আমরা কালামানদের[৪০] উদ্দেশে প্রদত্ত হিতোপদেশে বুদ্ধের সাধারণ মানুষকে শিক্ষা দেওয়ার কৌশল দেখতে পাই। গাঙ্গেয় উপত্যকার সবচেয়ে উত্তর সীমানায় ছিল এই জাতির বাস। এককালে গোত্রীয় রাজ্য পরিচালনা করলেও এখন কোসালার প্রজায় পরিণত হয়েছে। ক্রমশঃ নতুন শহুরে সভ্যতার অধীনে নিয়ে আসা হচ্ছিল তাদের। এই অভিজ্ঞতা তাদের কাছে অনিশ্চিত ও অপমানকর মনে হয়েছে। বুদ্ধ তাদের কেসাপুত্ত শহর দিয়ে যাওয়ার সময় পরামর্শ চেয়ে এক প্রতিনিধি দল পাঠাল তারা। একের পর এক সাধু আর শিক্ষক তাদের ওপর অবতীর্ণ হয়েছেন, ব্যাখ্যা করল তারা, কিন্তু প্রত্যেক সন্ন্যাসী ও ব্রাহ্মণ যার যার নিজস্ব মতবাদ ব্যাখ্যা করেছেন, অন্যদের অভিশম্পাত করেছেন তাঁরা। এইসব ধম্ম কেবল পরস্পর বিরোধীই নয়, সুসংস্কৃত মূলধারার সংস্কৃতির অংশ বলে অচেনাও ছিল। ‘এইসব শিক্ষকের কে সঠিক, কে ভুল?’ জানতে চাইল তারা। বুদ্ধ বললেন কালামানদের বিভ্রান্ত বোধ করার কারণ বুঝতে পেরেছেন তিনি। যাথারীতি তাদের অবস্থায় প্রবেশ করলেন তিনি। গড়গড় করে নিজ ধম্ম ব্যাখ্যা করতে গিয়ে তাদের বিভ্রান্তি বাড়াননি, মোকাবিলা করার জন্যে নতুন কোনও মতবাদ শোনাননি তাদের, বরং কালামানরা যাতে নিজেরাই সমাধান খুঁজে নিতে পারে, সেজন্যে তাৎক্ষণিক প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেছেন (সক্রেটিস ও কনফুসিয়াসের মতো অন্যান্য অ্যাক্সিয়াল সাধুদের প্রশ্ন ও উত্তর পদ্ধতির স্মারক)। তিনি এই বলে শুরু করলেন যে, তাদের হতবুদ্ধি হওয়ার অন্যতম কারণ অন্যদের কাছ থেকে জবাব পাওয়ার আশা করছে তারা। কিন্তু যখন নিজেদের হৃদয়ের দিকে চোখ ফেরাবে তখনই বুঝতে পারবে আসলে কোনটা সঠিক।
‘শোন, কালামানবাসী,’ বললেন তিনি। ‘শোনা কথায় সন্তোষ বোধ করো না বা সরল বিশ্বাসে সত্য হিসাবে মেনে নিয়ো না।’ নৈতিকতার প্রশ্নে মানুষকে নিজেরই সিদ্ধান্ত নিতে হবে। যেমন ধরা যাক, লোভ কি ভালো নাকি খারাপ? ‘খারাপ, প্রভু।’ জবাব দিল কালামানরা। তারা কি লক্ষ করেছে যখন কেউ আকাঙ্ক্ষায় তাড়িত হয়ে কোনও কিছু পেতে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ হয়ে ওঠে তখন হত্যা, চুরি বা মিথ্যার আশ্রয় নিতে পারে সে? হ্যাঁ, কালামনরা এ ব্যাপারটি লক্ষ করেছে। এই ধরনের আচরণ স্বার্থপর মানুষকে কি অজনপ্রিয় ও সেকারণে অসুখী করে না? আর ঘৃণার বেলায়? কিংবা বস্তুকে স্বরূপে দেখার চেষ্টা করার বদলে স্পষ্টতই বিভ্ৰমকে আঁকড়ে থাকা? এইসব আবেগ কি বেদনা আর কষ্টের দিকে চালিত করেনি? ধাপে ধাপে কালমানদের নিজ অভিজ্ঞতা স্মরণ করে লোভ, ঘৃণা আর অজ্ঞতার ‘ত্রি-অগ্নি’র প্রভাব