বৌদ্ধদের আরামার বন্ধুসুলভ ও আনন্দময় জীবন দেখে খুবই মুগ্ধ হয়েছিলেন কোসালার রাজা পাসেনেদি। রাজ দরবারের সম্পূর্ণ উল্টো, বুদ্ধকে বলেছিলেন তিনি, যেখানে স্বার্থপরতা, লোভ ও আগ্রাসনই দস্তুর। এক রাজা অন্য রাজার সঙ্গে ঝগড়া করেন, ব্রাহ্মণরা ব্রাহ্মণদের সঙ্গে। পরিবার ও বন্ধুবান্ধব সারাক্ষণ ঝগড়া বিবাদে লিপ্ত। কিন্তু আরামায় তিনি ভিক্ষুদের দুধ আর পানির মতো বিবাদহীন জীবন কাটাতে দেখেছেন, দয়ার্দ্র দৃষ্টিতে পরস্পরকে দেখেছেন তাঁরা।’ অন্যান্য ক্ষেত্রে সাধকদের শীর্ণ ও দুর্দশাগ্রস্থ অবস্থায় দেখে মনে হয়েছে, জীবনধারা তাদের সঙ্গে খাপ খায়নি। ‘কিন্তু আমি দেখছি ভিক্ষুরা হাসছেন, ভদ্র, আন্তরিকভাবেই সুখী…স্বজনরা, শান্ত, অবিচলিত, ভিক্ষা করে জীবিকা নির্বাহ করছেন, তাদের মন বুনো হরিণের মতোই কোমল রয়ে গেছে।’ মন্ত্রণা সভায় বসলে, কৃশ কণ্ঠে বলেছেন রাজা, বারবার বাধা দেওয়া হয় তাঁকে, এমনকি উত্যক্ত করা হয়; কিন্তু বুদ্ধ সন্ন্যাসীদের বিশাল জমায়েতের উদ্দেশে বক্তব্য রাখার সময় কেউ এমনকি কাশি বা গলা খাকারিও দেয় না।[২৭] জীবনের এক বিকল্প ধারা নির্মাণ করছিলেন বুদ্ধ যা নতুন শহর ও রাজ্যের ঘাটতিসমূহকে স্পষ্ট করে তুলেছিল।
কোনও কোনও পণ্ডিত বিশ্বাস করেন, পাসেনেদি ও বিম্বিসারার মতো শাসকদের রাজনৈতিক ও সামাজিক সংস্কার কর্মসূচির সহযোগি হিসাবে দেখেছেন বুদ্ধ। তাঁরা মত প্রকাশ করেছেন, সমাজ এক গোত্রীয়, গোষ্ঠী ভিত্তিক রীতিনীতি হতে প্রতিযোগিতামূলক, গলাকাটা রাজার অর্থনীতির দিকে অগ্রসর হওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে অনিবার্য ক্রমবর্ধমান ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্যবাদকে মোকাবিলা করার জন্যেই সংঘের নকশা করা হয়েছিল। এক ভিন্ন ধরনের সামাজিক সংগঠনের নীলনকশায় পরিণত হবে সংঘ এবং এর ধারণাসমূহ ক্রমে জনগণের কাছে পৌঁছে যাবে। টেক্সটে বুদ্ধ ও চক্কবত্তীর ঘনঘন পাশাপাশি উপস্থাপনের দিকে ইঙ্গিত করেছেন তাঁরা: বুদ্ধ মানবীয় চেতনাকে সংস্কার করবেন, অন্য দিকে রাজাগণ সামাজিক সংস্কারের সূচনা ঘটাবেন।[২৮] অতি সাম্প্রতিকালে অন্যান্য পণ্ডিত অবশ্য যুক্তি দিয়েছেন যে, রাজতন্ত্রের পৃষ্ঠপোষকতা দূরে থাক, তিনি বরং এভাবে কাজ করার বেলায় যারপরনাই সমালোচনামুখর ছিলেন; নিজ রাজ্য শাক্যে চলমান প্রজাতন্ত্র ধরনের সরকারই পছন্দ করতেন।[২৯]
বুদ্ধের এমন রাজনৈতিক লক্ষ্য ছিল বলে মনে হয় নাঃ যে কোনও সামাজিক কর্মসূচির সঙ্গে জড়িত থাকাকে নির্ঘাৎ জাগতিক বিশ্বকে ‘আঁকড়ে’ থাকার মতো অনুপযোগি মনে করতেন তিনি। তবে বুদ্ধ অবশ্যই মানুষ হবার একটা নতুন উপায় উদ্ভাবনের প্রয়াস পাচ্ছিলেন। ভিক্ষুদের স্পষ্ট সন্তুষ্টি দেখায়, তাঁর পরীক্ষা-নিরীক্ষা ফলপ্রসু হয়েছিল। সন্ন্যাসীগণ অতিপ্রাকৃত করুণায় পরিপূর্ণ হননি বা কোনও দেবতার অনুগ্রহে সংস্কৃত হননি, বুদ্ধের আবিষ্কৃত পদ্ধতি সম্পূর্ণ মানবীয় উদ্যোগ ছিল। তাঁর সন্ন্যাসীগণ দক্ষতার সঙ্গে স্বাভাবিক ক্ষমতা কাজে লাগাতে শিখছিলেন যেমন করে কোনও কামার এক টুকরো ধাতুকে চকচকে ও সুন্দর করে তুলবে এবং স্বয়ংসম্পূর্ণ ও পূর্ণ সম্ভাবনায় বিকশিত হতে সাহায্য করবে। মনে