প্যালিওলিথিক পর্বের মানুষদের এমন পুরাণ আর রীতিনীতি ছিল এমনটা হতেই পারে। হোমো স্যাপিয়েন্সরাই যে আবার ‘শিকারী বনমানুষ এই বিষয়টা গুরুত্বপূর্ণ, যারা অন্য জন্তুদের শিকার করে, তাদের হত্যা করে ভক্ষণ করে।[১৭] প্যালিওলিথিক পুরাণে জন্তুদের প্রতি বিশেষ সম্মান দেখানো হয়েছে তাই মানুষ এখন তাদের হত্যা করতে বিব্রত বোধ করে। শিকার করার জন্য মানুষের অস্ত্র বাড়ন্ত, কারণ তারা তাদের শিকারের চেয়ে ক্ষুদ্রাকৃতি এবং দুর্বল। এটা কাটাতে তাদের নতুন আয়ুধ আর তরিকার প্রয়োজন হয়। কিন্তু সেই সাথে মনস্তাত্ত্বিক অবস্থার উন্নতি ঘটানো বেশ সমস্যাবহুল বলে প্রতীয়মান হয়। নৃতত্ত্ববিদেরা লক্ষ্য করেছেন যে আজকের আদিবাসী মানুষেরা পশু পাখিকে হরহামেশাই নিজেদের সমগোত্রীয় ‘মানুষ’ বলে অভিহিত করে। তারা মানুষের পশুতে পরিণত হবার বা বিপরীতটা সংঘটিত হবার গল্প বলে ও তাদের কাছে পশু হত্যা একজন বন্ধুকে হত্যা করার মতোই, তাই আদিবাসী শিকারীর দল সফল শিকার অভিযান শেষে মনঃকষ্টে ভুগে থাকে। পবিত্র কর্মকাণ্ড হিসাবে বিবেচিত হবার কারণে এবং উচ্চকোটির উদ্বেগ জড়িয়ে থাকার কারণে শিকারকে ভাবগম্ভীর আনুষ্ঠানিকতায় ভূষিত করা হয়েছে এবং একে কেন্দ্ৰ করে নানা রীতিনীতি ও টাবু গড়ে উঠেছে। শিকারের আগে, শিকারীকে অবশ্যই যৌন সংসর্গ থেকে বিরত থাকতে হবে এবং প্রথাগত অনুষ্ঠানের মাধ্যমে নিজের অর্জিত শুদ্ধতা বজায় রাখবে; শিকার শেষে, হাড় থেকে মাংস নিকিয়ে নেয়া হবে এবং তারপরে চামড়ার উপরে খুলি ও পুরো কঙ্কাল যত্নের সাথে বিছানো হবে তাকে পুনরায় সৃষ্টির অভিপ্রায়ে এবং তাকে নতুন জীবন দান করবে।[১৮]
ধারণা করা হয়, সভ্যতার ঊষালগ্নের প্রথম শিকারীদের অনুরূপ বোধ কাজ করতো। অনেক চাপানউতোর পার হতে হয়েছে তাদের। কৃষিপূর্ব যুগে, তারা নিজেদের খাদ্য নিজেরা উৎপন্ন করতে জানত না, তাই নিজের জীবন বাঁচাতে যাদের তারা নিজেদের সমগোত্রীয় মনে করতো তাদের বিনাশ করতে হয়েছে। তাদের প্রধান শিকার ছিল অতিকায় আকৃতির স্তন্যপায়ী প্রাণী, যাদের শরীর আর মুখের অভিব্যক্তি তাদের সাথে মিলে। তাদের ভয় শিকারীর দল দেখতে পেত এবং তাদের আতঙ্কিত চিৎকারের সাথে একাত্মতা বোধ করতো। মানুষের মতো প্রবাহিত হয় তাদের রক্তধারা। এই অসহ্য অবস্থার মুখোমুখি হয়ে তারা পুরাণ আর আচার অনুষ্ঠানের জন্ম দিয়েছে যাতে সমগোত্রীয় প্রাণী হত্যা করার সাথে তারা অভ্যস্ত হয়ে উঠতে পারে, যার কিছু কিছু পরবর্তীকালের পুরাণে টিকে আছে। প্যালিওলিথিক যুগের পরেও মানুষ বন্যপ্রাণী হত্যা করে তার মাংস ভক্ষণ করাটা সহজভাবে নিতে পারেনি। প্রাচীনকালে প্রায় সব ধর্মীয় ব্যবস্থায় পশু বলি দেয়াটা ছিল প্রধান রীতি যা প্রাচীনকালের শিকারের আনুষ্ঠানিকতার স্মারক এবং মানুষের জীবন বাঁচাতে যেসব প্রাণী নিজেদের জীবন উৎসর্গ করেছে তাদের প্রতি সম্মান জানানো।
