তবে আমাদের হতাশ হওয়ার কারণ নেই। টেক্সটসমূহ ঐতিহাসিক উপাদান ধারণ করে যা বিশ্বস্ত বলে মনে হয়। বিসিই পঞ্চম শতাব্দীর উত্তর ভারত সম্পর্কে অনেক কিছুই জানতে পারি আমরা, যার সঙ্গে বুদ্ধের সমসাময়িক জৈনদের ধর্মগ্রন্থ মিলে যায়। টেক্সটে বেদ-ধর্মের নির্ভুল উল্লেখ রয়েছে, যার সম্পর্কে পরবর্তী কালের ধর্মগ্রন্থ ও ধারাভাষ্যের রচয়িতা বেশ অজ্ঞ ছিলেন; মঘদের রাজা বিম্বিসারার মতো ঐতিহাসিক ব্যক্তিত্ব সম্পর্কে জানতে পারি আমরা, নগর জীবনের উন্মেষ ও সেই আমলের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান সম্পর্কেও জানতে পারি; প্রত্নতাত্ত্বিক, ভাষাবিজ্ঞানী ও ইতিহাসবিদদের আবিষ্কারের সঙ্গে এসব মিলে যায়। পণ্ডিতরা এখন নিশ্চিত যে, সম্ভবত এইসব ধর্মীয় উপাদানের কিছু কিছু একেবারে আদি বৌদ্ধ মতবাদের সমসাময়িক। বুদ্ধ স্রেফ বৌদ্ধদের আবিষ্কার, ঊনবিংশ শতাব্দীর এমন দৃষ্টিভঙ্গি আজ মেনে নেওয়া কঠিন বিপুল শিক্ষার ভেতর একটি আদি বুদ্ধিমত্তার দিকে নির্দেশকারী এক ধরনের সামঞ্জস্যতা রয়েছে, রয়েছে সম্পর্ক। এগুলোকে সমন্বিত সৃষ্টি হিসাবে চিন্তা করা কঠিন। এমন ঘটা অসম্ভব নয় যে এসব বাণীর কিছু কিছু সত্যিই খোদ সিদ্ধার্থ গৌতমের উচ্চারণ ছিল, যদিও সেগুলো ঠিক কোনগুলো সে ব্যাপারে নিশ্চিত হতে পারব না আমরা।
পালি লিপির এই বর্ণনা হতে আরেকটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় উঠে আসে: এখানে বুদ্ধের জীবনের কোনও ধারাবাহিক বিবরণ নেই। ছোট ছোট ঘটনার সাথে শিক্ষার উল্লেখ করা হয়েছে এবং স্রেফ কোনও নিয়ম বা মতবাদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেওয়া হয়েছে। কখনও কখনও হিতোপদেশে বুদ্ধ সন্ন্যাসীদের কাছে নিজের পূর্ব-জীবন বা আলোকপ্রাপ্তির কথা বলেছেন। কিন্তু ইহুদি ও ক্রিশ্চান ঐশিগ্রন্থে মোজেস বা জেসাসের জীবন বৃত্তান্তের মতো উন্নত সময়ানুক্রমিক কোনও বিবরণ নেই। পরবর্তী সময়ে বুদ্ধরা পরিবর্ধিত, ধারাবাহিক জীবনী রচনা করেছে। আমাদের কাছে তিব্বতীয় ললিতা-বিস্তারা (সিই তৃতীয় শতাব্দী) এবং পালি নিদান কথা রয়েছে (সিই পঞ্চম শতাব্দী), জাতকা কাহিনীর ধারাভাষ্যের রূপ ধারণ করেছে এগুলো। সিই পঞ্চম শতকে থেরাভাদীয় পণ্ডিত বুদ্ধগোসা কর্তৃক চূড়ান্ত রূপ দেওয়া বিধিবিধানের পালি ধারাভাষ্যও পাঠককে বিধি-বিধানে বর্ণিত বিচ্ছিন্ন ও খণ্ড খণ্ড ঘটনাবলীকে সময়ানুক্রমে সাজাতে সাহায্য করেছে। কিন্তু এসব পরিবর্ধিত বিবরণেও ফাঁক রয়েছে। এগুলোয় বুদ্ধের আলোকপ্রপ্তির পরবর্তী পঁয়তাল্লিশ বছরের শিক্ষাব্রতের কোনও বিস্তারিত বর্ণনা নেই। ললিতা-বিস্তারা শেষ হয়েছে বুদ্ধের প্রথম হিতোপদেশ দিয়ে; এবং নিদান কথার সমাপ্তি ঘটেছে শিক্ষাব্রতের সূচনায় কোসালার রাজধানী সাবাস্তিতে প্রথম বুদ্ধ বসতির গোড়াপত্তনের ভেতর দিয়ে। বুদ্ধের ব্রতের আরও বিশ বছর সময় রয়েছে যার সম্পর্কে আমরা কিছুই জানি না।
