কেউ যেন ক্রোধ
বা ঘৃণা বশত কোনও প্রাণীর অমঙ্গল কামনা না করে!
আসুন সকল প্রাণীর লালন করি, মা যেমন তার সন্তানকে লালন করে।
আমাদের প্রেমময় চিন্তা যেন ঊর্ধ্ব-অধের গোটা পৃথিবীকে পরিপূর্ণ করে
সীমাহীনভাবে; এক সীমাহীন শুভেচ্ছা গোটা জগতের প্রতি,
ঘৃণা ও শত্রুতা হতে মুক্ত, বাধাহীন![৪৩]
এই প্রবণতা অর্জনকারী সাধারণ মানুষ আধ্যাত্মিক পথে বহুদূর অগ্রসর হয়েছে।
ধর্মগ্রন্থসমূহ সংঘের বাইরে ধ্যানের চর্চা করে নিব্বানা লাভকারী সাধারণ শিক্ষাব্রতী সম্পর্কে গুটিকয় নজীর তুলে ধরে, তবে নিঃসঙ্গ অলোকসামান্য ব্যক্তিগণ নিয়ম নন বরং ব্যতিক্রম ছিলেন। মনে করা হতো যে, কোনও আরাহান্তের পক্ষে সংসার জীবন অব্যাহত রাখা সম্ভব নয়: আলোকপ্রাপ্ত হওয়ার পরই হয় তিনি সংঘে যোগ দেবেন বা মারা যাবেন। দৃশ্যতঃ বুদ্ধের বাবা শুদ্ধোদনের বেলায় এমনটাই ঘটেছিল, ছেলের দীক্ষা দানের পঞ্চম বছরে নিব্বানা অর্জন করেন তিনি এবং পরদিনই মারা যান। বুদ্ধ এই সংবাদ পেয়ে কাপিলবাস্তুতে ফিরে কিছুদিন নিগরোধা উদ্যানে অবস্থান করেছিলেন। এই ঘটনা সংঘের নতুন পরিবর্তন বয়ে এনেছিল, বুদ্ধ প্রথমে যাকে ভালোভাবে নেননি বলেই মনে হয়।
তিনি নিগরোধ আরামায় অবস্থান করার সময় বাবার বিধবা স্ত্রী ও বুদ্ধের খালা পজাপতি গৌতমী তাঁর কাছে আসেন। আপন মায়ের মৃত্যুর পর তাঁর পালক মায়ে পরিণত হয়েছিলেন তিনি। যেহেতু এখন তিনি মুক্ত, বোনের ছেলেকে বলেন তিনি, তাই সংঘে যোগ দিতে চান। জোরের সাথে প্রত্যাখ্যান করলেন বুদ্ধ। সংগঠনে মহিলাদের গ্রহণ করার প্রশ্নই ওঠে না। এমনকি পজাপতি তিনবার বিবেচনার আবেদন জানানো সত্ত্বেও সিদ্ধান্ত পাল্টাবেন না তিনি। খুবই দুঃখের সঙ্গে বিদায় নিলেন পজাপতি। কয়েকদিন পর গঙ্গার উত্তর তীরবর্তী বিদেহা প্রজাতন্ত্রের রাজধানী বেসালির উদ্দেশে রওনা হলেন বুদ্ধ। প্রায়শঃই সেখানকার আরামায় অবস্থান করতেন তিনি। উঁচু ছাদঅলা একটা মিলানায়তন ছিল এখানে। বারান্দায় অন্যান্য শাক্য মহিলাদের সঙ্গে পজাপতিকে কাঁদতে দেখে শঙ্কিত হয়ে উঠলেন আনন্দ। চুল কেটে ফেলেছেন মহিলা, গায়ে গেরুয়া বসন চাপিয়ে সেই কাপিলাবাস্তু থেকে পায়ে হেঁটে এসেছেন এত দূর। পা ফুলে গিয়েছিল তাঁর, ধূলিমলিন, পরিশ্রান্ত হয়ে পড়েছিলেন। ‘গৌতমী,’ চেঁচিয়ে উঠলেন আনন্দ; ‘এখানে এই হালে কী করছেন আপনি? কাঁদছেনই বা কেন?’ ‘কারণ আশীবার্দপ্রাপ্ত জন সংঘে মেয়েদের যোগ দিতে দেবেন না।’ জবাব দিলেন পজাপতি। উদ্বিগ্ন বোধ করলেন আনন্দ। ‘এখানে অপেক্ষা করুন,’ বললেন তিনি। ‘এব্যাপারে তথাগতকে জিজ্ঞেস করছি আমি।’
