নতুন আরামায় দুমাস ছিলেন বুদ্ধ। এই সময়ই তাঁর দুজন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অনুসারী সংঘে যোগ দেন: রাজাগৃহের বাইরে ছোট গ্রামে ব্রাহ্মণ পরিবারে জন্ম হয়েছিল সারিপুত্ত ও মগ্গালানার। একই দিনে তাঁরা জগত- সংসার ত্যাগ করে সংশয়বাদী সঞ্জয়ের নেতৃত্বাধীন সংঘে যোগ দিয়েছিলেন। কিন্তু কেউই পূর্ণ আলোকপ্রাপ্ত হতে পারেননি। তখন তাঁদের ভেতর যে আগে নিব্বানা লাভ করবেন সঙ্গে সঙ্গে অন্যকে জানানোর রফায় পৌঁছেছিলেন তাঁরা। বুদ্ধের আগমনের সময় দুই বন্ধু রাজাগহে বাস করছিলেন। একদিন আশাজিকে (আদি পাঁচ ভিক্ষুর একজন) ভিক্ষা করতে দেখলেন সারিপুত্ত। মুহূর্তে সন্ন্যাসীর প্রশান্তি ও স্থৈর্য্যে ধাক্কা খেলেন তিনি। বুঝে গেলেন, এই মানুষটি আধ্যাত্মিক সমাধান পেয়ে গেছেন। তো প্রচলিত কায়দায় তাঁকে সম্ভাষণ জানিয়ে আশাজির গুরুর পরিচয় ও তিনি কোন ধম্ম অনুসরণ করেন জানতে চাইলেন। পবিত্র জীবনের সামান্য নবীশ হিসাবে নিজেকে তুলে ধরে ধম্মের সারাংশ জানালেন আশাজি। কিন্তু সেটাই যথেষ্ট ছিল। সেখানেই ‘স্রোতে প্রবেশকারী’তে পরিণত হলেন সারিপুত্ত। মগ্গালানাকে এ সংবাদ পৌঁছে দিতে ছুটলেন দ্রুত। তাঁর বন্ধুও ‘স্রোতে প্রবেশকারী’তে পরিণত হলেন। দুজনে মিলে সংঘে অন্তর্ভুক্ত হবার আবেদন জানাতে সঞ্জয়কে হতাশ করে তাঁর ২৫০ জন শিষ্যকে নিয়ে বাঁশ বনে বুন্ধের কাছে গেলেন তাঁরা। সারিপুত্ত ও মগ্গালানাকে আসতে দেখার সাথে সাথে ওদের প্রতিভা টের পেয়ে গেলেন বুদ্ধ। ‘এরাই হবে আমার প্রধান অনুসারী,’ ভিক্ষুদের বললেন তিনি। ‘সংঘের জন্যে বিরাট ভূমিকা রাখবে ওরা।’[১৪] এবং তাই প্রমাণিত হয়েছিল। বুদ্ধের মৃত্যুর ২০০ থেকে ৩০০ বছরের মধ্যে বিকশিত বৌদ্ধ মতবাদের দুটো প্রধান ধারার প্রেরণাদাতা হয়েছিলেন দুই বন্ধু।[১৫] অধিকতর কঠোর এবং মঠমুখী থেরাভেদা সারিপুত্তকে দ্বিতীয় প্রতিষ্ঠাতা বিবেচনা করে। বিশ্লেষণী ক্ষমতা ছিল তাঁর। এমনভাবে ধম্মের ব্যাখ্যা দিতে পারতেন যা সহজেই মনে রাখা যেত। কিন্তু তাঁর ধার্মিকতা বৌদ্ধ মতবাদ সম্পর্কে আরও গণতান্ত্রিক দর্শন বিশিষ্ট ও সহানুভূতির ওপর অনেক বেশি গুরুত্ব দানকারী জনপ্রিয় মহায়না ধারার তুলনায় বড় কাঠখোট্টা। মহায়না ধারা মগ্গালানাকে তাদের মন্ত্রণাদাতা হিসাবে গ্রহণ করেছে। ইদ্ধির জন্যে খ্যাত ছিলেন তিনি, অতিন্দ্রীয়ভাবে স্বর্গে আরোহণ করতে পারতেন; যোগ ক্ষমতায় মানুষের মনের কথা বোঝার অলৌকিক ক্ষমতা ছিল তাঁর। বুদ্ধের সারিপুত্ত ও মগ্গালানার উভয়ের প্রশংসা থেকে বোঝা যায় দুটো মতবাদকেই সঠিক মনে করা হয়েছে। এবং প্রকৃতপক্ষেই ক্রিশ্চান জগতের ক্যাথলিক ও প্রটেস্ট্যান্টদের চেয়ে ঢের শান্তিপূর্ণভাবে সহাবস্থান করেছে ওরা।
