কিন্তু ‘গৃহহীনতা’কে আলিঙ্গনকারী মানুষের পক্ষে খুবই জাঁকাল আয়োজন ছিল এসব। খুবই কম সময় পরিসরে রাজাগহ কাপিলাবাস্তু ও সাবস্তিতে পদ্মপুকুর, অসংখ্য আম গাছ আর ছায়াময় নারকেল সারিতে ঘেরা তিনটি বিরাট উদ্যানের মালিক হয়েছেন বুদ্ধ যেখানে সন্ন্যাসীরা বসবাস ও ধ্যান করতে পারবেন। অন্য দাতাগণ দ্রুত অনাথাপিন্দিকার নজীর অনুসরণ করলেন। বুদ্ধ সাবস্তিতে ধম্ম প্রচার করছেন জেনে যমুনা তীরের কোসাম্বির তিন মহাজন তাঁর বয়ান শুনতে জিতের উদ্যানে হাজির হলেন এবং তাঁকে স্ব স্ব শহরে আমন্ত্রণ জানালেন। প্রত্যেকে যার যার শহরে একটি করে ‘প্রমোদ উদ্যান’ (আরামা) নির্মাণ করলেন। কেবল নিজেদের পয়সা খরচ করে দালান কোঠাই নির্মাণ করলেন না তাঁরা, বরং অন্যান্য দাতার মতো নিজেরাই খরচ যুগিয়ে আরামার সংরক্ষণও করেছেন তাঁরা। বাঁশ বাগান পরিচর্যায় রাজা বিম্বিসারা এত লোক নিয়োজিত করেছিলেন যে গোটা গ্রাম পূর্ণ করে ফেলেছিল তারা। কিন্তু সন্ন্যাসীরা বিলাসিতায় বাস করেননি। প্রচুর হলেও আয়োজন ছিল সাধারণ। কুঁড়েগুলোয় মধ্যপন্থীদের উপযোগি আসবাবের অতিরিক্ত তেমন কিছু ছিল না। প্রত্যেক ভিক্ষুর ভিন্ন সেল ছিল, কিন্তু প্রায়শঃই সেটা ছিল পার্টিশন দিয়ে আলাদা করা একটা জায়গা, ঘুমানোর জন্যে স্রেফ একটা পাটাতন আর বসার জন্যে জোড়া দেওয়া পায়াঅলা একটা আসন থাকত সেখানে।[২২]
ভিক্ষুগণ সারা বছর এইসব আরামায় থাকতেন না, বরং বেশিরভাগ সময় পথেই কাটাতেন তাঁরা। গোড়ার দিকে অধিকাংশই বর্ষাকালেও চলার উপর থাকতেন, কিন্তু পরে এটা আঘাতকারী হিসাবে আবিষ্কার করেন। জৈনদের মতো অন্য গোত্রগুলো বৃষ্টির সময় পথ চলতে অস্বীকার করেছে, কারণ তাতে বুনোজীবনের ক্ষতি হবে এবং অহিংসার নীতি লঙ্ঘিত হবে। লোকে প্রশ্ন করতে শুরু করেছিল, শাক্যমুনির শিষ্যরা কেন বর্ষাকালে ভ্রমণ অব্যাহত রেখেছে? ‘কাচি ঘাস মাড়াচ্ছে, গাছপালা নষ্ট করছে, অসংখ্য ক্ষুদে প্রাণীকে কষ্ট দিচ্ছে?’ এমনকি শকুনের ঝাঁকও তো, যুক্তি দেখিয়েছে তারা, বর্ষার সময় গাছে বসে থাকে। কেন কেবল বুদ্ধের সন্ন্যাসীরা কারও কথা কানে না তুলে নিজেদের কর্দমাক্ত পথঘাটে ঘুরে বেড়াতে বাধ্য মনে করেন?[২৩]
এই জাতীয় সমালোচনায় স্পর্শকাতর ছিলেন বুদ্ধ। এইসব অভিযোগ শুনতে পেয়ে মৌসুমি বিশ্রামকে (বাস্যা) সংঘ সদস্যদের জন্যে বাধ্যতামূলক করে দিলেন তিনি। কিন্তু অন্য ভবঘুরেদের চেয়ে আরেক কদম অগ্রসর হয়ে তিনি মঠচারী গোষ্ঠীবদ্ধ জীবন শুরু করলেন। অন্যান্য গোত্রের সন্ন্যাসীগণ বাস্যার সময়ে একাকী বাস করতেন বা যেখানে থাকতেন সেখানেই সম্পূর্ণ ভিন্ন ধৰ্ম্ম অনুসারী সন্তদের সঙ্গে বনের কোনও ফাঁকা জায়গায় সময় কাটাতেন। অন্যান্য গোত্রের সদস্যদের সঙ্গে নয়, বাস্যার