অনুধাবন করতে বললেন তিনি। আলোচনার শেষ নাগাদ কালামানরা বুঝতে পারল, আগে হতেই বুদ্ধের ধম্মের সঙ্গে পরিচিত ওরা। ‘সেজন্যেই আমি তোমাদের কোনও শিক্ষকের ওপর নির্ভর না করতে বলেছি,’ উপসংহার টানলেন বুদ্ধ। ‘তোমরা যখন নিজেরাই কোন জিনিসগুলো ‘সহায়ক’ (কুসলা) আর কোনগুলো ‘অনুপযোগি’ (অকুসলা) বুঝতে পারেব তখন অন্যরা যাই বলুক না কেন তোমরা এই নীতিরই চর্চা করবে ও ধরে রাখবে।’[৪১]
তিনি কালামানদের এও বোঝালেন যে, লোভ, ঘৃণা ও বিভ্রম এড়ানোর পাশাপাশি বিপরীত গুণাবলীর চর্চার করাও নিঃসন্দেহে উপকারী হবে: ‘নির্লোভ, ঘৃণাহীন ও বিভ্রমহীন।’ তারা উপকার, দয়া ও উদারতার বিকাশ ঘটিয়ে জীবন সম্পর্কে যথাযথ উপলব্ধি অর্জনের প্রয়াস পেলে নিজেদের সুখী মানুষ হিসাবে আবিষ্কার করবে। যদি ভিন্ন জীবন আসে (কালামানদের উপর পুনর্জন্মের মতবাদ চাপিয়ে দেননি বুদ্ধ, এর সঙ্গে তাদের পরিচয় নাও থাকতে পারত) তাহলে এই সৎ কন্ট পরবর্তী সময় স্বর্গে দেবতা হিসাবে পুনর্জন্ম দান করবে। অন্য কোনও জগৎ না থাকলে এই সুবিবেচক ও সদয় জীবনধারা অন্যদের নিজেদের প্রতি একই ধরনের আচরণে উৎসাহিত করবে। আর কিছু না হোক, তারা অন্তত এটুকু জানবে যে, সৎ আচরণ করেছে-সেটা সবসময়ই স্বস্তির কারণ হবে। কালামানদের এই ‘দক্ষ’ মানসিকতা গড়ে তোলায় সহায়তা করতে ধ্যানের একটা কৌশল শিক্ষা দিয়েছিলেন বুদ্ধ; এটাই ছিল ‘অপরিমেয়’র সাধারণ মানুষের ভাষ্য। প্রথমে তাদের অবশ্যই মন হতে ঈর্ষা, খারাপ ইচ্ছার অনুভূতি ও বিভ্রম দূর করতে হবে। তারপর সর্বদিকে প্রেমময় দয়ার অনুভূতি প্রেরণ করবে। তখন তারা দেখতে পাবে, ‘প্রচুর মর্যাদাপূর্ণ, অপরিমেয়, প্রেমময়, প্ৰবল দয়ায় পরিপূর্ণ’ হয়ে উঠেছে তারা। তখন তারা নিজেদের সীমিত দৃষ্টিভঙ্গির বাইরে এসে সমগ্র জগতকে আলিঙ্গন করবে। অহমবাদের তুচ্ছতাকে ছাপিয়ে গিয়ে মুহূর্তের জন্যে এমন এক মোহাবেশ অনুভব করবে যা তাদের সত্তার বাইরে ‘উর্ধ্বে, নিচে, চারপাশে ও সর্বত্র’ নিয়ে যাবে। তারা দেখবে তাদের হৃদয় নিরাসক্ত প্রশান্তিতে প্রসারিত হয়ে গেছে।[৪২] সাধারণ নারী- পুরুষ নিব্বানার স্থায়িত্ব অর্জন না করতে পারে, কিন্তু চূড়ান্ত মুক্তির আভাস লাভ করতে পারবে।
সুতরাং, বুদ্ধ সন্ন্যাসী ও সাধারণ জনগণকে আগ্রাসি নতুন সমাজে বিরাজিত অহমবাদ প্রশমিত করার জন্যে একই রকম সহানুভূতিপূর্ণ আক্রমণ পরিচালনার শিক্ষা দিচ্ছিলেন। অহমবাদ মানুষকে জীবনের পবিত্র মাত্রা অর্জন হতে দূরে ঠেলে রেখেছিল। তিনি যে দক্ষ অবস্থা গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন তা পালি লিপির এই কবিতায় চমৎকার ফুটে উঠেছে: