সেরাতেই মারা গেলেন অনাথাপিন্দিকা এবং আমাদের জানানো হয়েছে, স্বর্গে একজন ‘স্রোতে প্রবেশকারী’ হিসাবে মাত্র সাতটি পুনর্জন্ম সামনে নিয়ে জন্ম গ্রহণ করেন তিনি। নিঃসন্দেহে আশীর্বাদ হিসাবে দেখা হয়েছে একে। কিন্তু তাঁর ঔদার্য ও নিবেদিত সেবার বিনিময়ে এই পুরস্কার সামান্য বলে মনে হয়। সাধারণ মানুষের কাছ থেকে এই ধরনের আবিশ্যিক শিক্ষা দূরে সরিয়ে রাখা অন্যায় বোধ হয়। কিন্তু প্রত্যেকের একই আধ্যাত্মিক স্তরে অবস্থানের ধারণাটি আবশ্যিকভাবেই আধুনিক ধারণা। প্রাক-আধুনিক ধর্ম বরাবরই দুটো স্তরে পরিচালিত হতো: অভিজাত একটি গোষ্ঠী সারাজীবন ঐশীগ্রন্থের পাঠ ও ধ্যানে কাটিয়ে দিতেন এবং অনিবার্যভাবে অধিকতর অজ্ঞ সাধারণ জনকে নির্দেশনা দিতেন। সবাই শিক্ষিত ও ধর্মগ্রন্থ পাঠের সুযোগ পাওয়ার পরেই কেবল পূর্ণ ধর্মীয় সাম্য প্রতিষ্ঠা সম্ভব হয়েছে। বিসিই প্রথম শতাব্দীর আগে বৌদ্ধ শাস্ত্র লিপিবদ্ধ করা হয়নি, কিন্তু তরপরেও পাণ্ডুলিপি ছিল বিরল। ধৰ্ম্ম শোনার জন্যে যে কাউকে খোদ বুদ্ধ কিংবা কোনও সন্ন্যাসীর কাছে যেতে হতো।
আমজনতাকে কী শিক্ষা দিয়েছিল সংঘ? একেবারে গোড়া থেকেই বুদ্ধের কাছে ‘আশ্রয় নিয়েছিল’ সাধারণ মানুষ। জনগণ সন্ন্যাসীদের খাইয়ে, সাহায্য করে উন্নত পুনর্জন্মের জন্যে প্রয়োজনীয় পূণ্য অর্জন করত। সন্ন্যাসীগণও সাধারণ মানুষকে নৈতিক জীবন যাপন করে, সৎকর্মের মাধ্যমে কৰ্ম্মকে পরিশুদ্ধ করার শিক্ষা দিতেন যাতে তারা আধ্যাত্মিক অগ্রগতি অর্জন করতে পারে। সবাই একে ন্যায়সঙ্গত বিনিময় হিসাবে দেখেছে। অনাথাপিন্দিকার মতো কোনও কোনও সাধারণ মানুষ বুদ্ধ ও ভিক্ষুদের সঙ্গে প্রচুর সময় কাটিয়েছে। তাদের পাঁচটি নৈতিক শপথ গ্রহণে উৎসাহিত করা হয়েছে– নবীশদের জন্যে ধম্ম: অবশ্যই হত্যা করবে না, চুরি করবে না, মিথ্যা বলবে না বা মাদক সেবন করবে না, অবশ্যই যৌন উচ্ছৃখলতা এড়িয়ে যাবে। মোটামুটি জৈন অনুসারীদের আচরিত অনুশীলনের মতোই ছিল এসব। প্রতি মাসের সপ্তম দিনে (উপসোথা) বৌদ্ধ জনগণের প্রাচীন বৈদিক অনাহার ও নিবৃত্ত থাকার উপবাসতা অনুশীলনের পরিবর্তে বিশেষ উপাচার ছিল; বাস্তবক্ষেত্রে যা তাদের চব্বিশ ঘন্টার জন্যে সংঘের নবীশের মতো কিছুতে পরিণত করেছিল। তারা যৌনতা হতে বিরত থাকত, আমোদ অনুষ্ঠান দেখত না, ভদ্রজনোচিত পোশাক পরত ও মধ্যাহ্ন পর্যন্ত শক্ত খাবার গ্রহণ করত না।[৩২] এটা তাদের পূর্ণাঙ্গ বৌদ্ধ জীবনের একটা স্বাদ যুগিয়েছে, কাউকে কাউকে হয়তো সন্ন্যাসী হতেও অনুপ্রাণিত করেছে।
এমনকি বৌদ্ধ সন্ন্যাসী ধ্যান শুরু করার আগেই যেকোনও যোগির মতো তাঁকে সহানুভূতি, আত্ম-নিয়ন্ত্রণ ও অভিনিবেশের নৈতিক প্রশিক্ষণ গ্রহণ করতে হতো। সাধারণ মানুষ কখনও গভীর যোগ আয়ত্ত করতে সক্ষম হয়নি, তো তারা নৈতিকতার (শীলা) ওপর জোর দিয়েছে। বুদ্ধ একে তাদের জীবনের উপযোগি করে দিয়েছিলেন। এভাবে সাধারণ নারী-পুরুষ এক পূর্ণাঙ্গ আধ্যাত্মিকতার ভিত্তি নির্মাণ করছিল যা পরজন্মে তাদের শক্ত অবস্থান গড়ে দেবে। সন্ন্যাসীরা ধ্যানের মাধ্যমে ‘দক্ষ’ কৌশল শিক্ষা করতেন, আর আমজনত্তা ‘দক্ষ’ নৈতিকতার প্রতি জোর দিয়েছে।[৩৩] ভিক্ষুকে দান করা, সবসময় সত্যি কথা বলা ও অন্যদের সঙ্গে দায়ালু ও ন্যায়সঙ্গত আচরণ তাদের অধিকতর সজীব স্বাস্থ্যবান মানসিক অবস্থা সৃষ্টি ও অহমবাদের আগুন সম্পূর্ণ নিভানো সম্ভব না হলেও কিছুটা প্রশমিত করতে সাহায্য করেছে। এই নৈতিকতার প্রায়োগিক সুবিধা ছিল: এটা অন্যদের তাদের প্রতি একইরকম আচরণে উৎসাহিত করতে পারে। ফল স্বরূপ, পরবর্তী জীবনে পূণ্য অর্জন ছাড়াও বর্তমান জীবনে আরও সুখী হওয়ার উপায় শিক্ষা নিচ্ছিল তারা।
বৈদিক ব্যবস্থায় যাদের কোনও স্থান ছিল না, অনাথাপিন্দিকার মতো ব্যবসায়ী ও মহাজনদের কাছে ধম্ম খুবই আবেদনময় ছিল। চতুর বিনিয়োগ নীতিমালা ভিত্তিক হওয়ায় ব্যবসায়ীরা বুদ্ধের ‘দক্ষ’ নীতিমালা উপলব্ধি করতে পেরেছিল। এটা বর্তমান ও ভবিষ্যৎ অস্তিত্বে সুনাম বয়ে আনবে। সন্ন্যাসীগণ ক্ষণস্থায়ী মানসিক অবস্থার প্রতি মনোযোগি থাকার প্রশিক্ষণ পেয়েছেন: সাধারণ অনুসারীদের আর্থিক ও সামাজিক লেনদেনে আপ্পানদা (মনোযোগ)- এর নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।[৩৪] বুদ্ধ তাদের জরুরি অবস্থার জন্যে সঞ্চয়, নির্ভরশীলদের দেখাশোনা, ভিক্ষুদের সাহায্য করা, ঋণ এড়ানো, পরিবারের জরুরি প্রয়োজন মেটানোর মতো অর্থ সঞ্চয় নিশ্চিত করা ও সতর্কতার সাথে অর্থ বিনিয়োগের জন্যে বলেছেন।[৩৫] মিতব্যয়ী, বিবেচক ও ধীর-স্থির হতে হবে তাদের। সাধারণ মানুষের জন্যে সবচেয়ে উন্নত হিতোপদেশ সিগালা বেদ সুত্তায় সিগালাকে মদ পান, রাত্রি জাগরণ, জুয়া, আলস্য ও অসৎ সঙ্গ এড়ানোর নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।[৩৬] অগ্নি-হিতোপদেশের একটি সাধারণ ভাষ্যে অনুসারীদের তিনটি ‘শুভ-অগ্নি’র পরিচর্যার তাগিদ দেওয়া হয়েছে। নির্ভরশীলদের যত্ন, স্ত্রী, সন্তান ও ভৃত্যদের দেখাশোনা এবং সংঘের সকল ভিক্ষুকে সহায়তা করতে হবে।[৩৭]
কিন্তু বরাবরের মতো সহনশীলতাই ছিল মুখ্য গুণ। একদিন রাজা পাসেনেদি ও তাঁর স্ত্রী আলোচনাক্রমে সিদ্ধান্তে পৌঁছালেন যে, আপন সত্তা ছাড়া তাদের কাছে প্রিয়তম আর কিছু নয়। এই দৃষ্টিভঙ্গি বুদ্ধের সমর্থন না পাবারই কথা। কিন্তু রাজা এই আলাপের কথা জানালে বুদ্ধ তাঁকে ভর্ৎসনা করেননি, অনাত্মার আলোচনায় লিপ্ত হননি বা অষ্টশীল পথের উপর হিতোপদেশ শুরু করেননি। তার বদলে যথারীতি পাসেনেদির দৃষ্টিভঙ্গিতে প্রবেশ করলেন তিনি এবং তাঁর মনের বিষয়বস্তুর ভিত্তিতেই আলোচনা শুরু করলেন-যেখানে কী থাকা উচিৎ ভেবেছেন তার ভিত্তিতে নয়। সুতরাং, রাজাকে তিনি বলেননি যে, সত্তা একটা বিভ্রম, কারণ নিয়মিত যোগের জীবন ছাড়া তিনি এটা ‘বুঝতে’ পারতেন না। বরং রাজাকে এই বিষয়টি ভাবতে বললেন তিনিঃ তিনি যদি বুঝে থাকেন যে তাঁর কাছে নিজের চেয়ে প্রিয় আর কিছু নেই, তাহলে এটাও নিশ্চয়ই সত্যি যে অপরাপর মানুষও তাদের ‘ভিন্ন সত্তা’ লালন করে। সুতরাং উপসংহার টানলেন বুদ্ধ, ‘যে ব্যক্তি সত্তাকে ভালোবাসে, তার অন্যের সত্তাকে আঘাত দেওয়া উচিৎ নয়।’[৩৮] রেওয়াজ অনুযায়ী যাকে ‘স্বর্ণ বিধি’ বলা হয়, সেটা অনুসরণ করা উচিৎ তাঁর: ‘তুমি নিজের জন্যে যা সঠিক মনে করো না, অন্যের বেলায় তা করো না।[৩৯] সাধারণ মানুষ অহমবাদ পুরোপুরি নির্বাপিত করতে পারে না, কিন্তু অন্য মানুষের দুর্বলতায় সমব্যথী হতে স্বার্থহীনতার অনুভূতি কাজে লাগাতে পারে। এটা অহমের বাড়াবাড়ির ঊর্ধ্বে নিয়ে যাবে তাদের, অহিংসার সঙ্গে পরিচয় ঘটিয়ে দেবে।