সময় সন্ন্যাসীদের একসঙ্গে থাকবার নির্দেশ দিলেন বুদ্ধ। তারা যেকোনও আরামা বা প্রতি বছর শূন্য হতে গড়ে তোলা কোনও পল্লী বসতি (আবাসা) বেছে নিতে পারতেন। প্রতিটি আরামা ও আবাসার নির্ধারিত সীমানা ছিল। জোরাল কোনও কারণ ছাড়া বর্ষার তিনমাস কোনও সন্ন্যাসীর সপ্তাহকালের বেশি সময়ের জন্যে বিশ্রাম ত্যাগ করার অনুমতি ছিল না। ক্রমে সন্ন্যাসীগণ একটা গোষ্ঠীবদ্ধ জীবন গড়ে তুলতে লাগলেন। সহজ সাধারণ অনুষ্ঠান সৃষ্টি করলেন তাঁরা। তাঁদের বসতির মিলন কক্ষে এসবের আয়োজন করা হতো। সকালে ধ্যান করতেন তাঁরা, কিংবা অন্য কোনও প্রধান সন্ন্যাসীর নির্দেশনা শুনতেন। তারপর দিনের রসদ সংগ্রহের উদ্দেশ্যে যার যার পাত্র নিয়ে শহরের উদ্দেশে বেরিয়ে পড়তেন। দিনের মূল খাবার গ্রহণ করতেন। বিকেলে চলত বিশ্রাম, সন্ধ্যায় আয়োজন করা হতো আরও ধ্যানের।
কিন্তু সবার ওপরে ভিক্ষুগণ আন্তরিকতার সঙ্গে বাস করতে শিখেছিলেন। ব্যক্তিগতভাবে হয়তো পছন্দ হবে না এমন মানুষের সঙ্গে সহবাস করার অনিবার্য সমস্যাগুলো ধ্যানের মাধ্যমে যে প্রশান্তি অর্জন করার কথা তাকে পরীক্ষার সম্মুখীন করত। ভিক্ষুরা পরস্পরের প্রতি সমব্যাথী না হতে পারলে পৃথিবীর চারদিকে সহানুভূতি প্রেরণ শুভকর হতো না। বুদ্ধ সন্ন্যাসীদের শাস্তি দিয়েছেন, এমন ঘটনাও আছে। একবার পেটের পীড়ায় আক্রান্ত ভিক্ষুর যত্ন নিতে ব্যর্থ হওয়ায় তাঁদের ভর্ৎসনা করছেন তিনি।[২৪] আরেকবার বুদ্ধ ও তাঁর সফরসঙ্গীরা সাবস্তি ভ্রমণ করার সময় সন্ন্যাসীদের ক্ষুদে একটা দল আগেভাগে স্থানীয় এক বসতিতে গিয়ে সবগুলো বিছানা দখল করে নিয়েছিলেন। প্রবল কাশিতে ভুগছিলেন সারিপুত্ত, সারারাত গাছের নিচে কাটাতে হয়েছিল তাঁকে। এমন নিষ্ঠুরতা, অপরাধী সন্ন্যাসীদের বলেছেন বুদ্ধ, সংঘের সামগ্রিক উদ্দেশ্যকে খাট করেছে। কেননা এতে মানুষ ধম্ম হতে দূরে সরে যাবে।[২৫] কিন্তু আস্তে আস্তে সেরা ভিক্ষুরা তাঁদের নিজস্ব স্বার্থপর প্রবণতা বিসর্জন দিয়ে সতীর্থদের কথা বিবেচনা করতে শিখেছেন। ভিক্ষা নিয়ে শহর থেকে প্রথম প্রত্যাবর্তনকারী অন্যদের জন্যে কুটির গোছাতেন, আসন সাজাতেন ও রান্নার পানি যোগাড় করে রাখতেন। সবার শেষে যিনি বাড়ি ফিরতেন তিনি উচ্ছিষ্ট খেয়ে এঁটো থালাবাসন গুছিয়ে রাখতেন। ‘দেহের দিক দিয়ে আমরা একেবারে আলাদা, প্রভু,’ সম্প্রদায় সম্পর্কে বুদ্ধকে বলেছিলেন একজন সন্ন্যাসী। ‘কিন্তু মনে হয় আমাদের মন একটাই।’ কেন আপন পছন্দ-অপছন্দ উপেক্ষা করে অন্যদের ইচ্ছানুযায়ী চলবেন না তিনি? এমন সঙ্গীদের সঙ্গে পবিত্র জীবন কাটাতে পেরে নিজেকে সৌভাগ্যবান মনে করেছেন এই ভিক্ষু।[২৬] বাস্যার গোষ্ঠীবদ্ধ জীবনে সন্ন্যাসীদের অপরের জন্যে বাঁচতে শেখানোর নতুন উপায় আবিষ্কার করেছিলেন বুদ্ধ।