এসব যেন যেসব বৌদ্ধ ঐতিহাসিক বুদ্ধের কাহিনী অপ্রাসঙ্গিক দাবি করে তারাই সঠিক, এমন ইঙ্গিতই করে। একথাও সত্যি যে উত্তর ভারতের অধিবাসীরা আমাদের মতো ইতিহাসে আগ্রহী ছিল না। তারা ঐতিহাসিক ঘটনাবলীর তাৎপর্য নিয়েই বেশি উদ্বিগ্ন ছিল। ফলে ধর্মগ্রন্থসমূহ অধিকাংশ পশ্চিমারা যাকে অপরিহার্য মনে করবে সেসব বিষয়ে খুব সামান্য তথ্যই যোগায়। আমরা এমনকি বুদ্ধ কোন শতাব্দীতে জীবন যাপন করেছেন সেটাও নিশ্চিত হতে পারি না। সাধারণভাবে মনে করা হয় যে, আনুমানিক বিসিই ৪৮৩ সালে তিনি পরলোকগমন করেন। কিন্তু চীনা উৎসগুলো ধারণা দেয়, আরও পরে, বিসিই ৩৬৮ অব্দেও মারা গিয়ে থাকতে পারেন তিনি। খোদ বৌদ্ধরাই তাঁর জীবন সম্পর্কে এমন উদাসীন হয়ে থাকলে গৌতমের জীবনী নিয়ে কেন মাথা ঘামাতে যাবে কেউ?
কিন্তু কথাটা পুরোপুরি সত্যি নয়। পণ্ডিতগণ এখন বিশ্বাস করেন যে, দ্বিতীয় সম্মেলনকালে রচিত গৌতমের জীবনের একটি হারিয়ে যাওয়া আদি বিররণের ভিত্তিতেই পরবর্তী সময়ের পরিবর্ধিত জীবনীগুলো রচিত। এছাড়া, ধর্মগ্রন্থসমূহ দেখায়, আদি বৌদ্ধরা গৌতমের জীবনীর কিছু গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্ত নিয়ে গভীর চিন্তা করেছে: তাঁর জন্ম, স্বাভাবিক দৈনন্দিন জীবনযাপন পরিহার, আলোকপ্রাপ্তি, শিক্ষাব্রতের সূচনা ও পরলোকগমন। এসব ছিল বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। গৌতমের জীবনীর কিছু দিক সম্পর্কে আমরা হয়তো অন্ধকারে থাকতে পারি, কিন্তু এসব গুরুত্বপূর্ণ ঘটনায় ফুটে ওঠা সাধারণ কাঠামোর সঠিকতা সম্পর্কে নিশ্চিত থাকা যেতে পারে। বুদ্ধ সবসময় জোর দিয়ে বলেছেন, তাঁর শিক্ষাসমূহ সম্পূর্ণই নিজস্ব অভিজ্ঞতা ভিত্তিক। তিনি অন্যদের দৃষ্টিভঙ্গি যাচাই করেননি বা কোনও বিমূর্ত তত্ত্বের বিকাশ ঘটাননি। নিজের জীবন-ইতিহাস হতে নিজস্ব সিদ্ধান্তে পৌঁছেছেন। তিনি শিষ্যদের শিখিয়েছেন যে, আলোকপ্রাপ্ত হতে হলে তাদের অবশ্যই গৃহত্যাগ করে ভিক্ষু-সন্ন্যাসী হতে হবে, যোগের মানসিক অনুশীলন অনুসরণ করতে হবে-যেমন তিনি করেছেন। তাঁর জীবন ও শিক্ষা অবিচ্ছেদ্য। তাঁর দর্শন অনিবার্যভাবে আত্মজীবনীমূলক। অন্য বৌদ্ধদের জন্যে আদর্শ ও অনুপ্রেরণা হিসাবে ধর্মগ্রন্থে তাঁর জীবনের মূল কাঠামো বর্ণনা করা হয়েছে। তিনি যেমন বলেছেন: ‘যে আমাকে দেখে সে ধম্মকে (শিক্ষা) দেখে আর যে ধম্ম দেখে সে আমাকেই দেখে।’