গৌতম কোনও ব্যক্তিক কাল্ট চাননি, কিন্তু বরং স্বয়ং তিনি, সক্রেটিস, কনফুসিয়াস এবং জেসাসের মতো আদর্শ ব্যক্তিবর্গ দেবতা বা অতিমানবীয় সত্তা হিসাবে পুজিত হয়েছেন। এমনকি পয়গম্বর মুহাম্মদও (স) সবসময় নিজেকে সাধারণ মানুষ হিসাবে দাবি করা সত্ত্বেও মুসলিমরা তাঁকে ঈশ্বরে আত্মসমর্পণ (ইসলাম) সম্পূর্ণ করার লক্ষ্যে একজন আদর্শ সম্পূর্ণ মানুষ হিসাবে শ্রদ্ধা করে। এইসব মানুষের অস্তিত্বের বিশালতা ও অর্জন সাধারণ মানদণ্ডকে অস্বীকার করে বলে মনে হয়। পালি বিধানে দেখা যায়, গৌতমের জীবনেও এসব ঘটনা ঘটেছে, কিন্তু এইসব অলৌকিক কাহিনীকে আক্ষরিক অর্থে সত্যি ধরে নেওয়া যাবে না। এগুলো আমাদের মানবীয় সত্তার কর্মকাণ্ড সম্পর্কে ধারণা দেয়। জেসাস, মুহাম্মদ (স) ও সক্রেটিসের মতো বুদ্ধও নারী-পুরুষকে কেমন করে জগৎ ও দুঃখ-কষ্টকে অতিক্রম করা যায়, কীভাবে মানবীয় তুচ্ছতা আর প্রলোভনের ঊর্ধ্বে উঠে পরম মূল্য আবিষ্কার করা যায়, সেই শিক্ষা দিচ্ছিলেন। সকলেই মানুষকে অধিকতর সচেতন করে তুলে তাদের পূর্ণ সম্ভাবনা সম্পর্কে জাগ্রত করে তুলতে চেয়েছেন। এভাবে ক্ষমতাশালী করে তোলা একজন মানুষের জীবনী আধুনিক বৈজ্ঞানিক ইতিহাসের মানদণ্ডকে সন্তুষ্ট করতে পারবে না। কিন্তু পালি লিপি ও এর সাথে সংশ্লিষ্ট টেক্সটসমূহে তুলে ধরা আদর্শ ব্যক্তির পর্যালোচনা থেকে আমরা মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষা সম্পর্কে আরও অনেক কিছু জানতে পারি। মানুষের দায়িত্ব সম্পর্কে নতুন দর্শন লাভ করি। একটি ত্রুটিপূর্ণ যন্ত্রণাময় বিশ্বে মানবীয় অবস্থা সম্পর্কে একটি ভিন্ন ধরনের সত্যের রূপরেখা তুলে ধরে এইসব উদাহরণমূলক কাহিনীগুলো।
তবে বুদ্ধের জীবনীর আরও চ্যালেঞ্জ রয়েছে। উদাহরণ স্বরূপ, গস্পেলসমূহ স্বভাবসহ জেসাসের একটি স্পষ্ট ব্যক্তি সত্তা তুলে ধরে: বাকধারা, বিশেষ বাঁক, আবেগ ও সংগ্রামের গম্ভীর মুহূর্ত, দৃঢ়তা, আতঙ্ক ও ভয় ধরে রাখা হয়েছে এখানে। বুদ্ধের ক্ষেত্রে এটি সত্যি নয়। তাঁকে ব্যক্তির চেয়ে বরং ধরণ হিসাবে উপস্থাপন করা হয়েছে। তাঁর আলোচনায় আমাদের আনন্দিত করে তোলা জেসাস বা সক্রেটিসের ভাষণের আকস্মিক সরল মন্তব্য, জোর ধাক্কা, রসালো উক্তির কোনওটাই পাই না। তিনি ভারতীয় দার্শনিক চাহিদা অনুসারে কথা বলেন: গম্ভীর, আনুষ্ঠানিক, নৈর্ব্যক্তিক। আলোকপ্রাপ্তির পর আমরা তাঁর পছন্দ-অপছন্দ, আশা-আশঙ্কা, হতাশার মুহূর্ত, উদ্বেলিত হওয়া বা গভীর সংগ্রাম সম্পর্কে কিছুই ধারণা করতে পারি না। অবশিষ্ট রয়ে গেছে