পুরাণের প্রথম মহান বিকাশ তাই এমন একটা সময়ে যখন হোমো স্যাপিয়েন্সরা পরিণত হয় homo necans এ ‘খুনী মানুষ,’ এবং বিক্ষুব্ধ পৃথিবীতে অস্তিত্বের পরিবেশ মেনে নেয়াটা তার জন্য কঠিন হয়ে পড়ে। আক্ষরিক অর্থে ব্যবহারিক সমস্যাজনিত প্ৰচণ্ড উদ্বেগ থেকে অনেক সময় পুরাণের জন্ম হতে পারে, যা কেবল যুক্তিতর্ক দ্বারা মীমাংসা করা অসম্ভব। শারীরিকভাবে পিছিয়ে থাকার বিষয়টা মানুষ পুষিয়ে নিতে সক্ষম, তাদের অস্বাভাবিক রকমের বড় মস্তিষ্কের বিশ্লেষণ ক্ষমতা কাজে লাগিয়ে যখন তারা তাদের নিজস্ব শিকারের কৌশল উদ্ভাবন করতে সক্ষম হয়।
তারা অস্ত্র উদ্ভাবন করে এবং শিখে নেয় কিভাবে দক্ষতার সাথে নিজের সমাজকে সংগঠিত করতে হয় এবং দলবদ্ধভাবে কাজ করতে হয়। শুরুর এই পর্বেও homo sapiens এর দল, পরবর্তীকালে গ্রীকরা যাকে লোগোস বলে অভিহিত করবে, তার যৌক্তিক বিবর্তন শুরু করেছে, প্রয়োগবাদী এবং বৈজ্ঞানিক চিন্তাধারা যা সাফল্যের সাথে পৃথিবীর বুকে টিকে থাকতে তাকে সাহায্য করবে।
পৌরাণিক চিন্তাভাবনা থেকে লোগোস সম্পূর্ণ আলাদা একটা ব্যাপার। পুরাণের মতোই, যুক্তিকেও বস্তুগত ঘটনার সাথে ঠিকঠিক সঙ্গতিপূর্ণ হতে হবে। বাইরের পরিবেশে আমরা যদি কিছু ঘটনা ঘটাতে চাই তখন আমরা আমাদের মানসিক শক্তি ব্যবহার করি : যখন আমরা প্রযুক্তি উদ্ভাবন বা সমাজকে সংগঠিত করতে চাই। পুরাণের মতো, এটাও প্রয়োগবাদী। পার্থক্য একটাই, পুরাণ যেখানে হারানো স্বর্গ বা পবিত্র আদিরূপের কল্পিত পৃথিবীর দিকে মুখ ফিরিয়ে রাখে, সেখানে লোগোস সামনে এগিয়ে যায়, সব সময় নতুন কিছু আবিষ্কারের চেষ্টায় মগ্ন, সেটা হতে পারে যুগান্তকারী কোনো উদ্ভাবন বা পুরাণ পরিজ্ঞান শানিয়ে নেয়া এবং পরিবেশের উপরে আরো বেশি করে নিয়ন্ত্রণ কায়েম করা। যদিও পুরাণ এবং লোগোস উভয়েরই নিজ নিজ সীমাবদ্ধতা রয়েছে। প্রাক আধুনিক যুগে বেশির ভাগ মানুষ উপলব্ধি করে যে পুরাণ এবং যুক্তি একটা অন্যটার পরিপূরক; প্রত্যেকটার আলাদা আলাদা মণ্ডল রয়েছে, প্রত্যেকের নির্দিষ্ট ক্ষেত্রে যোগ্যতা রয়েছে এবং এই দু’ধরনের চিন্তা পদ্ধতির মানুষের প্রয়োজন আছে। পুরাণ কখনও শিকারীকে বলবে না কিভাবে শিকারকে বধ করতে হবে বা কিভাবে কোনো অভিযান দক্ষতার সাথে সংগঠিত করতে হবে কিন্তু পশু হত্যার জটিল আবেগ শমিত করতে নিজেকে ধাতস্থ হতে সে তাকে সাহায্যে করবে। পক্ষান্তরে লোগোস দক্ষ, বাস্তবসম্মত এবং যুক্তিনির্ভর কিন্তু মানুষের শেষ পরিণতি সম্বন্ধে কোনো প্রশ্নের সে উত্তর দিতে অপারগ বা মানুষের দুঃখকষ্টও সে লাঘব করতে পারে না।[১৯] শুরু থেকেই তাই homo sapiens-এর দল সহজাত প্রবৃত্তির বলেই বুঝে গিয়েছিল যে পুরাণ আর লোগোসের প্রয়োগ ক্ষেত্র ভিন্ন। নতুন আয়ুধের উদ্ভাবনের নিমিত্তে সে লোগোস প্রয়োগ করে, এবং পুরাণ- এর সাথে আচরিত কৃত্যানুষ্ঠানের প্রয়োগ করে জীবনের নানা দুঃখজনক ঘটনার সাথে নিজেকে মানিয়ে নেয়ার চেষ্টা করে যা তাকে পুরোপুরি আপ্লুত করে ফেলার মতো হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে এবং যা তাকে সম্পূর্ণ মানুষ হিসাবে ভূমিকা রাখতে বাধা দিচ্ছে।