হয় মানুষকে নিঃস্বার্থভাবে বাঁচতে ও সুখী হওয়ার শিক্ষা দেওয়া সম্ভব ছিল। ভিক্ষুরা বিষণ্ন বা হতাশ হয়ে থাকলে বোঝাত যে, তাঁদের জীবনধারা মানবীয় সত্তার প্রতি নিপীড়ন চালাচ্ছে। কোনও দেবতা কর্তৃক ‘পাপপূর্ণ’ হিসাবে নিষিদ্ধ করায় নয় বরং এই ধরনের আবেগে আপ্লুত হওয়া মানবীয় প্রকৃতির জন্যে ক্ষতিকর বলে ‘ক্রোধ, অপরাধ, দয়াহীনতা, ঈর্ষা ও লোভের মতো ‘অদক্ষ’ অবস্থা এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে। সহানুভূতি, সৌজন্য, বিবেচনাবোধ, বন্ধুতা ও দয়া মঠচারী জীবনের প্রয়োজনীয় উপাদানগুলো নতুন কৃচ্ছ্রতাবাদ নির্মাণ করেছিল। কিন্তু প্রাচীন, চরম তাপসের বিপরীতে ভারসাম্য ও সামঞ্জস্য সৃষ্টি করেছে এটা। নিষ্ঠার সঙ্গে বিকাশ সাধিত হলে এটা নিব্বানার সেতো-বিমুত্তি আনতে পারে, আরেক উল্লেখযোগ্য স্বাভাবিক মনস্তাত্ত্বিক অবস্থা।
কিন্তু কেবল সন্ন্যাসীদের পক্ষেই পূর্ণাঙ্গ ধৰ্ম্ম সম্ভাবপর ছিল। সাধারণ ভারতীয় সংসার জীবনের কোলাহল আর ব্যস্ততা ধ্যান ও যোগসাধনা অসম্ভব করে তুলবে, তো জগত্ত্যাগী কোনও সন্ন্যাসীর পক্ষেই নিব্বানা লাভ সম্ভব। অকাঙ্ক্ষায় পরিচালিত বাণিজ্যিক ও প্রজনন কর্মকাণ্ডে জড়িত অনাথাপিন্দিকার মতো সাধারণ জন লোভ, ঘৃণা ও বিভ্রমের ত্রি-অগ্নি নির্বাপনের আশা করতে পারে না। একজন সাধারণ মানুষ কেবল পরবর্তী জন্মে আলোকনের পক্ষে অনুকূল পরিবেশে পুনর্জন্ম লাভের আশা করতে পারে। মহান সত্যিগুলো আমজনতার জন্যে নয়: ‘এগুলো’ উপলব্ধি করতে হবে আর এই ‘প্রত্যক্ষ জ্ঞান’ বৌদ্ধদের পূর্ণাঙ্গ রীতিনীতি পালনে আবশ্যক যোগ সাধনা ছাড়া অর্জন করা সম্ভব নয়।[৩০] অভিনিবেশের অনুশীলন ছাড়া অনাত্মার মতো মতবাদ কোনও অর্থ বয়ে আনবে না। কিন্তু বুদ্ধ সাধারণ জনকে অগ্রাহ্য করেননি। মনে হয়, দীক্ষা দানের দুটো প্রধান ধারা ছিল: একটা সন্ন্যাসীর জন্যে, অপরটি সাধারণের।
অনাথাপিন্দিকার করুণ মৃত্যুবরণের কাহিনীতে এটা স্পষ্ট হয়ে ওঠে তিনি মুমূর্ষু হয়ে ওঠার পর সারিপুত্ত ও আনন্দ দেখতে গেলেন তাঁকে। তাঁকে বিদায়ের ওপর ছোট একটা কাহিনী শোনালেন সারিপুত্তঃ অনাথাপিন্দিকাকে ইন্দ্রিয়কে আঁকড়ে না থাকার শিক্ষা নিতে হবে। কারণ বাহ্যিক জগতের সঙ্গে এই সম্পর্ক তাঁকে সামসারার ফাঁদে বন্দি করবে। কেউ একে মৌল বৌদ্ধ শিক্ষা ভাবতে পারেন। কিন্তু অনাথাপিন্দিকা কখনও আগে এমনটি শোনেননি। শুনতে শুনতে গাল বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়তে লাগল তাঁর। ‘ব্যাপার কী, গৃহী? ‘ উদ্বেগের সঙ্গে জানতে চাইলেন আনন্দ। ‘খুব খারাপ লাগছে?’ না, প্রতিবাদ করলেন অনাথাপিন্দিকা, এটা কোনও সমস্যা নয়। ‘গুরু আর ধ্যানী ভিক্ষুদের এত বছর ধরে পরিচর্যা পরিচর্যা করেছি, অথচ আগে কখনও ধম্ম সম্পর্কে এমন কথা শুনিনি।’ এটাই শোকাক্রান্ত করেছে তাঁকে। সাধারণ জনকে এই শিক্ষা দেওয়া হয়নি, ব্যাখ্যা করলেন আনন্দ। কেবল গৃহত্যাগীদের জন্যেই এই শিক্ষা। এটা ঠিক হয়নি, জবাব দিলেন অনাথাপিন্দিকা। গৃহস্থদেরও এইসব বিষয় নির্দেশনা দেওয়া উচিত: এমনও লোকজন রযেছে যাদের মাঝে সামান্য আকাঙ্ক্ষাই অবশিষ্ট আছে। তারা আলোকন লাভের উপযোগি। সুতরাং নিব্বানা লাভ করতে পারবে তারা।[৩১]