ধর্মগ্রন্থসমূহ বলে, এপ্রিলের শেষে বা মে-র প্রথম দিকে নিব্বানা লাভ করেন বুদ্ধ। কিন্তু এই গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা কোন বছর ঘটেছিল সেটা প্রকাশ করে না। দীর্ঘদিন ধরে ৫২৮ বিসিইকেই প্রচলিত সন হিসাবে বিবেচনা করা হয়ে আসছিল, যদিও কোনও কোনও আধুনিক পণ্ডিত একে ৪৫০-এর শেষ দিকের ঘটনা মনে করেন।[২] আমরা পালি টেক্সটের সম্ভাব্য ত্বরান্বিত ঘটনাক্রমপঞ্জী অনুসরণ করলে বুদ্ধ সম্ভবত বর্ষা ঋতুর শেষে, সেপ্টেম্বরে ষাট জন সন্ন্যাসীকে দীক্ষা দানের উদেশ্যে প্রেরণ করে থাকবেন। অন্যান্য সংঘের মতো বুদ্ধের নতুন সংগঠনও শিথিল ও ভ্রমণশীল সংস্থা ছিল। যেখানে পারতেন কোনওমতে ঘুমিয়ে থাকতেন সন্ন্যাসীরা: ‘জঙ্গল, গাছপালার নিচে, ঝুলন্ত পাথরের নিচে, গিরিখাতে, পাহাড়ী গুহায়, শ্মাশানে, বনে, প্রকাশ্য স্থানে, খড়ের গাদায়।’[৩] কিন্তু প্রতিদিন ধ্যানে সময় কাটাতেন তাঁরা আর যাদের প্রয়োজন সেইসব মানুষকে, বিশেষ করে সময়ের অস্থিরতা সবচেয়ে তীব্রভাবে অনুভূত হওয়া নতুন শহরগুলোর বাসিন্দাদের ধম্ম দীক্ষা দিতেন। তাঁদের শিক্ষা সফল হয়েছিল: কেবল সাধারণ অনুসারীই সংগ্রহ করেননি তাঁরা বরং সংঘের নতুন সদস্যও পেয়েছিলেন। ষাট সন্ন্যাসীকে নতুন নবীশ সংগ্রহ করে পূর্ণাঙ্গ সন্ন্যাসী হিসাবে দীক্ষা দেওয়ার ক্ষমতা দিয়েছিলেন বুদ্ধ।[৪]
আরও একবার একাকী হওয়ার পর উরুবেলায় ফিরে এলেন বুদ্ধ। চলার পথে স্থানীয় এক বারবনিতার পিছু ধাওয়াকারী তিরিশজন উচ্ছৃঙ্খল তরুণকে ধম্ম দীক্ষা দেন তিনি। মেয়েটি ওদের টাকা নিয়ে সটকে পড়েছিল। ‘তোমাদের জন্যে কোনটা ভালো?’ জিজ্ঞেস করেন বুদ্ধ, ‘একজন নারীর সন্ধান করা, নাকি নিজেদের খুঁজে পাওয়া?’[৫] ঘটনাটি মানুষের আনন্দের পেছনে অর্থহীন ছুটোছুটি করার একটা স্পষ্ট উপমা, যা কেবল হতাশ ও নিঃস্ব করে তুলতে পারে।
বুদ্ধের কথা শোনার পর তরুণদের সবাইই ‘স্রোতে প্রবেশকারীতে পরিণত হয়ে সংঘে যোগ দেয়। কিন্তু উরুবেলায় পৌঁছার পর উরুবেলা, গয়া ও নিরঞ্জরা নদীর পাশের বনে সাফল্যের সঙ্গে তিন কশ্যপ ভাইদের নেতৃত্বে বসবাসকারী হাজার সদস্যের গোটা একটা সংঘকে দীক্ষা দেওয়ার মাধ্যমে আরও চমকপ্ৰদ ধর্মান্তর অর্জন করেন তিনি। কাহিনীটিকে সম্ভবত বৈদিক ট্র্যাডিশনের সঙ্গে আদি বৌদ্ধদের মোকাবিলা তুলে ধরা উদাহরণ হিসাবে পড়া উচিত।[৬] এই ব্রাহ্মণরা ‘অগ্রসর হয়েছেন’ ও সাধারণ সমাজের স্থির, শৃঙ্খলাপূর্ণ জীবনধারা প্রত্যাখ্যানের প্রতীক হিসাবে চুল বড় হতে দিয়ে জট পাকাতে দিয়েছেন। কিন্তু তখনও তাঁরা প্রাচীন আচার-অনুষ্ঠান পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে পালন করতেন। তিনটি পবিত্র অগ্নিকুণ্ডের যত্ন নিচ্ছিলেন তাঁরা।
