কিন্তু বুদ্ধ এবং তাঁর শিষ্যদের নৈর্ব্যক্তিক ভাবে এর মানে এই নয় যে তাঁরা শীতল, অনুভূতিহীন ছিলেন। তাঁরা কেবল সহানুভূতি সম্পন্ন ও সজ্জনই ছিলেন না, গভীরভাবে সামাজিকও ছিলেন। তাঁদের ‘বহুজনের’ কাছে পৌঁছানোর প্রয়াস মানুষকে আকৃষ্ট করেছে, অহমবাদের অভাব অপ্রতিরোধ্য মনে হয়েছে তাদের।
সকল সন্ন্যাসীর মতো অবিরাম চলার উপর থাকতেন বুদ্ধ। যতদূর সম্ভব বৃহৎ দর্শকের উদ্দেশে বক্তব্য রাখতেন, কিন্তু বর্ষা মৌসুমের তিন মাসে চলাচল কঠিন হয়ে গেলে রাজাগহের বাইরে বাঁশ বাগানেই অবস্থান করতেন। উদ্যানটি এখন সংঘের মালিকানাধীন হলেও ভিক্ষুরা সেখানে কোনও কিছু নির্মাণ না করে খোলা মাঠেই অবস্থান করতেন। যাহোক এক ধনী বর্ণিক বাঁশ বন বেড়াতে এসে জায়গাটা পছন্দ করে ফেললেন, সন্ন্যাসীদের জন্যে ষাটটি কুটির নির্মাণ করে দেওয়ার প্রস্তাব দিলেন তিনি। অনুমতি দিলেন বুদ্ধ। এরপর বুদ্ধ এবং সন্ন্যাসীদের খাবারে আমন্ত্রণ জানালেন বণিক। এমন বিশাল জমায়েতকে খাওয়ানো সামান্য ব্যাপার ছিল না। খাবারের দিন সকালে কাজের লোকেরা জাউ, ভাত, ঝোল ও মিষ্টি বানানোর সময় গোটা বাড়ি শোরগোলে ভরে উঠেছিল। বণিক মহাশয় নানা কাজ ও ফরমাশ দিতে এতই ব্যস্ত ছিলেন যে ব্যবসায়িক কাজে সাবস্তি থেকে রাজাগহে আগত শ্যালক অনাথাপিন্দিকাকে স্বাগত জানানোরও ফুরসত পাননি। ‘হচ্ছেটা কী?’ সবিস্ময়ে জানতে চাইলেন অনাথাপিন্দিকা। সাধারণত এ বাড়িতে বেড়াতে এলে ভগ্নিপতি তার সমাদর করে কুলিয়ে উঠতে পারেন না। বিয়ে জাতীয় কিছু হচ্ছে? নাকি রাজা বিম্বিসারাকে আপ্যায়ন করা হচ্ছে? ‘মোটেই তা নয়,’ জবাব দিলেন বণিক I বুদ্ধ ও তাঁর সন্ন্যাসীরা খেতে আসছেন।
নিজের কানকে বিশ্বাস করে উঠতে পারলেন না অনাথাপিন্দিকা। ‘কী বললে, বুদ্ধ?’ অবিশ্বাসের সুরে জানতে চাইলেন তিনি। সত্যি কি একজন আলোকপ্রাপ্ত বুদ্ধ আবির্ভূত হয়েছেন এই জগতে? তিনি কী এখনই তাঁর সাথে দেখা করতে যেতে পারেন? ‘এখন তার উপযুক্ত সময় নয়,’ তীর্যক কণ্ঠে জবাব দিয়ে ফের কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন বণিক। ‘কাল ভোরে তাঁর সাথে কথা বলতে পারবে।’ অনাথাপিন্দিকা এমনই উত্তেজিত ছিলেন, বলতে গেলে রাতে ঘুমাতে পরলেন না তিনি। খুব ভোরে বাঁশ বাগানের পথ ধরলেন তিনি। কিন্তু নগর থেকে বের হয়ে আসার পরপরই অ্যাক্সিয়াল যুগের সাধারণ ভীতিতে প্রবলভাবে আক্রান্ত হলেন। নিজেকে নাজুক মনে হলো তাঁর। ‘জগৎ থেকে আলো হারিয়ে গেল, সামনে কেবল অন্ধকার দেখতে পাচ্ছিলেন তিনি।’ ভোরের আলোয় বুদ্ধকে পায়চারিরত অবস্থায় না দেখা অবধি ভয়ে ভয়ে আগে বাড়লেন তিনি। অনাথাপিন্দিকাকে দেখে তাঁকে বসতে দিলেন বুদ্ধ, নাম ধরে ডাকলেন। অতীতের ইয়াসার মতোই নিমেষে প্রফুল্ল হয়ে উঠলেন বণিক; বুদ্ধে কথা শোনার সাথে সাথে এমন প্রবলভাবে তাঁর শিক্ষা জেগে উঠতে শুরু করল যেন তাঁর আত্মার গভীরে তা খোদাই হয়েছিল। ‘অসাধারণ, প্রভু!’ চিৎকার করে বলে উঠলেন তিনি। বুদ্ধের কাছে তাঁকে একজন শিষ্য করে নেওয়ার আবেদন জানালেন। পরদিন ভগ্নিপতির বাড়িতে বুদ্ধকে আপায়ন করলেন তিনি। নিজ শহর কোসালার রাজধানী সাবস্তি সফরের আমন্ত্রণ জানালেন তাঁকে।[১৯]
ষষ্ঠ শতাব্দীর শেষ পাদে সাবস্তি সম্ভবত গাঙ্গেয় উপত্যকার সবচেয়ে অগ্রসর শহর ছিল। রিবতি নদীর দক্ষিণ পাড়ে দুটো বাণিজ্য পথের মিলনস্থলে গড়ে উঠেছিল শহরটি। প্রায় ৭০,০০০ পরিবারের আবাস ছিল এখানে। নেতৃস্থানীয় বাণিজ্য কেন্দ্র হিসাবে অনাথাপিন্দিকার মতো বহু ধনী ব্যবসায়ী এখানে বাস করত। কথিত আছে, শহরের নাম ‘সর্বমাস্তি’ হতে নেওয়া, কেননা এটা এমন এক জায়গা ছিল যেখানে ‘সবকিছুই পাওয়া সম্ভব’। চল্লিশ থেকে পঞ্চাশ ফুট উঁচু দর্শনীয় টাওয়ারে সুরক্ষিত সাবস্তির প্রধান সড়কগুলো দক্ষিণ দিক থেকে শহরে এসে শহর কেন্দ্রের একটা খোলা চত্বরে মিলিত হয়েছে।[২০] কিন্তু সাবস্তির সমৃদ্ধি সত্ত্বেও একজন সত্যিকার বুদ্ধের সঙ্গে সাক্ষাতের সম্ভাবনায় অনাথাপিন্দিকার উত্তেজনা বহু মানুষের জীবনের এক অস্বস্তিকর শূন্যতার অনুভূতি তুলে ধরে। সংঘের জন্যে জুৎসই জায়গা।
বুদ্ধের জন্যে একটা ঘাঁটি নির্মাণে কোনও রকম ব্যয়ে কণ্ঠিত হলেন না অনাথাপিন্দিকা। জুৎসই একটা জায়গার খোঁজে কঠোর পরিশ্রম করেছেন তিনি। অবশেষে কোসালার সম্ভাব্য উত্তরাধিকারী রাজকুমার জিতের একটা উদ্যান বেছে নিলেন। অনাথাপিন্দিকা ঠেলাগাড়ি ভর্তি করে সোনার মোহর আনার আগে পর্যন্ত বিক্রিতে অনীহ ছিলেন রাজপুত্র। মোহরগুলো সারা বাগানে ছড়িয়ে দিলেন তিনি, গোটা জমিন ঢাকা পড়ে গেল তাতে। এত টাকা দিতে রাজি ছিলেন তিনি। কেবল প্রবেশ পথের কাছে সামান্য একটু জায়গা বাকি ছিল। দেরিতে হলেও রাজকুমার জিত বুঝতে পারলেন, কোনও মামুলি লেনদেন নয় এটা। চাঁদা দেওয়াটা সুবিধাজনক হতে পারে। ফলে সেই জায়গাটুকু বিনামূল্যে ছেড়ে দিলেন। সেখানে একটা গেইট-হাউস নির্মাণ করে দিলেন। তারপর জিতের উদ্যানকে সংঘের জন্যে তৈরি করে দিলেন অনাথাপিন্দিকা। তিনি ‘উন্মুক্ত কুটির নির্মাণ করালেন, তোরণ বানালেন, নির্মাণ করালেন দর্শক মহল, অগ্নিকক্ষ, গুদাম ও স্নানাগার তৈরি করালেন, পুকুর কাটালেন, তাঁবু খাটালেন।’[২১] সংঘের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্রে পরিণত হবে এটা।