বুদ্ধের অলৌকিক কর্মকাণ্ড নয়, বরং নৈতিকতাই শেষ পর্যন্ত কশ্যপের বিশ্বাস যুগিয়েছিল। এখানেও টেক্সট হয়তো বোঝাতে চেয়ে থাকতে পারে যে, ইদ্ধির জাঁকাল প্রদর্শনী উল্টো ফল বয়ে আনতে পারে: একজন সংশয়বাদীকে অবশ্যই মুগ্ধ করতে পারেনি। প্রতিটি অলৌকিক ঘটনার পর কশ্যাপ স্রেফ আপন মনে বলেছেন: ‘এই মহান সন্ন্যাসী আকর্ষণীয় ও শক্তিশালী। কিন্তু আমার মতো আরাহান্ত নয়।’ শেষ পর্যন্ত বুদ্ধ তাঁকে অহংকার ও আত্মতুষ্টি হতে বের করে এনেছেন। ‘কশ্যপ,’ বলেছেন তিনি, ‘তুমি আরাহান্ত নও। এভাবে চলতে থাকলে কোনওদিনই আলোকপ্রাপ্ত হতে পারবে না।’ এমন অবাধ অহমবাদ আধ্যাত্মিক জীবনের সঙ্গে একেবারেই বেমানান। ভর্ৎসনা আঘাত হানল তাঁকে। বিখ্যাত সাধু হিসাবে এজাতীয় আত্মমর্যাদাবোধের বিপদ সম্পর্কে জানা থাকার কথা কশ্যপের। জমিনে আসন পেতে বসে সংঘের সদস্যপদ প্রার্থনা করলেন তিনি। তাঁর অন্য দুভাই ও এক হাজার অনুসারীর প্রত্যেকে তাঁকে অনুসরণ করল। বিপুল সংখ্যক নবীশ দেখা গেল এবার, জটা কামিয়ে পবিত্র তৈজষপত্র ফেলে পরিণত হলো ‘স্রোতে প্রবেশকারী’তে।[৯] এরপর বুদ্ধের তৃতীয় মহান হিতোপদেশ শুনবার জন্যে গয়ায় সমবেত হলো তারা।
‘ভিক্ষুগণ,’ শুরু করলেন বুদ্ধ, ‘সমস্ত কিছু পুড়ছে।’ অনুভূতি ও বাহ্যিক জগৎ, দেহ, মন ও আবেগ, যার ওপর এসব টিকে থাকে, পুড়ছে সমস্ত কিছু। এই অগ্নিকাণ্ডের কারণ কী? লোভ, ঘৃণা ও বিভ্রমের তিনটি অগ্নিকুণ্ড।[১০] মানুষ যতদিন এই শিখাগুলোকে ইন্ধন যোগাবে, ততদিন তা জ্বলতে থাকবে, কখনও নিব্বানার শীতলতা লাভ করবে না। পাঁচটি খণ্ডকে (ব্যক্তিত্বের ‘স্তূপ’ বা ‘উপাদান’) এভাবে আভাসে লাকড়ির ‘বান্ডিলে’র সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে। উপাদনা (‘আঁকড়ে’ থাকা) শব্দটার মধ্যেও এক ধরনের পরিহাস রয়েছে, যার মৌল অর্থ ‘জ্বালানি।’[১১] এই জগতের বস্তু সামগ্রী আঁকড়ে থাকার আকাঙ্ক্ষাই আমাদের জ্বালিয়ে রাখে ও আলোকন ব্যাহত করে। যথারীতি এই লোভ ও বাসনা জগতের অশুভ ও সহিংসতার জন্যে দায়ী ঘৃণার সঙ্গে মিশে যায়। অজ্ঞতার তৃতীয় অগ্নিকুণ্ড যতদিন জ্বলবে, মানুষ ততদিন ‘জন্ম, মায়া ও মৃত্যুর দুঃখ, শোক, বেদনা দুঃখ আর হতাশার’[১২] জ্বালাতনকারী চক্র হতে মুক্তির জন্যে আবশ্যক চারটি মহান সত্যি উপলব্ধি করতে পারবে না। সুতরাং ভিক্ষুকে অবশ্যই নিরাসক্ত হয়ে উঠতে হবে। অভিনিবেশের কৌশল তাঁকে তাঁর পাঁচটি খণ্ড হতে বিচ্ছিন্ন হতে শেখাবে; অগ্নিশিখাগুলোকে নিভিয়ে দেবে। তারপর নিব্বানার মুক্তি ও শান্তি প্রত্যক্ষ করবে সে।
অগ্নি-হিতোপদেশ বৈদিক ব্যবস্থার চমৎকার সমালোচনা ছিল। এর পবিত্র প্রতীক অগ্নি বুদ্ধ যেসব জিনিসকে জীবনের পক্ষে ভ্রান্তিপূর্ণ মনে করেছেন তার ইমেজ: অগ্নিকুণ্ড ও বাড়ির প্রতীক যেখান হতে একজন আন্তরিক সন্ধানীকে অবশ্যই ‘অগ্রসর হতে’ হবে। এটা আবার মানুষের চেতনাকে গড়ে তোলা অস্থির, বিধ্বংসী অথচ ক্ষণস্থায়ী শক্তিসমূহেরও চমৎকার প্রতীক। লোভ, ঘৃণা ও অজ্ঞতার তিনটি আগুন বেদের তিন পবিত্র আগুনের বিদ্রূপাত্মক বিপরীত নজীর: এক পুরোহিত গোষ্ঠী গড়ে তোলার ভ্রান্ত বিশ্বাস হতে এগুলোর পরিচর্যা করে ব্রাহ্মণরা স্রেফ তাঁদের আপন অহমবাদেই ইন্ধন যোগাচ্ছিলেন। হিতোপদেশটি ধম্মকে শ্রোতাদের উপযোগি করে তোলায় বুদ্ধের দক্ষতারও প্রকাশ, যেন তিনি তাদের অবস্থার সঙ্গে খাপ খাওয়াতে পারেন। বুদ্ধের হিতোপদেশ এমন জোরালভাবে তাদের ধর্মীয় চেতনায় সাড়া জাগিয়েছিল যে শোনার পর সাবেক অগ্নি-উপাসকদের সবাই নিব্বানা অর্জন করে আরাহান্তে পরিণত হয়েছিল।