কেবল অতিমানবীয় নীরবতা, আত্ম-নিয়ন্ত্রণ, ব্যক্তিগত পছন্দের অতীত এক ধরনের মহত্ব ও গভীর প্রশান্তি। বুদ্ধকে প্রায়শঃই অমানবিক সত্তা–পশু, গাছপালা কিংবা মহীরুহের সঙ্গে তুলনা করা হয়–সেটা তিনি মানবেতর বা অমানবিক বলে নয় বরং তিনি আমরা যে স্বার্থপরতাকে আমাদের অবস্থার সঙ্গে অনিবার্য মনে করি তাকে ছাড়িয়ে যেতে পেরেছেন বলে। বুদ্ধ মানুষ হওয়ার এক নতুন উপায়ের সন্ধান করছিলেন। পশ্চিমে আমরা ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ ও আত্ম-প্রকাশকে মূল্য দিই, কিন্তু এটা সহজেই আত্ম-প্রসাদে পরিণত হতে পারে। গৌতমের মাঝে আমরা পূর্ণাঙ্গ ও শ্বাসরুদ্ধকর আত্মত্যাগ লক্ষ করি। ধর্মগ্রন্থসমূহ তাঁকে একজন পরিপূর্ণ ‘ব্যক্তিত্ব’ হিসাবে তুলে ধরেনি জানতে পারলে অবাক হতেন না তিনি, বরং হয়তো বলতেন ব্যক্তিত্ব সম্পর্কে আমাদের ধারণা বিপজ্জনকভাবে মোহ। তিনি হয়তো বলতেন, তাঁর জীবনে অসাধারণ কিছু নেই। তাঁর আগেও অন্য বুদ্ধরা ছিলেন, যাঁদের প্রত্যেকেই একই ধৰ্ম্ম প্রচার করেছেন। একই অভিজ্ঞতা অর্জন করেছেন তাঁরাও। বুদ্ধ ট্র্যাডিশন এই ধরনের পঁচিশজন আলোকপ্রাপ্ত মানুষের অস্তিত্ব দাবি করে। বর্তমান ঐতিহাসিক যুগ শেষে, যখন এই অত্যাবশ্যকীয় সত্যের জ্ঞান ক্ষীণ হয়ে আসবে, মেত্তায়া নামে একজন নতুন বুদ্ধ আসবেন পৃথিবীতে। তিনিও একই জীবনচক্র অতিক্রম করবেন। বুদ্ধের এই আদিরূপের ধারণা এতই জোরাল যে নিদান কথায় পিতৃগৃহ হতে তাঁর ‘বহির্গমন’ সম্পর্কিত বিখ্যাত উপাখ্যানটিকে পালি শাস্ত্রে গৌতমের অন্যতম পূর্বসুরি বুদ্ধ বিপাসসির জীবনে ঘটার দাবি করা হয়েছে। ধর্মগ্রন্থসমূহে গৌতমের অসাধারণ, ব্যক্তিগত অর্জন সম্পর্কে নয়, বরং সকল বুদ্ধ, সকল মানুষের আলোকপ্রাপ্তির সন্ধানকালে অবশ্য অনুসরণীয় উপায় সম্পর্কে আগ্রহী।
গৌতমের কাহিনীর সঙ্গে আমাদের কালের বিশেষ সম্পর্ক রয়েছে। আমরাও বিসিই ষষ্ঠ ও পঞ্চম শতাব্দীর উত্তর ভারতের মতো পরিবর্তনের ভেতর দিয়ে অগ্রসর হচ্ছি। উত্তর ভারতীয় জনগণের মতো আবিষ্কার করছি যে, পবিত্রকে অনুভব করার প্রথাগত উপায় ও আমাদের জীবনের পরম অর্থ আবিষ্কার কঠিন কিংবা অসম্ভব। ফলস্বরূপ, আধুনিক অভিজ্ঞতায় শূন্যতা একটি অত্যাবশ্যকীয় অংশ হয়ে রয়েছে। গৌতমের মতো এক রাজনৈতিক সহিংসতার যুগে বাস করছি আমরাও। মানুষের প্রতি মানুষের ভীতিকর অমানবিক আচরণ লক্ষ করছি। আমাদের সমাজেও ব্যাপক অস্থিরতা, নাগরিক হতাশা ও বৈষম্য রয়েছে। অনেক সময় বিকাশমান নতুন বিশ্ব ব্যবস্থা নিয়ে শঙ্কিত হয়ে উঠি আমরা।