এখানে এমন একটি ধারণা রয়েছে যা সব প্রধান ধর্মীয় ব্যক্তিত্বদের বেলায়ই সত্যি। আধুনিক নিউ টেস্টামেন্ট পণ্ডিতগণ দেখিয়েছেন, আমরা যতটা ধারণা করি আসলে ঐতিহাসিক জেসাস সম্পর্কে তার চেয়ে অনেক কম জানি। আমরা যেমন মনে করি, ‘গস্পেল-সত্যি’ আসলে মোটেই তেমন নিরেট নয়। কিন্তু তা লক্ষ লক্ষ মানুষের নিজেদের জীবনকে জেসাসের অনুসরণে গড়ে তুলতে ও নতুন জীবন ধারণের উপায় হিসাবে তাঁর সহমর্মিতা ও কষ্ট ভোগের পথ অনুসরণের বেলায় বাধা হয়ে দাঁড়ায়নি। জেসাস ক্রাইস্ট অবশ্যই ছিলেন, কিন্তু গস্পেলসমূহে উদাহরণ হিসাবে তাঁর কাহিনী তুলে ধরা হয়েছে। ক্রিশ্চানরা তাদের নিজস্ব সমস্যার মূলে চোখ ফেরানোর সময় তাঁর শরণাপন্ন হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে কেউ ব্যক্তিগত রূপান্তরের অভিজ্ঞতা লাভ করলেই কেবল তার পক্ষে পুরোপুরিভাবে জেসাসকে উপলব্ধি করা সম্ভব। বুদ্ধের ক্ষেত্রেও একথা সত্যি: যিনি সম্ভবত বিংশ শতাব্দী পর্যন্ত সর্বকালের অন্যতম প্রভাবশালী ব্যক্তি ছিলেন। তাঁর শিক্ষা ১,৫০০ বছর ধরে ভারতে বিকাশ লাভ করে, তারপর তিব্বত, মধ্য এশিয়া, চীন কোরিয়া, জাপান ও দক্ষিণ এশিয়ায় ছড়িয়ে পড়ে। লক্ষ লক্ষ মানুষের কাছে তিনি মানবীয় অবস্থার প্রতীক ছিলেন।
এতে বোঝা যায় বুদ্ধের জীবন উপলব্ধি, যার কিয়দংশে তাঁর শিক্ষার সঙ্গে সম্পর্কিত, আমাদেরও মানুষের সংকট উপলব্ধিতে সাহায্য করতে পারে। কিন্তু এটা সাধারণভাবে একবিংশ শতাব্দীতে যেসব জীবনী রচিত হয়ে থাকে তেমন কিছু হতে পারবে নাঃ প্রকৃতপক্ষে কী ঘটেছিল তা উদ্ধার বা বুদ্ধের জীবন সম্পর্কে বিতর্কিত নতুন তথ্য আবিষ্কার করবে না এটা, কারণ আমরা সততার সঙ্গে ঐতিহাসিক সত্য হিসাবে নিশ্চিত করতে পারব, ধর্মগ্রন্থসমূহে এমন একটি ঘটনাও নেই ঘটনাও নেই। কিংবদন্তীর সত্যটুকুই ঐতিহাসিক। আমাদের অবশ্যই বুদ্ধের মৃত্যুর প্রায় শত বছর পর পালি টেক্সটসমূহ চূড়ান্ত রূপ নেওয়ার সময় যেভাবে প্রকাশ পেয়েছিল সেভাবেই সমগ্র কিংবদন্তীকে গ্রহণ করতে হবে। বর্তমানে বহু পাঠকই এই কিংবদন্তীর বৈশিষ্ট্যকে অবিশ্বাস্য মনে করবেন: গৌতমের জীবনে অধিকতর জাগতিক ও ঐতিহাসিক সম্ভাব্য ঘটনাবলীর সঙ্গে দেবতার কাহিনী ও অলৌকিক ঘটনাবলী স্থান পেয়েছে। আধুনিক ঐতিহাসিক সমালোচনায় অতিলৌকিক ঘটনাবলীকে পরবর্তী সময়ের সংযোজন বিবেচনায় বাদ দেওয়াই সাধারণ গৃহীত নিয়ম। কিন্তু পালি বিধানের ক্ষেত্রে আমরা তা করতে গেলে কিংবদন্তীকে বিকৃত করা হবে। অধিকতর স্বাভাবিক ঘটনাগুলো এইসব তথাকথিত নিদর্শন ও বিস্ময়কর ঘটনাসমূহের তুলনায় কিংবদন্তীর আদিরূপ কিনা নিশ্চিত হতে পারব না আমরা। বিধি-বিধানের বিকাশকারী সন্ন্যাসীগণ নিশ্চিতভাবে দেবতার বিশ্বাস করতেন, যদিও তাঁদের সীমাবদ্ধ সত্তা হিসাব দেখেছেন; এবং আমরা যেমন দেখব, তাঁদের মানবীয় মনস্তাত্ত্বিক অবস্থার অভিক্ষেপ হিসাবে দেখতে শুরু করেছিলেন। তাঁরা আরও বিশ্বাস করতেন যে, যোগে দক্ষতা যোগীকে অসাধারণ ‘অলৌকিক’ ক্ষমতা (ইদ্ধি) দেয়। যোগ অনুশীলন এমনভাবে মনকে প্রশিক্ষিত করে যে তা ব্যতিক্রমী কর্মকাণ্ড দেখাতে পারে, ঠিক যেমন অলিম্পিক অ্যাথলিটকে সাধারণ মরণশীলের অতিরিক্ত ক্ষমতা