ডিসেম্বরের শেষ নাগাদ নতুন হাজার ভিক্ষু সঙ্গে নিয়ে মগধের রাজধানী রাজাগহের উদ্দেশে যাত্রা করেন বুদ্ধ। আলোড়ন সৃষ্টি করল তাঁদের আগমন। নতুন আধ্যাত্মিকতার জন্যে ক্ষুধার্ত ছিল নগরবাসীরা। নগর উপকণ্ঠে চারাগাছের বনে নিজেকে বুদ্ধ দাবিকারী এক ব্যক্তি শিণির স্থাপন করেছেন জানতে পেরে রাজা বিম্বিসারা ব্রাহ্মণ গৃহস্থদের বিরাট একটা দল নিয়ে তাঁর সঙ্গে দেখা করতে গেলেন। উরুবেলা সম্প্রদায়ের সাবেক প্রধান কশ্যপকে বুদ্ধের অনুসারী রূপে দেখে হতবাক হয়ে গেলেন তাঁরা। কশ্যপের কাছে অগ্নি- উপাসনা ছাড়ার কারণ জেনে দারুণ ক্ষুব্ধ হলেন সবাই। কিন্তু তারা বুদ্ধের বাণী শোনার পর, পালি টেক্সট আমাদের বলছে, ১,২০,০০০ গৃহস্থের সবাই সাধারণ অনুসারীতে পরিণত হলো। সবার শেষে স্বয়ং রাজা বিম্বিসারাও বুদ্ধের সামনে নতজানু হয়ে তাঁকেও সাধারণ অনুসারী করে নেওয়ার আবেদন জানালেন। ছোটবেলা হতেই রাজার আশা ছিল এমন একজন বুদ্ধের প্রচার শুনবেন যাঁর ধম্ম তিনি বুঝতে পারবেন। এবার তাঁর সেই ইচ্ছা পূরণ হলো। এটা ছিল বুদ্ধ ও রাজার দীর্ঘস্থায়ী এক সম্পর্কের সূচনা। সেরাতে বুদ্ধকে তাঁর সঙ্গে খাবার জন্যে আমন্ত্রণ জানান রাজা।
খাবার সময় রাজা সংঘকে এমন এক উপহার দেন যা কিনা বৌদ্ধ সংগঠনের বিকাশের ক্ষেত্রে সুস্পষ্ট প্রভাব রাখবে। ভিক্ষুদের সংঘের আবাস হিসাবে রাজাগহের ঠিক বাইরে বেলুবানার বাঁশ বন নামে পরিচিত একটা প্রমোদ-উদ্যান (আরামা) দান করেছিলেন। সন্ন্যাসীগণ সেখানে নিরিবিলি শান্তি তে বসবাস করতে পারবেন, যেটা আবার যুগপৎ শহর ও মানুষের জন্যে সুগম, যাদের পরামর্শ নেওয়ার প্রয়োজন পড়বে। বনটি শহর হতে খুব দূরে বা খুব কাছে ছিল না… মানুষের পক্ষে সুগম, কিন্তু নিরিবিলি, নির্জন।[১৩] উপহার গ্রহণ করলেন বুদ্ধ। চমৎকার সমাধান ছিল এটা। তাঁর সন্ন্যাসীদের ‘বিচ্ছিন্নতা’ মনস্তাত্ত্বিক হওয়ার কথা, জগৎ হতে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্নতা নয়। সন্ন্যাসীদের ব্যক্তিগত সন্তোষের জন্যে নয়, মানুষের জন্যেই ব্যবস্থার অস্তিত্ব। ধ্যানের জন্যে সন্ন্যাসীদের কিছু মাত্রার শান্ত পরিবেশের প্রয়োজন হবে, যেখানে তাঁরা নিব্বানামুখী নিস্পৃহতা ও অন্তস্থ বিচ্ছিন্নতার বিকাশ ঘটাতে পারবেন, কিন্তু ধম্মের দাবি অনুযায়ী তাঁরা সম্পূর্ণ অন্যদের জন্যে বাঁচতে চাইলে নিজেদের দুঃখ-কষ্ট প্রশমিত করার পদ্ধতি শিখতে সাধারণ মানুষের অবশ্যই তাঁদের কাছে আসার সুযোগ থাকতে হবে। বাঁশ বনের উপহার একটা নজীর স্থাপন করে। ধনী দাতারা প্রায়শঃই সংঘকে শহরতলীর অনুরূপ উদ্যান উপহার দিয়েছে, যা ভবঘুরে ভিক্ষুদের আঞ্চলিক কার্যালয়ে পরিণত হয়েছিল।