সবাই অবশ্য বুদ্ধের প্রেমে পড়েনি। বাঁশ বাগানে অবস্থান কালে রাজাগহের বহু অধিবাসী বোধগম্য কারণেই সংঘের নাটকীয় সমৃদ্ধিতে উদ্বিগ্ন বোধ করেছে। প্রথমে জটাধারী ব্রাহ্মণ, এবার সঞ্জয়ের সংশয়ীরা–এরপর কে? সমস্ত তরুণ-যুবাকে কেড়ে নিয়ে গৌতম সন্ন্যাসী সবাইকে সন্তানহীন ও নারীদের বিধবায় পরিণত করছেন। অচিরেই তাদের সংসার বিনষ্ট হয়ে যাবে। কিন্তু প্রসঙ্গটি বুদ্ধের গোচরে আনা হলে তিনি ভিক্ষুদের চিন্তা করতে নিষেধ করলেন: এটা স্রেফ সাতদিনের একটা বিস্ময় এবং নিশ্চিতভাবে সপ্তাহ খানেকের মধ্যে সমস্যা মিটে গিয়েছিল।[১৬]
পালি টেক্সট আমাদের বলছে, এই সময় কাপিলাবাস্তুতে বাবার বাড়িতে গিয়েছিলেন বুদ্ধ–তবে আমাদের বিস্তারিত কিছু জানায় না। অবশ্য, পরবর্তী সময়ের ধর্মগ্রস্থ ও ধারাভাষ্যগুলো পালি টেক্সটের কংকালে রক্ত-মাংস জুড়েছে; এইসব উত্তর-শাস্ত্রীয় কাহিনী বুদ্ধের কিংবদন্তীর অংশে পরিণত হয়েছে।[১৭] এসব আমাদের বলে, শুদ্ধোদন তাঁর ছেলে, এখন বিখ্যাত বুদ্ধ রাজাগহে ধর্ম প্রচার করছেন জানতে পেরে বিরাট এক প্রতিনিধিদলসহ বার্তাবাহক পাঠিয়ে কাপিলা-বাস্তুতে অতিথি হবার আমন্ত্রণ জানালেন। কিন্তু বুদ্ধের বক্তব্য শোনার পর শাক্যদের এই মিছিলের সবাই শুদ্ধোদনের বার্তার কথা ভুলে গিয়ে আরাহান্তে পরিণত হয়– এমন ঘটনা সাতবার ঘটেছিল। অবশেষে বুদ্ধকে আমন্ত্রণ পৌঁছে দেওয়া হলো। বিশ হাজার ভিক্ষু নিয়ে নিজ শহরের উদ্দেশে রওনা হলেন তিনি। শাক্যরা কাপিলাবাস্তুর বাইরে নিগরোধা বাগান ভিক্ষুদের হাতে ছেড়ে দেয়। শাক্যের সংঘের প্রধান কার্যালয়ে পরিণত হয় তা। কিন্তু শাক্যরা অহংকার ও ঔদ্ধত্য দেখিয়ে বুদ্ধকে সম্মান জানাতে অস্বীকার করে। ফলে, কথিত আছে, তাদের পর্যায়ে অবতরণ করে ইদ্ধির আকর্ষণীয় চমক তুলে ধরেন বুদ্ধ। শূন্যে ভাসলেন তিনি, হাত-পা হতে আগুন ও পানির ধারা বের হলো এবং সবশেষে আকাশের বুকে রত্নখচিত পথে হাঁটলেন। সম্ভবত অভ্যাসবশত শাক্যদের বোধগম্য ভাষায় কথা বলার চেষ্টা করছিলেন তিনি, তাদের মনের ভেতর প্রবেশ করতে চেয়েছেন। বাবা শুদ্ধোদন চেয়েছিলেন তিনি যেন বিশ্বশাসক চক্কবত্তী হন; এই কিংবদন্তীর চরিত্রও, কথিত আছে, রাজকীয় ঢঙে আকাশে ঘুরে বেড়াতে পারেন। উরুবেলায় বুদ্ধ ব্রাহ্মণ সাধকদের কাছে নিজেকে যেকোনও চক্কবত্তীর চেয়ে শ্রেয় করে তুলে ধরেছিলেন। প্রদর্শনীয় প্রভাব সৃষ্টি হয়েছিল তাতে, যদিও তা ছিল বাহ্যিক। শাক্যরা হতবাক হয়ে গিয়েছে। বুদ্ধের সামনে মাথা নত করেছে।