যোগায়। লোকে ধরে নিত যে, একজন দক্ষ যোগী শূন্যে ভাসতে পারে, মানুষের মনের কথা পড়তে পারে ও ভিন্ন লোকে গমন করতে পারে। বিধি-বিধান সংকলক সন্ন্যাসীগণ হয়তো বুদ্ধ এসব কাজে সক্ষম বলে প্রত্যাশা করে থাকবেন, যদিও ইদ্ধি সম্পর্কে তাঁর তীর্যক দৃষ্টিভঙ্গি ছিল। এসব এড়িয়ে যাওয়ার প্রয়োজন বোধ করেছিলেন তিনি আমরা যেমন দেখব, ‘অলৌকিক কাহিনীগুলো’ প্রায়শঃই সতর্কতামূলক গল্প, এজাতীয় আধ্যাত্মিক প্রদর্শনবাদীতার অর্থহীনতা তুলে ধরার লক্ষ্যেই রচিত।
পালি ধর্মগ্রন্থে লিপিবদ্ধ কাহিনীগুলোর অনেকগুলোরই রূপক বা প্রতীকী অর্থ রয়েছে। আদি বৌদ্ধরা ধর্মগ্রন্থে ঐতিহাসিকভাবে নির্ভুল বর্ণনার চেয়ে তাৎপর্যের সন্ধান করেছে। আমরা এও দেখব, নিদান কথার মতো প্রাপ্ত পরবর্তী সময়ের জীবনীসমূহ পালি বিধি-বিধানের অধিকতর বিচ্ছিন্ন এবং প্রায়গিক বিবরণের তুলনায় গৌতমের পিতৃগৃহ ত্যাগের সিদ্ধান্ত বা তাঁর আলোকপ্রাপ্তির মতো ঘটনাবলীর বিকল্প ও অধিকতর বিস্তারিত বিবরণ দেয়। পরবর্তী সময়ের এইসব কাহিনীও বিধি-বিধানের পৌরাণিক উপাদানের চেয়ে অনেক সমৃদ্ধঃ দেবতার আবির্ভাব হচ্ছে, পৃথিবী কাঁপছে, অলৌকিকভাবে দরজা খুলে যাচ্ছে। আবার এমনটা মনে করা ভুল হবে যে, এসব অলৌকিক বর্ণনা আদি কিংবদন্তীর সঙ্গে যোগ করা হয়েছে। পরবর্তী কালের এইসব জীবনী সম্ভবত বুদ্ধের মৃত্যুর শত বছর পর রচিত নিখোঁজ জীবনীর উপর ভিত্তি করে রচিত, একই সময়ে বিধি-বিধান নির্দিষ্ট রূপ পেয়েছিল। এই স্পষ্ট পৌরাণিক কাহিনীগুলো বিধানের কাহিনীর চেয়ে ভিন্ন ছিল বলে আদি বৌদ্ধদের উদ্বিগ্ন করে তোলেনি। এগুলো ছিল এইসব ঘটনার আধ্যাত্মিক ও মনস্তাত্ত্বিক অর্থ প্রকাশকারী স্রেফ ভিন্ন ব্যাখ্যা।
কিন্তু এইসব মিথ ও অলৌকিক ঘটনাবলী দেখায় যে, বুদ্ধকে স্রেফ একজন পধপ্রদর্শক ও দৃষ্টান্ত স্থাপনকারী হিসাবে দেখা উচিৎ বলে যারা বিশ্বাস করতেন সেই থোরাভাদীয় সন্ন্যাসীরাও তাঁকে অতিমানব হিসাবে দেখতে শুরু করেছিলেন। অধিকতর জনপ্রিয় মহায়না মতবাদ কার্যত গৌতমকে দেবতায় পরিণত করেছে। মনে করা হতো যে, থেরাভেদা বৌদ্ধ মতবাদের খাঁটি রূপ তুলে ধরে আর মহায়না ছিল বিকৃত। কিন্তু আধুনিক পণ্ডিতরা মনে করেন উভয়ই সঠিক। থেরাভেদা যোগের গুরুত্বের ওপর জোর দিয়ে গেছে এবং বুদ্ধের মতো আলোকপ্রাপ্ত আরাহান্তে (‘সফল জন’) পরিণত সন্ন্যাসীদের সম্মান প্রদর্শন করেছে। কিন্তু মহায়নায় বুদ্ধকে মানুষের জীবনে চিরন্তন সত্তা এবং উপাসনার বস্তু হিসাবে শ্রদ্ধাকারীরা পালি টেক্সটে জোরের সঙ্গে গুরুত্ব দেওয়া অন্যান্য মূল্যবোধ, বিশেষত সহমর্মিতার গুরুত্ব সংরক্ষণ করেছে। তারা মনে করেছে থেরাভেদা বড় বেশি বিশেষায়িত, আরাহান্তরা স্বার্থপরের মতো নিজেদের মাঝে অলোকনকে আঁকড়ে রেখেছেন। তাঁরা বুদ্ধ হওয়ার নিয়তিপ্রাপ্ত কিন্তু ‘বহুজনের’ কাছে মুক্তির বার্তা পৌঁছে দেওয়ার জন্যে আলোকন বিলম্বিতকারী নারী-পুরুষ বোধিসত্তাদের শ্রদ্ধা জানাতে পছন্দ করেছেন। আমরা দেখব, এটাই ছিল সন্নাসীদের ভূমিকা সম্পর্কে গৌতমের নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি। দুটো মতবাদই গুরুত্বপূর্ণ গুণাবলী আঁকড়ে ধরেছে: দুটোই সম্ভবত কিছু হারিয়েছে।