কিন্তু যথারীতি ইদ্ধি স্থায়ী ফল বয়ে আনতে পারেনি। পরদিন কাপিলাবাস্তুতে ছেলেকে খাবার মাংতে দেখে দারুণ পিড়ীত বোধ করলেন শুদ্ধোদন: পরিবারের মর্যাদার এমন অসম্মান করার সাহস তিনি পেলেন কোথায়? কিন্তু বাবার কাছে ধৰ্ম্ম ব্যাখ্যা করলেন বুদ্ধ। কোমল হলো শুদ্ধোদনের হৃদয়। নিমেষে ‘স্রোতে প্রবেশকারী’ তে পরিণত হলেন তিনি, যদিও সংঘে যোগদানের আবেদন জানাননি। বুদ্ধের কাছ থেকে পাত্র নিয়ে ঘরে নিয়ে এলেন তাঁকে। এখানে তাঁর সম্মানে প্রস্তুত খাবার গ্রহণের সময় একটা উল্লেখযোগ্য ব্যতিক্রম বাদে বাড়ির সব মহিলা তাঁর সাধারণ শিষ্যে পরিণত হয়। বুদ্ধের সাবেক স্ত্রী দূরে সরে রইলেন, সম্ভবত বোধগম্যভাবেই কোনওরকম কথাবার্তা ছাড়াই তাঁকে ত্যাগ করে যাওয়া মানুষটির প্রতি তখনও বৈরী ভাবাপন্ন ছিলেন তিনি।
পালি টেক্সটসমূহ ধারণ করেছে যে, কাপিলাবাস্তু সফরের পর অনির্ধারিত সময় অতিক্রান্ত হওয়ার পর শাক্যের নেতৃস্থানীয় যুবকেরা গৃহ ত্যাগ করে সংঘে যোগ দেন। বুদ্ধের সাত বছর বয়সী ছেলে রাহুলাও ছিলেন সেই দলে। দীক্ষা নেওয়ার আগে বিশ বছর বয় পূর্ণ হওয়া অপেক্ষা করতে হয়েছিল তাঁকে। বুদ্ধের তিন নিকটাত্মীয়ও ছিলেন: তাঁর চাচাত ভাই আনন্দ; সৎভাই নন্দ ও শ্যালক দেবদত্ত। নাপিত উপলও সঙ্গী হয়েছিল তাঁদের। নতুন ভিক্ষুদের মাথা মোড়াতে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল তাকে, কিন্তু সেও যোগদানের আবেদন জানায়। সঙ্গীরা আগে নাপিতকে দীক্ষা দিতে বলেছেন যাতে তাদের শাক্য অহংকার চূর্ণ হয়।[১৮] এই শাক্যদের কেউ কেউ সংগঠনের উল্লেখযোগ্য চরিত্রে পরিণত হয়েছেন। উপল হয়ে ওঠে মঠ-জীবনের নিয়ম-কানুনের ক্ষেত্রে নেতৃস্থানীয় বিশেষজ্ঞ। সজ্জন, বিবেকবান আনন্দ পরিণত হন বুদ্ধের জীবনের শেষ বিশ বছরের ব্যক্তিগত পরিচারক। আনন্দ অন্য যেকারও থেকে বুদ্ধের অনেক ঘনিষ্ঠ ছিলেন; প্রায় সর্বক্ষণিক সাহচর্যে থাকার সুবাদে বুদ্ধের হিতোপদেশ ও বাণীর ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি ওয়াকিবহাল হয়ে উঠেছিলেন। কিন্তু দক্ষ যোগি ছিলেন না তিনি। ধম্মের ক্ষেত্রে সবচেয়ে অভিজ্ঞ কর্তৃপক্ষে পরিণত হওয়া সত্ত্বেও ধ্যানের ক্ষমতা না থাকায় বুদ্ধের জীবদ্দশায় নিব্বানা লাভ করেননি। দেবদত্তের ক্ষেত্রে আমরা যেমন দেখি, ধর্মগ্রস্থসমূহ তাকে গস্পেল কাহিনীর জুডাসের অনুরূপ ভূমিকা দিয়েছে।
জেসাসের অনুসারীদের বর্ণাঢ্য উপস্থাপনসহ গস্পেলের উল্লেখ পশ্চিমা পাঠকদের মনে আদি এইসব বৌদ্ধদের সম্পর্কে আরও জানতে আগ্রহী করে তোলে। হাজারে হাজারে সংঘে যোগ দেওয়া এই মানুষগুলো কারা ছিল? বুদ্ধের কাছে কীসের আকর্ষণে ছুটে এসেছিল তারা পালি টেক্সট সে সম্পর্কে সামান্যই জানায় আমাদের। কিংবদন্তী আভাস দেয় যে, ‘বহুজনের’ কাছে বার্তা পৌঁছে দেওয়া হলেও ব্রাহ্মণ ও ক্ষত্রিয় গোত্র হতে এসেছিল প্রথম যোগদানকারীরা। সবাই যোগদানের আহ্বান পেয়েছিল: বণিকরাও সংগঠনের প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিল। সন্ন্যাসীদের মতো তারাও বিকাশমান সমাজের ‘নতুন মানুষ’ ছিল। আবশ্যিকভাবে গোত্র বর্জিত সমাজের প্রতিনিধিত্বকারী