ভারতের জনগণ কেন জীবন সম্পর্কে এমন অস্বস্তিকর অনুভূতি লাভ করেছিল? এই অস্থিরতা কেবল উপ-মহাদেশেই সীমিত ছিল না, বরং সভ্য জগতের বেশ কিছু দূরবর্তী অঞ্চলের মানুষকেও আক্রান্ত করেছিল। ক্রমবর্ধমান সংখ্যকের ধারণা জন্মেছিল যে, তাদের পূর্বসুরিদের অনুসৃত আধ্যাত্মিক অনুশীলন আর কাজে আসছে না। দার্শনিক ও ভাববাদী প্রতিভাবানরা সমাধান বের করার জন্যে ব্যাপক প্রয়াস পেয়েছিলেন। কোনও কোনও ইতিহাসবিদ মানবজাতির জন্যে গুরুত্বপূর্ণ ছিল বলে এই সময়কালকে (৮০০ থেকে ২০০ বিসিই পর্যন্ত বিস্তৃত) ‘অ্যাক্সিয়াল যুগ’ বলে অভিহিত করেন। এই সময়ে বিকশিত সামাজিক মূল্যবোধ বর্তমান কালেও নারী-পুরুষকে পরিপুষ্ট করে চলেছে।[১৩] অষ্টম, সপ্তম ও ষষ্ঠ শতকের মহান হিব্রু পয়গম্বর, ষষ্ঠ ও পঞ্চম শতাব্দীতে চীনের ধর্মীয় ঐতিহ্যের সংস্কার সাধনকারী কনফুসিয়াস ও লাও সু; ষষ্ঠ শতকের ইরানি সাধু যরোস্ট্রার; এবং গ্রিকদের স্বয়ং-প্রমাণিত সত্য বলে মনে হওয়া বিষয়গুলোকে প্রশ্ন করতে উদ্বুদ্ধকারী সক্রেটিস ও প্লেটোর (৪২৭-৩২৭) পাশপাশি অ্যাক্সিয়াল যুগের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ নক্ষত্রে পরিণত হবেন গৌতম। এই ব্যাপক পরিবর্তনে অংশগ্রহণকারীরা এক নয়া জমানার দ্বারপ্রান্তে উপস্থিত হয়েছেন, তাঁরা কোনও কিছুই আর আগের মতো থাকবে না বলে দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করতেন।
অ্যাক্সিয়াল যুগ বর্তমানে আমাদের পরিচিত মানব জাতির সূচনা নির্দেশ করে। এই সময়কালে নারী-পুরুষ তাদের অস্তিত্ব, আপন প্রকৃতি ও সীমাবদ্ধতা সম্পর্কে নজীরবিহীনভাবে সচেতন হয়ে উঠেছিল।[১৪] এক নিষ্ঠুর জগতে নিজেদের প্রবল অক্ষমতার অনুভূতি আপন সত্তার মাঝে সর্বোচ্চ লক্ষ্য ও পরম সত্যি সন্ধানে বাধ্য করেছে তাদের। সময়ের মহান সাধুরা মানুষকে জীবনের জ্বালা-যন্ত্রণার সঙ্গে খাপ খাওয়ানো, নিজেদের দুর্বলতার ঊর্ধ্বে ওঠার কৌশল ও ত্রুটিপূর্ণ জগতে শান্তিতে বসবাস করার পদ্ধতি শিক্ষা দিয়েছেন। এই সময়ে গড়ে ওঠা নতুন ধর্মীয় ব্যবস্থাগুলো–চীনে তাওবাদ ও কুনফুসিয়াবাদ, ভারতে বুদ্ধ মতবাদ ও হিন্দু মতবাদ, ইরান ও মধ্যপ্রাচ্যের একেশ্বরবাদ, ইউরোপের গ্রিক যুক্তিবাদ–সুস্পষ্ট পার্থক্য সত্ত্বেও মৌলিক কিছু বৈশিষ্ট্য ধারণ করে। কেবল এই ব্যাপক পরিবর্তনে যোগ দিয়েই বিশ্বের বিভিন্ন জাতি অগ্রগতি অর্জন ও ইতিহাসের অগ্রযাত্রায় শরিক হতে পেরেছিল।