পণ্ডিতেরা মনে করেন যে আরোহণ সম্পর্কিত প্রথম পুরাণটার জন্ম প্যালিওলিথিক পর্বে এবং তা শামান নামে একজনের সাথে সম্পর্কিত, শিকারী সমাজের প্রধান ধর্মীয় আচার্য্য। তিনি ছিলেন পরমানন্দ আর স্বপ্নপ্রয়াণের গুরু, যার স্বপ্ন আর দূরদৃষ্টি শিকারের মূল্যবোধগুলোকে একটা ভিত্তি দিয়েছে এবং এর প্রতি একটি আধ্যাত্মিক ব্যাখ্যা আরোপ করেছে। শিকার ছিল মারাত্মক বিপদসঙ্কুল। শিকারের প্রয়োজনে শিকারীদের অনেকদিন বাইরে কাটাতে হয়, গুহার নিরাপত্তা ব্যবস্থা বিঘ্নিত করে এবং নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে তাঁরা তাঁদের লোকদের জন্য খাবার সংগ্রহ করে আনতো। কিন্তু, আমরা এখন দেখবো যে, এটা কেবল একটা প্রয়োগবাদী অভিযান না, তাদের অন্যান্য কর্মকাণ্ডের মতো এরও একটা সৰ্বব্যাপী মাত্রা রয়েছে। গুরু শামানও একটা অভিযানে নেমেছেন, কিন্তু তার এ অভিযান আধ্যাত্মিকতার। এটা অনুমান করা হয় যে নিজের দেহ ত্যাগ করার ক্ষমতা তার ছিল এবং তার আত্মা স্বর্গীয় পরিমণ্ডলে ঘুরে বেড়াত। তিনি যখন স্বপ্নপ্রয়াণ অবস্থায় থাকতেন তখন বাতাসে ভেসে যেতে পারতেন এবং নিজের লোকদের ভালোমন্দ নিয়ে দেবতাদের সাথে অন্তরঙ্গ আলাপ করতেন।
স্পেনের আলতামিরা এবং ফ্রান্সের লাসাউক্সে অবস্থিত প্যালিওলিথিক গুহা মন্দিরে, আমরা শিকারের চিত্র অঙ্কিত দেখতে পাই; বন্য পশু আর শিকারী পাশাপাশি, মানুষগুলোর মুখে পাখির মুখোশ উড্ডয়নের ইঙ্গিতবহ, সম্ভবত তারাই শামান। এমনকি আজও, সাইবেরিয়া থেকে টিয়েরা ডেল ফুয়েগোর শিকারী গোষ্ঠীর, শামানরা বিশ্বাস করে যে তারা যখন স্বপ্নপ্রয়াণে থাকে তখন তারা স্বর্গে আরোহণ করে এবং দেবতাদের সাথে কথা বলে, বহুকাল আগে স্বর্ণযুগে মানুষেরা যেমন করে থাকত। পরমানন্দ অর্জনের ক্ষেত্রে নানা পদ্ধতির ব্যাপারে শামানদের বিশেষ প্রশিক্ষণ দেয়া হতো। বয়ঃসন্ধিক্ষণে সে কখনও চিত্তবৈকল্যে আক্রান্ত হতো যা তার পুরাণ লোকায়ত চেতনার প্রতি প্রবল বৈরাগ্য এবং প্রাচীন মানুষদের যে ক্ষমতা দেয়া হয়েছিল, কিন্তু যা আজ আমরা হারিয়ে ফেলেছি, তার পুনরুদ্ধার। ঢাকঢোল সহযোগে শামান স্বপ্নপ্রয়াণ দশাপ্রাপ্ত হতো বিশেষ আচারানুষ্ঠান পর্বে। কখনও সে একটা গাছ বা লম্বা খুটি বেয়ে উপরে উঠে যা একসময় স্বর্গ ও মর্ত্য সংযোগকারী পাহাড়, গাছ বা সিঁড়ির প্রতীকী আরোপণ।[১২] পৃথিবীর গভীরতার ভিতর দিয়ে স্বর্গে যাবার ঘটনা বর্ণনা করেছে আধুনিককালের এক শামান :
মানুষ যখন গান গায়, আমি নাচি। আমি পৃথিবীর উদরে প্রবেশ করি। আমি একটা জায়গায় যাই, মানুষ বসে পানি পান করে অনেকটা সেরকম জায়গাটা। আমি বহুদূর ভ্রমণ করি, অনেক দূর… যখন আমি আবির্ভূত হই, তখনই আমি উঠতে শুরু করেছি। দক্ষিণে ঝুলে থাকা সুতো, সেই সুতো বেয়ে আমি উঠছি… এবং তুমি অবশেষে যখন ঈশ্বরের সান্নিধ্যে পৌঁছাও, তুমি নিজেকে খুব দীন করে তোলো। তারপরে সেখানে কর্ম সমাধা করে তুমি অন্যেরা যেখানে রয়েছে সেখানে ফিরে আসো।[১৩]