একটা বিশ্বাসের প্রয়োজন ছিল তাদের। তবে গস্পেল যেমন জেলেদের জাল ছাড়া ও কর সংগ্রাহকদের বাড়ি ছাড়ার কথা বলে সে রকম ব্যক্তিগত ধর্মান্তরের কোনও বিস্তারিত কাহিনী নেই। ভিক্ষুদের মাঝে অনন্য হয়ে আছেন আনন্দ ও দেবদত্ত, কিন্তু জেসাসের কিছু অনুসারীর আরও ব্যাপক বিবরণের তুলনায় তাদের কাহিনীও প্রতীকী ও বিশেষ রীতি অনুসারী। এমনকি বুদ্ধের নেতৃস্থানীয় শিষ্য সারিপুত্ত ও মাগ্গালানাকেও দৃশ্যতঃ সামান্য ব্যক্তিত্বপূর্ণ মলিন চরিত্র হিসাবে তুলে ধরা হয়েছে। ছেলের সঙ্গে বুদ্ধের সম্পর্ক নিয়েও কোনও মর্মস্পশী আখ্যান নেই: পালি টেক্সটে রাহুলা স্রেফ আরেক জন সন্ন্যাসী হিসাবে আবির্ভূত হয়েছেন। তাঁকে ধ্যানের শিক্ষা দিয়েছেন বুদ্ধ, অন্য যেকোনও ভিক্ষুর ক্ষেত্রে যেমনটি করতেন তিনি। বিবরণে তাঁরা যে পিতা-পুত্র এমনটি বোঝানোর মতো কিছু নেই। ইমেজ পাই আমরা, কোনও ব্যক্তিত্ব নয়। ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যের প্রতি পাশ্চাত্য অনুরাগের কারণে আমরা অসন্তুষ্ট বোধ করি।
কিন্তু তাতে বৌদ্ধদের অভিজ্ঞতার প্রকৃতিকে ভুল বোঝা হবে। আদি এই সন্ন্যাসীদের অনেকেই কেবল অনাত্মার মতবাদ অনুধ্যান করে আলোকপ্রাপ্ত হয়েছিলেন। এটা তাদের সত্তার উর্দ্ধে যেতে সক্ষম করেছে। আসলে স্থায়ী ব্যক্তিত্ব বলে কোনও কিছুর অস্তিত্ব থাকার কথা অস্বীকার করেছেন বুদ্ধ। তিনি সত্তাবোধের কোনও পবিত্র, নূন্যতম বস্তুর প্রতি অটল বিশ্বাসকে আমাদের আলোকনের পথে বাধা হয়ে দাঁড়ানো ‘অদক্ষ’ বিভ্রান্তি মনে করতেন। অনাত্মার আধ্যাত্মিকতার ফলে খোদ বুদ্ধ পালি শাস্ত্রে বিশেষ ব্যক্তি না হয়ে বরং একটা ধরণ হিসাবে উপস্থাপিত হয়েছেন। অন্যান্য ধরনের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন তিনিঃ সংশয়বাদী, ব্রাহ্মণ ও জৈন। পশ্চিমা মানুষ যেসব অসাধারণ গুণ ও বৈশিষ্ট্যকে আদর্শ হিসাবে কদর করে ঠিক সেগুলোর বিলুপ্তি ঘটিয়েই মুক্তি অর্জন করেছেন তিনি। শিষ্যদের বেলায়ও একই কথা খাটে। ভিক্ষুদের সাথে বুদ্ধের পার্থক্য টানার মতো কিছু নেই, তাঁদের ক্ষুদ্র বুদ্ধ হিসাবে বর্ণনা করা হয়েছে। বুদ্ধের মতো তাঁরাও নৈর্ব্যক্তিক হয়ে গেছেন, ব্যক্তি হিসাবে বিলীন হয়ে গেছেন। অনুমোদিত টেক্সট তাঁদের মনের গভীরে যেতে অস্বীকার জানিয়ে এই পরিচয়হীনতা সংরক্ষণ করেছে; এসব আলোকন প্রাপ্তির আগে তাঁদের চরিত্রের কোনও পছন্দযোগ্য আচরণও প্রকাশ করবে না। দেবদত্ত ও আনন্দের সাধারণের চেয়ে ভিন্ন হওয়াটা দুর্ঘটনা নাও হতে পারে। দেবদত্ত অহমবাদে পরিপূর্ণ, এবং আনন্দ আলোকপ্রাপ্ত হতে ব্যর্থ হওয়ায় পরিণামে সরিপুত্তের মতো আধ্যাত্মিক মহাপুরুষের চেয়ে বেশি লক্ষযোগ্য ব্যক্তিগত গুণের অধিকারী ছিলেন। বুদ্ধের জীবনের শেষ ভাগে আমরা আনন্দের মহৎ হৃদয় সম্পর্কে আরও জানতে পারি, কিন্তু আমরা যেমন দেখব, তিনি বুদ্ধের দৃষ্টিভঙ্গির অংশীদার হতে পারেননি। ব্যক্তিত্বের এমনি বিনাশে বিলাপকারী কোনও পশ্চিমাবাসীকে ভিক্ষুরা সম্ভবত জানাতেন যে নিব্বানার অন্তস্থ শাস্তি লাভের জন্যে অহম বিসর্জনই যথার্থ মূল্য, সত্তাবোধে বন্দি কারও পক্ষে যা সম্ভবত অসম্ভব।