কিন্তু তারপরও ব্যাপারটা বিবেচনা করতে অস্বীকার গেলেন বুদ্ধ। গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্ত এটা। নারীদের সংঘের বাইরে রাখা অব্যাহত রাখলে তার মানে দাঁড়াত মানবজাতির অর্ধেক অংশকে আলোকপ্রাপ্তির অযোগ্য মনে করছেন তিনি। কিন্তু ধম্ম সবার হওয়ার কথা: দেবতা, পশুপাখি, ডাকাত, সকল গোত্রের মানুষ–কেবল নারীরাই বাদ পড়বে? কেবল পুরুষ হিসাবে পুনর্জন্মই তাদের সবচেয়ে ভালো আশা হবে? অন্যভাবে চেষ্টা করলেন আনন্দ। ‘প্রভু,’ জিজ্ঞেস করলেন তিনি, ‘নারীরা “স্রোতে প্রবেশকারী” হয়ে শেষ পর্যন্ত আরাহান্ত হওয়ার যোগ্যতা রাখে?’ ‘রাখে, আনন্দ,’ জবাব দিলেন বুদ্ধ। ‘তাহলে পজাপতিকে বরণ করে নেওয়াই মঙ্গলজনক হবে,’ আবেদন জানালেন আনন্দ। মায়ের মৃত্যুর পর মহিলার আদর যত্নের কথা মনে করিয়ে দিলেন তিনি গুরুকে। অনীহার সঙ্গে পরাজয় মেনে নিলেন বুদ্ধ। আটটি কঠিন নিয়ম মেনে নিলেই কেবল সংঘে প্রবেশ করতে পারবেন পজাপতি। এই বিধানগুলো এটা পরিষ্কার করে নিয়েছে যে নানরা (ভিক্ষুনি) নিম্ন পর্যায়ের গোত্র। অল্পবয়সী বা নব্য দীক্ষিত হলেও পুরুষ ভিক্ষুর উপস্থিতিতে ভিক্ষুনিকে অবশ্যই দাঁড়িয়ে থাকতে হবে; নানদের সবসময় বাস্যার অবকাশ কোনও আরামায় একাকী নয় বরং পুরুষ সন্ন্যাসীদের সঙ্গে কাটাতে হবে; পাক্ষিক একবার একজন পুরুষ ভিক্ষুর কাছে সবক নিতে হবে; নিজেরা কোনও শাস্ত্রাচার করতে পারবে না; গুরুতর অন্যায়কারী পাপীকে ভিক্ষুনি ও সন্ন্যাসীদের উপস্থিতিতে প্রায়শ্চিত করতে হবে; একজন ভিক্ষুনিকে অবশ্যই পুরুষ ও নারী উভয় সংঘের কাছে যাজকানুষ্ঠানের অনুরোধ জানাতে হবে; সে কখনও কোনও ভিক্ষুকে বকাঝকা করতে পারবে না, যদিও যেকোনও সন্ন্যাসী তাকে ভর্ৎসনা করতে পারবে; ভিক্ষুদের শিক্ষাও দিতে পারবে না সে। সানন্দে এইসব বিধান মেনে নিলেন পজাপতি। বরণ করে নেওয়া হলো তাঁকে। কিন্তু তারপরও অস্বস্তিতে ভুগছিলেন বুদ্ধ। মহিলাদের যোগ দিতে না দেওয়া হলে, আনন্দকে বললেন তিনি, ধম্ম হয়তো হাজার বছর ধরে পালিত হতো। এখন বড় জোর পাঁচ শো বছর টিকে থাকবে। অসংখ্য নারী বিশিষ্ট গোত্র দুর্বল হয়ে ধ্বংস হয়ে যাবে; একইভাবে নারী সদস্যঅলা কোনও সংঘ বেশিদিন টিকতে পারে না। ধান ক্ষেতে ছত্রাকের মতো সংগঠনের ওপর ছড়িয়ে পড়বে তারা।[৪৪]