শিকারীদের বিপদসঙ্কুল অভিযানের মতো, শামানও মৃত্যুর মোকাবেলা করে। সে যখন তার লোকদের কাছে ফিরে আসে এবং তার সঙ্গীসাথীরা তাকে সুস্থ করে তোলে তারা তোমার মাথা তুলে ধরে এবং মুখের এক পাশে ফুঁ দেয়। এভাবেই তুমি আবারও বেঁচে উঠো। বন্ধুরা যদি তোমাকে ফুঁ না দিত তবে তুমি মারা পড়তে… তুমি নিশ্চিত মারা যেতে, এবং মৃত বলে ঘোষণা করা হতো তোমাকে।[১৪]
আধ্যাত্মিক ঊর্ধ্বচর্চা শারীরিক ভ্রমণের সাথে জড়িত না, কিন্তু একটা পরমানন্দের অনুভূতি যখন মনে হবে আত্মা দেহচ্যুত হয়েছে। পৃথিবীর অভ্যন্তরে অবরোহণ ব্যতীত স্বর্গের গৌরবে আরোহণ করা যায় না। পৃথিবীর সব সংস্কৃতির মরমীবাদী সাধু আর যোগীদের আত্মিক অনুসন্ধানে এই একই প্রাচীন আধ্যাত্মিকতার সুর ঘুরে ঘুরে এসেছে। মানুষের ইতিহাসের সুপ্রাচীন কাল থেকেই প্রচলিত এসব পুরাণ এবং আরোহণের আচারঅনুষ্ঠানের এই উপস্থিতি অতীব গুরুত্বপূর্ণ। এর মানে মানবতার অন্যতম আকুতি হলো মানবিক অবস্থার ঊর্ধ্বে উঠার আকাঙ্ক্ষা। মানুষ বিবর্তনের প্রক্রিয়া শেষ করার সাথে সাথে, তারা দেখতে পায় ছাপিয়ে যাবার ছড়িয়ে পড়ার একটা আকাঙ্ক্ষা তাদের অস্তিত্বের সাথে অঙ্গীভূত হয়ে গেছে।
শিকারী সবগোষ্ঠীতেই আমরা কেবল শামানদের উপস্থিতি খুঁজে পাই এবং তাদের আধ্যাত্মিকতায় পশু একটা গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে রেখেছে। প্রশিক্ষণের সময়, আধুনিককালের শামানকে একটা পর্যায়ে কখনও বনে জন্তুদের সাথে কাটাতে হয়। আশা করা হয় এ পর্যায়ে কোনো একটা জন্তুর সাথে তার দেখা হবে যে তাকে পরমানন্দের গূঢ় তত্ত্বের বিষয়ে অবহিত করবে, পশুদের ভাষা শেখাবে এবং তার সব সময়ের সহচরে পরিণত হবে। এটাকে কোনো মতেই প্রত্যাবৃত্তি বলা যাবে না। শিকারী সমাজে, পশুকে কখনও নিকৃষ্ট জীব হিসাবে দেখা হয় না বরং তাদের প্রাজ্ঞতার অধিকারী হিসাবে দেখা হয়। অমরত্ব আর দীর্ঘায়ুর রহস্য তারা জানে, এবং তাদের সাথে নিবিড়ভাবে মিশে শামান একটা উন্নত জীবনের অধিকারী হয়। স্বর্ণ যুগে, মর্যাদাচ্যুত হবার আগে, ভাবা হতো যে মানুষ জীবজন্তুর সাথে কথা বলতে পারতো এবং যতক্ষণ না সে এই বিস্মৃতবিদ্যায় পুনরায় দক্ষ না হয়ে উঠবে ততক্ষণ একজন শামান দিব্য জগতে অবতীর্ণ হতে পারবে না।[১৫] কিন্তু তার এই অভিযানের আরেকটা ব্যবহারিক উদ্দেশ্যও রয়েছে। শিকারীদের মতো, সেও তার লোকদের জন্য খাদ্য সংগ্রহ করে। যেমন, গ্রীনল্যাণ্ডের কথাই ধরা যাক, এস্কিমোরা বিশ্বাস করে এক বিশেষ দেবীর রক্ষিতা হলো সীল আর তাই তাকে জীবজগতের দয়িতা বলা হয়। যখনই শিকারের অভাব দেখা দেয় তখনই শামানকে পাঠানো হয় তাকে সন্তুষ্ট করতে যাতে মন্দাভাব কেটে যায়।[১৬]