পুরো শীতলকাল উরুবেলা সম্প্রদায়ের সঙ্গে কাটান বুদ্ধ। এখানে বেশ কিছু লক্ষণীয় অলৌকিক কাণ্ড ঘটান। জনপ্রিয় স্বর্গীয় প্রতীক এক ভয়ঙ্কর গোখরা সাপকে বশ মানান, ব্রাহ্মণরা যাকে তাঁদের পবিত্র অগ্নিকুণ্ডে স্থাপন করতেন। সমস্ত বনকে অপার্থির ঔজ্জ্বলো ভরিয়ে দিয়ে রাতে তাঁর আস্তানায় বেড়াতে আসা দেবতাদের আনন্দ যোগান তিনি। অগ্নি উৎসের জন্যে অলৌকিক উপায়ে গাছের গুঁড়ি চিরেছেন তিনি, স্বর্গে আরোহণ করে স্বর্গীয় ফুল নিয়ে এসেছেন। উরুবেলা সম্প্রদায়ের নেতা কশ্যপকে দেখিয়ে দিয়েছিলেন, তিনি তার অন্তর পড়তে পারেন। পালি টেক্সট ও পরবর্তীকালের জীবনী, উভয়ই প্রথমদৃষ্টিতে যা বিস্ময়কর বুদ্ধের এই ধরনের নিদর্শন ও কেরামতির বিবরণ ধারণ করে। যোগের অনুশীলন দক্ষ যোগিদের বস্তুর ওপর মনের আধিপত্য সৃষ্টির ক্ষমতা (ইদ্ধি) দেওয়ার কথা। কিন্তু তরুণ যোগিদের সাধারণত ইদ্ধির চর্চার ব্যাপারে সতর্ক করা হয়, কারণ এতে একজন আধ্যাত্মিক ব্যক্তির সামান্য বুজরুকে পরিণত হওয়াটা খুবই সহজ হয়ে পড়ে। স্বয়ং বুদ্ধই এই ধরনের প্রদর্শনবাদীতার তীব্র সমালোচক ছিলেন। প্রকাশ্যে ইদ্ধির চর্চা করার ব্যাপারে অনুসারীদের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছেন তিনি। কিন্তু পালি টেক্সট রচনাকারী সন্ন্যাসীগণ বিশ্বাস করে থাকবেন যে, এই ধরনের কেরামতি সম্ভব ছিল। সম্ভবত ধর্মীয় যুক্তি হিসাবে তাঁরা এইসব কাহিনী ব্যবহার করেছেন। শিক্ষা দানের ক্ষেত্রে টেক্সট রচনাকারী থেরাভেদীয় সন্ন্যাসীগণ হয়তো বুদ্ধের এইসব আকর্ষণীয় ক্ষমতা থাকার কথা বলা সুবিধাজনক মনে করে থাকতে পারেন। এছাড়া, ব্রাহ্মণ ও বৈদিক ধর্মের কর্তাদের সঙ্গে বিতর্কের সময় বুদ্ধ প্রাচীন দেবতাদের বিরুদ্ধে লড়েছেন (আগ্নিকক্ষের পবিত্র গোখরার মতো) বর্ণনা করতে পারাটা উপকারী ছিল; সামান্য ক্ষত্রিয় হলেও ব্রাহ্মণদের ঢের বেশি শক্তি ছিল তাঁর, তিনি তাদের অনায়াসে পরাস্ত করেছেন। পরবর্তীকালে টেক্সট আমাদের বলছে, সমগ্ৰ গোত্ৰ প্রথাকেই চ্যালেঞ্জ করেছেন বুদ্ধ: ‘কেবল জন্মই কাউকে ব্রাহ্মণ বা অস্পৃশ্য করে তোলে না বরং সেটা আমাদের কর্মকাণ্ড (কম্ম)’,[৮] জোর দিয়ে বলেছেন তিনি। ‘নৈতিক আচরণের ওপর ধর্মীয় মর্যাদা নির্ভর করে, জন্মগত দুর্ঘটনার উপর নয়।’ যথারীতি অ্যাক্সিয়েল যুগের অন্য সব মহান সাধুর মতো বুদ্ধ যুক্তি দেখিয়েছেন, বিশ্বাসকে নৈতিকতার সঙ্গে সম্পর্কিত হতে হবে, এটা ছাড়া আচার-আচরণ অর্থহীন।