বুদ্ধের মৃত্যুর প্রায় একশো বছর পর দ্বিতীয় বারের মতো সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। ইতিমধ্যে টেক্সটসমূহ বর্তমান পালি লিপিতে রূপ নিয়েছিল বলে মনে হয়। একে প্রায়শঃই তিপিতাকা (‘তিনটি ঝুড়ি’) নামে অবিহিত করা হয়, কারণ পরবর্তী কালে ধর্মগ্রন্থসমূহ লিপিবদ্ধ করার সময় সেগুলোকে তিনটা ভিন্ন ভিন্ন পাত্রে রাখা হয়েছিল: বয়ানের ঝুড়ি (সুত্তা পিতাকা), অনুশীলনের ঝুড়ি (বিনয়া পিতাকা) ও বিভিন্ন শিক্ষার একটা মিশ্র রূপ। প্রতিটি ‘ঝুড়ি’ আবার এভাবে ভাগ করা ছিল:
[১] সুত্তা পিতাকা, বুদ্ধের হিতোপদেশের পাঁচটি ‘সংগ্রহে’র (নিকয়া) সমষ্টি :
[ক] দিঘা নিকয়া: সন্ন্যাসীদের আধ্যাত্মিক প্রশিক্ষণ, সাধারণ মানুষের দায়িত্ব-কর্তব্য ও বিসিই পঞ্চম শতকের ভারতীয় ধর্মীয় জীবনের নানান বিষয়ের ওপর আলোকপাতকারী দীর্ঘ আলোচনাগুলোর চৌত্রিশটির সংকলন। তবে বুদ্ধের গুণাবলী (সাম্পাসাদানিয়া) এবং তাঁর জীবনের শেষ দিনগুলোর (মহা পরিনিব্বানা) একটি বিবরণও আছে।
[২] মাজহিমা নিকয়া: ১৫২টি মাঝারি দৈর্ঘ্যের হিতোপদেশের (সুত্তা) সংকলন। এগুলোয় রয়েছে বুদ্ধ, আলোকপ্রাপ্তির জন্যে তাঁর সংগ্রাম ও আদি শিক্ষার বিপুল পরিমাণ কাহিনী এবং সেই সঙ্গে মৌল মতবাদের কয়েকটি।
[৩] সাম্যত্তা নিকয়া: অষ্টপথ ও মানুষের ব্যক্তিত্বের গঠনের মতো বিষয় অনুযায়ী বিভক্ত পাঁচটি সুত্তার সিরিজের সংকলন।
[৪] আঙুত্তারা নিকয়া: সুত্তার পাঁচটি ভাগ রয়েছে এখানে যেগুলো ধর্মগ্রন্থের অন্যান্য অংশেও অন্তর্ভুক্ত।
[৫] খুদ্দাকা-নিয়া: ক্ষুদ্র রচনার সংকলন, ধম্মপদের মতো জনপ্রিয় টেক্সট, বুদ্ধের শ্লেষ মেশানো কৌতুক গল্প ও ক্ষুদে কবিতা যার অন্তর্ভুক্ত; উদানা, বেশির ভাগই কাব্যরূপে রচিত বুদ্ধের আপ্ত বাক্যের সংকলন, প্রতিটি কেমন করে আবৃত্তি করতে হবে তার কায়দাসহ সূচনা সম্বলিত; বুদ্ধের জীবন সম্পর্কিত কিছু কিংবদন্তী সম্বলিত কাব্যের আরেকটি সংকলন সুত্তা নিপাতা; এবং কোনও ব্যক্তির কম্ম (কাজ) ) কীভাবে তার ভবিষ্যৎ সত্তাকে প্রভাবিত করে দেখানোর জন্যে বুদ্ধের অতীত জীবন ও তাঁর সহচরগণ সম্পর্কিত কাহিনী জাতকা।
[২] বিনয়া পিতাকা, সন্ন্যাসীদের অনুশীলন গ্রন্থ যা শাস্ত্রবিধি গ্রন্থিত করে। এটি তিন ভাগে বিভক্ত:
[১] সুত্তা বিভঙ্গা: পাক্ষিক সভায় অবশ্যই স্বীকার্য ২২৭টি অপরাধের তালিকা। প্রত্যেকটি নিয়ম কেমন করে এল তার ব্যাখ্যাসহ ধারাভাষ্য।
[২] খন্দকা: মহাভাগ্য (মহান সিরিজ) ও কুলাভাগ্য (ক্ষুদ্র সিরিজ)-এ বিভক্ত এগুলো, বৃত্তিতে যোগ দেওয়ার নিয়মকানুন, জীবনাচার ও উৎসবের উপায় বাৎলে দেয়। নিয়মের উৎসের ঘটনা ব্যাখ্যা করে ধারাভাষ্যও রয়েছে। প্রতিটি বিধিকে পরিচয় করিয়ে দেওয়া ধারাভাষ্য বুদ্ধ সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ কিংবদন্তী সংরক্ষণ করেছে।
[৩] পরিবার: বিধিমালার সার ও শ্রেণীবদ্ধ করণ।
‘তৃতীয় ঝুড়ি’ (অভিধম্ম পিতাকা) দার্শনিক ও মতবাদ বিষয়ক বিশ্লেষণের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। জীবনীকারের এতে তেমন আগ্রহ নেই।
দ্বিতীয় সম্মেলনের পর বৌদ্ধ আন্দোলনে মতবিভেদ দেখা দেয়। কয়েকটি গোত্রে ভাগ হয়ে যায় তা। প্রতিটি মতবাদই এইসব প্রাচীন টেক্সট গ্রহণ করে কিন্তু সেগুলোকে নিজস্ব শিক্ষা অনুযায়ী আবার সাজিয়ে নেয়। সাধারণভাবে কোনও কিছুই পরিত্যাগ করা হয়নি বলেই মনে হয়। যদিও সংযোগ এবং পরিবর্ধনের ঘটনা রয়েছে। স্পষ্টতই থেরাভেদা মতবাদের ধর্মগ্রন্থ পালি লিপিই তিপিতাকার একমাত্র ভাষ্য ছিল না, বরং কেবল এটাই অক্ষতভাবে টিকে গেছে। তারপরও হারিয়ে যাওয়া কিছু ভারতীয় রচনা ধর্মগ্রন্থের পরবর্তী সময়ের চীনা অনুবাদে বা তিব্বতী ধর্মগ্রন্থে বিচ্ছিন্নভাবে পাওয়া যায়, যা আমাদের সংস্কৃত টেক্সটের আদি সংকলন তুলে ধরে। সুতরাং সিই পঞ্চম ও ষষ্ঠ শতকে বুদ্ধের মৃত্যুর প্রায় হাজার বছর পর এসব অনুবাদ রচিত হলেও কিছু কিছু অংশ পালি লিপির মতোই প্রাচীন এবং তাকে সমর্থন করে।
এই সংক্ষিপ্ত বর্ণনা থেকে বেশ কয়েকটা বিষয় বেরিয়ে আসে যা আমরা যেভাবে ধর্মগ্রন্থের বিষয়বস্তুর শরণাপন্ন হচ্ছি তাকে প্রভাবিত করবে। প্রথমত, টেক্সটসমূহ বুদ্ধের নিজস্ব বাণীর সহজ সংকলন হিসাবে বোঝানো হয়েছে, এখানে সন্ন্যাসীদের পক্ষ হতে কোনও কর্তৃত্বপূর্ণ রচনার অংশ যুক্ত হয়নি। মৌখিক প্রেরণ প্রক্রিয়া ব্যক্তিক রচনাশৈলী রহিতঃ এইসব রচনা গস্পেল সম্পর্কে নিজস্ব স্বভাবজাত ব্যাখ্যা দানকারী ম্যাথু, মার্ক, ল্যুক ও জন নামে পরিচিত ইভেঞ্জালিস্টদের সমমর্যাদার কোনও বৌদ্ধের রচনা নয়। যেসব সন্ন্যাসী এসব টেক্সট সংকলিত করেছেন তাঁদের সম্পর্কে আমরা কিছুই জানি না। পরবর্তী সময়ে যাঁরা নিজেদের লেখার কাজে নিয়োজিত করেছেন, জানি না তাঁদের সম্পর্কেও। দ্বিতীয়ত, পালি লিপি অবধারিতভাবে থেরাভাদীয় মতবাদ তুলে ধরে। হয়তো যুক্তির স্বার্থে আদি রূপকে বিকৃত করে থাকবে। তৃতীয়ত, সন্ন্যাসীদের যোগ-লব্ধ অসাধারণ স্মৃতিশক্তি সত্ত্বেও এই ধরনের হস্তান্তর প্রক্রিয়া অনিবার্যভাবে ত্রুটিপূর্ণ ছিল। সম্ভবত বহু রসদ হারিয়ে গেছে, কিছু কিছু ভুল বোঝা হয়েছে এবং নিঃসন্দেহে সন্ন্যাসীদের পরবর্তী দৃষ্টিভঙ্গি বুদ্ধের ক্ষেত্রে প্রযুক্ত হয়েছে। এসব হিতোপদেশের কোনগুলো নির্ভুল ও কোনগুলো বানোয়াট, জানবার কোনও উপায় আমাদের নেই। আধুনিক বিজ্ঞান ভিত্তিক ইতিহাসের প্রয়োজন মেটানোর মতো তথ্য ধর্মগ্রন্থসমূহ আমাদের যোগায় না। এসব কেবল গৌতমের মৃত্যুর মোটামুটি তিন প্রজন্ম পরে তাঁর অস্তিত্ব সম্পর্কিত কিছু কিংবদন্তীর অস্তিত্ব দাবি করতে পারে, যখন পালি লিপি সুনির্দিষ্ট রূপ ধারণ করেছিল। পরবর্তী কালের তিব্বতিয় ও চীনা ধর্মগ্রন্থগুলো নিশ্চিতভাবে প্রাচীন রসদ ধারণ করলেও সেগুলোও কিংবদন্তীর আরও পরের পর্যায়কে তুলে ধরে। এছাড়া, এই সত্যটিও রয়েছে যে, রক্ষাপ্রাপ্ত প্রাচীনতম পালি পাণ্ডুলিপির বয়স মাত্র ৫০০ বছর।