[১৫] কিন্তু এর ব্যাপক গুরুত্ব সত্ত্বেও অ্যাক্সিয়াল যুগ রহস্যময় রয়ে গেছে। মাত্র তিনটি প্রধান এলাকায়–চীন, ভারত ও ইরানে–আর পূর্ব ভূমধ্য মহাসাগরীয় এলাকায় তা শেকড় গেড়েছিল কেন কেউ জানে না, আমরা এর উদ্ভবের কারণও জানি না। কেন কেবল চীনা, ইরানি, ভারতীয়, ইহুদি ও গ্রিকরা এই নতুন দিগন্তের অভিজ্ঞতা পেয়েছিল এবং আলোকন ও মুক্তির নতুন এই অনুসন্ধান যোগ দিয়েছিল? বাবিলনবাসী ও মিশরিয়রাও মহান সভ্যতা গড়ে তুলেছিল, কিন্তু এই পরিচয়ে তারা অ্যাক্সিয়াল আদর্শ গড়ে তোলেনি। বেশ পরে নতুন মল্যবোধে যোগ দিয়েছে: অ্যাক্সিয়াল প্রবণতার পুনরাবৃত্তি ইসলাম বা ক্রিশ্চান ধর্মে। কিন্তু অ্যাক্সিয়াল দেশগুলোয় অল্প সংখ্যক মানুষ নতুন সম্ভাবনার আভাস পেয়ে প্রাচীন প্রথা ভেঙে বেরিয়ে গেছে। তারা তাদের সত্তার গভীর কন্দরে পরিবর্তন সন্ধান করেছে, আধ্যাত্মিক জীবনে বৃহত্তর অন্তর্মুখীতা চেয়েছে আর স্বাভাবিক জাগতিক অবস্থা ও রীতির ঊর্ধ্বে এক বাস্তবতার সঙ্গে একাত্ম হওয়ার প্রয়াস পেয়েছে। গুরুত্বপূর্ণ এই কালপর্বের পর মনে করা হয়েছে যে, কেবল তাদের সীমার বাইরে পৌঁছানোর ভেতর দিয়ে মানব সন্তান পরিপূর্ণ হয়ে উঠতে পারবে।
লিখিত ইতিহাসের সূচনা কেবল বিসিই ৩০০ শতাব্দীর দিকে। তার আগে পর্যন্ত মানুষ কীভাবে জীবন কাটাত, সমাজ সংগঠিত করত তার সামান্যই লিপিবদ্ধ দলিল রয়েছে আমাদের হাতে। কিন্তু মানুষ বরাবরই প্রাগৈতিহাসিক ২০,০০০ বছর কেমন ছিল কল্পনা করতে চেয়েছে। নিজেদের অভিজ্ঞতা আবাদ করতে চেয়েছে সেখানে। গোটা বিশ্বে, প্রতিটি সংস্কৃতির মিথোলজিতে এই প্রাচীন কালগুলো বর্ণিত হয়েছে, এগুলোর কোনও ঐতিহাসিক ভিত্তি নেই, কিন্তু স্বর্গ ও আদি বিপর্যয়ের কথা বলে এগুলো।[১৬] স্বর্ণযুগে, বলা হয়, দেবতারা মর্ত্যে মানুষের সঙ্গে ঘুরে বেড়িয়েছেন। বুক অভ জেনেসিসে বর্ণিত পশ্চিমের হারানো স্বর্গ গার্ডেন অভ ইডেনের কাহিনী তো টিপিক্যাল: কোনও এক কালে মানুষ ও স্বর্গের মাঝে কোনও বিভেদ ছিল না: সন্ধ্যার শীতল পরিবেশে উদ্যানে ঘুরে বেড়াতেন ঈশ্বর। মানুষ পরস্পর হতে বিচ্ছিন্ন ছিল না। আদম ও ইভ তাঁদের যৌনতা বা ভালো মন্দের পার্থক্য সম্পর্কে কিছু না জেনেই শান্তিতে বাস করতেন। আমাদের অধিকতর বিচ্ছিন্ন জীবনে এমন ঐক্য কল্পনা করা অসম্ভব। কিন্তু প্রায় সব সংস্কৃতিতেই এই আদি একতার মিথ দেখিয়েছে যে, মানবজাতি মানুষের জন্যে যথাযথ অবস্থা হিসাবে অনুভূত এক ধরনের শান্তি ও সমগ্রতার আকাঙ্ক্ষা অব্যাহত রেখেছে। আত্মসচেতনতার উন্মেষকে স্বর্গ হতে কষ্টকর পতন হিসাবে প্রত্যক্ষ করেছে তারা। হিব্রু বাইবেল এই সমগ্রতা ও সম্পূর্ণতাকে শালোম বলে: গৌতম নিব্বানার কথা বলে তার সন্ধানে গৃহ ছেড়েছেন। তিনি বিশ্বাস করতেন, মানুষ অতীতে শান্তি ও পূর্ণতায় বসবাস করেছে, কিন্তু সে পথ বিস্মৃত হয়েছে তারা।